ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নদ-নদী রক্ষায় উচ্ছেদ

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

নদ-নদী রক্ষায় উচ্ছেদ

দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় ও জলাশয় রক্ষায় সারাদেশে আবারও শুরু হয়েছে উচ্ছেদ অভিযান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জেলা ও স্থানীয় প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সোমবার থেকে সারাদেশে শুরু করেছে এই উচ্ছেদ অভিযান। এর মাধ্যমে নদী ও জলাশয় তীরবর্তী প্রায় সকল অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ও হবে। তবে তা করতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী ও বিত্তবানরা রেহাই পেয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে উচ্ছেদ অভিযানকারীদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে কিছু মামলাসহ স্থগিতাদেশও রয়েছে। রয়েছে কিছু ধর্মীয় উপাসনালয় ও স্পর্শকাতর স্থাপনা। তবে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে সে সবও সরিয়ে নেয়া আবশ্যক নদ-নদী ও জলাশয়ের প্রবাহ অক্ষুণœ রাখার স্বার্থে। জনশ্রুতিতে আট শতাধিক নদীর কথা শোনা গেলেও বর্তমানে কায়ক্লেশে টিকে আছে ৭১০টি। এর মধ্যে ৩শ’ বড় নদী এবং ৪শ’ শাখা নদী-উপনদী। ৫৭টি নদী আন্তর্জাতিক হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে ৫৩টি ভারত থেকে প্রবাহিত, মিয়ানমার থেকে ৩টি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবাহিত ১টি নদী। সত্যি বলতে কি, কোনটির অবস্থাই ভাল নয়। ফারাক্কা-গজলডোবাসহ নানা বাঁধ ও ব্যারাজে স্বাভাবিক প্রবাহ অবরুদ্ধ প্রায়। তদুপরি প্রতিনিয়ত দখল-দূষণে জর্জরিতÑ দেশে ও বিদেশে সমানভাবে, ভূমিদস্যু ও জনমানুষ কর্তৃক। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে নদীর প্রবাহ সচল রাখাসহ নদী রক্ষায় ন্যূনতম সচেতনতা নেই বললেই চলে। যে কারণে ইতোমধ্যেই শতাধিক নদী বিলীন হয়ে গেছে। বাকিগুলোরও যায় যায় অবস্থা। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত ৪০৫টি নদী অবৈধ দখলদারকবলিত হওয়ায় মানচিত্রে সেগুলোর অবস্থান প্রায় হারানোর উপক্রম। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক নদ-নদীকে জীবনসত্তা বলে অভিহিত করায় সেগুলোকে অবিলম্বে অবমুক্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রধানত উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই রয়েছে সমূহ ঝুঁকিতে। এমতাবস্থার নদ-নদীগুলোকে অন্তত সারা বছর ধরে নাব্য অর্থাৎ সচল রাখা সম্ভব না হলে মরুকরণ প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করা যাবে না, যা শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তবে আশার কথা এই যে, বিলম্বে হলেও বোধোদয় ঘটেছে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ রাজধানীর চারপাশের নদ-নদী সর্বোপরি দেশের সব নদী ও শাখা নদীকে দখল-দূষণমুক্ত করে সারা বছর ধরে নাব্য রাখার জন্য সরকার একটি মাস্টারপ্ল্যান তথা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে একদিকে যেমন নদীমাতৃক বাংলাদেশের আবহমান চিরায়ত প্রকৃতি ও রূপ ফিরে আসবে, তেমনি নৌযান চলাচলের মাধ্যমে ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণসহ মানুষের যাতায়াতের পথ সহজ, সুগম ও সুলভ হবে। তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যায় প্রায় নিয়মিতই চলছে উচ্ছেদ অভিযান। রাজধানীর বাইরেও এই উচ্ছেদ অভিযান চলমান। নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নৌপথ সচলের পাশাপাশি সারা বছর নদীর নাব্য রক্ষাসহ সেচ সুবিধা ও চাষাবাদ অপেক্ষাকৃত সহজ ও সম্প্রসারিত হবে নিঃসন্দেহে। ইলিশসহ মাছের উৎপাদনও বাড়বে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৮ শতাধিক নদ-নদী এবং ৫৭টি আন্তঃদেশীয় সংযোগ নদী রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, সিকিম, এমনকি চীনও জড়িত। সুতরাং আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা ও সুসম বণ্টনের ক্ষেত্রে এসব দেশের সক্রিয় অংশগ্রহণও অপরিহার্য। পানিসম্পদের সুষ্ঠু ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নয়ন সহযোগী ১২টি দেশের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশে ডেল্টা প্ল্যান (বিডিপি) ২১০০’ নামে যুগান্তকারী একটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত এই পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় আগামী এক শ’ বছরে পানির প্রাপ্যতা এর ব্যবহারসহ প্রতিবেশ ও পরিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, নদী না বাঁচলে বাঁচবে না বাংলাদেশও।
×