ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণ আফ্রিকায় চার বছরে ৪৫২ বাংলাদেশী নিহত

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

দক্ষিণ আফ্রিকায় চার বছরে ৪৫২ বাংলাদেশী নিহত

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ দক্ষিণ আফ্রিকায় গত চার বছরে সাড়ে চার শ’র বেশি বাংলাদেশী অভিবাসী নিহত হয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তারা দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে উদ্বেগ তুলে ধরে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ডিসেম্বরের শুরুতে এ নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা। খবর এএফপি ও বিবিসির। প্রিটোরিয়াতে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে জানানো হয়েছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় মোট ৪৫২ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর মধ্যে ২০১৯ সালের প্রথম নয় মাসে ইতোমধ্যে ৮৮ জন বাংলাদেশীর মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে। দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাব্বির আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছেন, নিহতদের শতকরা ৯৫ শতাংশই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে বেশিরভাগই ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত ও নারীঘটিত শত্রুতার কারণে নিহত হয়েছেন বলে হাইকমিশন জানতে পেরেছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মোঃ রেজাউল করিম খান ফারুক জানিয়েছেন, বাংলাদেশীদের মালিকানাধীন দোকানপাটে হামলা এবং লুটতরাজ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেপটাউন, জোহানসবার্গ, প্রিটোরিয়া এবং ব্লুমফন্টেইনে অভিবাসী বিরোধী হামলার শিকার হয়েছেন বহু বাংলাদেশী। করিম খান আরও জানান, ‘বাংলাদেশ থেকে বৈধ এবং অবৈধভাবে যারা আসেন, নানাভাবে কিছুদিন পর তারা এখানে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে, বিশেষ করে মুদি বা গ্রোসারি দোকান দেয় তারা। তখন দেখা যায় বাংলাদেশী আরেকজন অভিবাসীর সঙ্গেই হয়ত তার দ্বন্দ্ব শুরু হলো। এর পরিণতিতে অনেক খুনখারাপি আমরা দেখেছি। এছাড়া কাগজপত্র বিশেষ চেক করা হয় না বলে অনেকে চলে যায় গ্রামের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় তারা স্থানীয়দের সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এ থেকে দোকানে লুট ও সংঘর্ষ এবং খুনের ঘটনা ঘটার অভিযোগ আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশীদের জন্য একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশটিতে বহু বাংলাদেশী অবৈধভাবে অবস্থান ও কাজ করছেন, যে কারণে অনেক সময় হত্যাকাণ্ডের পর মামলা করায় জটিলতা সৃষ্টি হয়। হামলা, লুট এবং হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে অভিবাসী বাংলাদেশীরা নিরাপত্তা চেয়ে জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনের কার্যালয়ের সামনে নবেম্বর মাসে বিক্ষোভও করেছে। বেসরকারী হিসাবে অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকায় কর্মরত বাংলাদেশী কমিউনিটির হিসাব অনুযায়ী দেশটির বিভিন্ন শহরে এই মুহূর্তে প্রায় তিন লক্ষ বাংলাদেশী রয়েছেন। এদের বেশিরভাগ কেপটাউন, জোহানসবার্গ এবং ব্লুমফন্টেইনে থাকেন। মূল শহরের আশপাশে এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে কাজ করেন অনেকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা উইং এ মহাপরিচালক মালেকা পারভিন জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা ইতোমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে উদ্বেগ তুলে ধরে কয়েক দফা নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ডিসেম্বরের শুরুতে এ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে যে ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, ফলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থামাতে আমরা নিজেরা সরাসরি কিছু করতে পারছি না। তিনি বলেন, ‘ওদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হবার কারণে কেবল বাংলাদেশী নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার আশপাশের দেশগুলো থেকে যারা ওখানে এসে ব্যবসা বাণিজ্য করছে সবাই হামলার শিকার হচ্ছে।’ বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন তামান্না আক্তারের স্বামী। তিনি জানান, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা যাবার দেড় বছরের মধ্যে তার স্বামী সেখানে কাজের অনুমতি অর্থাৎ ওয়ার্ক পারমিট পান। এরপরে জোহানসবার্গে তিনি একটি মুদি দোকান খোলেন। বছর খানেকের মধ্যে দাঁড়িয়ে যায় তার ব্যবসা। টাকা পয়সা জমিয়ে ২০১৫ সালে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। বিমানের টিকেট কেনাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত তারিখের কয়েকদিন আগে নিজের দোকানের সামনে খুন হন তিনি। এ ঘটনায় ওইখানে কোন আটক-গ্রেফতার-বিচার কিছু হয়েছে কি না আমরা জানি না। শুধু এইটুকু জানি, ওইখানে কোন মামলা হয় নাই। উনাকে দেশে এনে মাটি দেয়া হয়, এখানেও কোন মামলা হয় নাই।’ তামান্না আরও জানান, ‘আমার সঙ্গে ২০১২ সালে উনার বিয়ে হয়, ফোনেই কবুল পড়ানো হয়। উনি মারা যাওয়ার পর ওই দেশ থেকে উনার টাকা পয়সা কিছু আসে নাই, আর এইখানে তো কিছু ছিলই না তেমন, ফলে আমরা খুব অসুবিধায় পড়ে যাই।’ চার বছরের বেশি সময় পার হবার পর তামান্না সম্প্রতি অন্যত্র বিয়ে করেছেন। কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ফেরদৌসির বড় ভাই কোন রকম বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ২০১৩ সালে যান দক্ষিণ আফ্রিকা। তিন বছর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার পর ২০১৬ সালে ভাইয়া ‘এ্যাসাইলাম পেপার’ হাতে পায়, এরপর একটা দোকান করার জন্য পরিচিত একজনের কাছ থেকে দশ হাজার রেন্ড (দক্ষিণ আফ্রিকান মুদ্রা) ধার করেছিল ভাইয়া। আমরা পরে শুনছি যেদিন বাসায় টাকা নিয়া আসছে ওইদিন রাত্রেই খুন হয় আমার ভাই’, বলেন ফেরদৌসি। তিনি জানিয়েছেন, তার ভাইয়ের লাশ প্রায় এক মাস পর দেশে পৌঁছেছিল এবং সেখানে কোন মামলা হয়নি। আমাদের জানানো হয়েছে, আমার ভাইয়ের কাগজপত্র নাই, সেজন্য এ ঘটনায় ওই দেশে মামলা হয় নাই। এমনকি লাশ দেশে আনার খরচও আমরা এখান থেকে পাঠিয়েছি। সন্তান হারানোর শোক এই পরিবারটি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পরিবারের হাল ধরার জন্য প্রায় দশ লাখ টাকা ধার করে ছেলেকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল।
×