ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বড়দিনে আনন্দঘন আয়োজন পাঁচতারকা হোটেলে

সবার উৎসব, সান্তাক্লজের হাত থেকে চকলেট নিয়ে বাড়ি ফেরা

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

সবার উৎসব, সান্তাক্লজের হাত থেকে চকলেট নিয়ে বাড়ি ফেরা

মোরসালিন মিজান ॥ বড়দিন বলে কথা। আয়োজনগুলোও ছিল বড় এবং বর্ণাঢ্য। বাসা বাড়িতে সাজানো হয়েছিল ক্রিসমাস ট্রি। পিঠাপুলিসহ মুখরোচক খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাইরেও আয়োজনের কমতি ছিল না। রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোর উদ্যাপন এদিন আলাদা দৃষ্টি কাড়ে। বিশেষ করে প্যানপ্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও উৎসবপ্রিয়দের প্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছিল। প্রতিবারের মতো এবারও হোটেলটিতে বড়দিন উদ্যাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ আয়োজন কত বর্ণাঢ্য হয় তা আগে থেকেই অনেকের জানা। যথারীতি চলে এসেছিলেন তারা। সকালে শুরু হওয়া উৎসব চলে রাত পর্যন্ত। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসবে যোগ দেন অন্যান্য ধর্মের মানুষেরাও। এভাবে সবার হয়ে ওঠে আয়োজনটি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত ছবিটা সুন্দর দৃশ্যমান হয়। হোটেলের লবিতে পা ফেলতেই চোখে পড়ে আলোঝলমলে ক্রিসমাসট্রি। একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঁচু। পুরোটাই মরিচবাতি দিয়ে পেঁচিয়ে নেয়া। বাতিগুলো মিটমিট করে জ্বলছিল। এর ঠিক নিচে পেটমোটা গিফট বক্স। একটা দুটো নয়। অগুণতি। লবি ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ছোট বড় আরও কয়েকটি ক্রিসমাসট্রি চোখে পড়ল। হোটেলের টেরাকোটা কর্নারে বড়দিনের আকর্ষণীয় ডিসপ্লে। এখানে দেখা গেল, নিজের বলগা হরিণসহ সান্তাক্লজ দাঁড়িয়ে আছেন। ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, সান্তা বাস করেন সুদূর উত্তরের এক চিরতুষারাবৃত দেশে। সে তুষারপাত আঁচ করা যায় দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। বড়দিন উদ্যাপন করতে আসা মানুষজন ভিড় করেছিলেন এখানে। কখনও দলবেঁধে, কখনও নিজেই নিজের ছবি তুলছিলেন। অধিকাংশের মাথায় সান্তাক্লজের লেজওয়ালা সেই টুপিটা। হিজাব পরে আসা তরুণীদেরও সান্তাক্লজের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে দেখা গেল। এমন মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া বড়দিনের ততোধিক বড় প্রাপ্তি। অবশ্য মূল আয়োজনটি ছিল হোটেলের পেছনের অংশে। খোলা প্রাঙ্গণে চমৎকার আয়োজন। এখানেও সবার উৎসব। এক মায়ের দিকে তাকিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশটাকেই যেন দেখা হলো আবার। পোশাকের কিছু বৈশিষ্ট্য বলে দিচ্ছিল, তিনি মুসলিম নারী। নিজের চর্চা ঠিক রেখেই যোগ দিয়েছিলেন বড়দিনের উৎসবে। তার কোলে শিশু সন্তান। সান্তাক্লজের টুপি পরে এসেছিল সে। হোটেলের নিয়োগ করা সান্তাক্লজের কাছে যেতেই তাকে চকলেট উপহার দেয়া হলো। একটি চকলেট কচি হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছিল সে। কাছাকাছি সময়ে আরেক মুসলিম দম্পতি শিশু সন্তানসহ সান্তার পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে সেলফি তুললেন। সান্তা এর পর ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে চলে যান মাঠের মাঝখানে। শ্মশ্রুম-িত সান্তার গায়ে সাদা কলার ও কাফযুক্ত লাল কোট। সাদা কাফযুক্ত লাল ট্রাউজার। কালো চামড়ার বেল্ট। পায়ে বুটজুতা। বাচ্চারা তাকে ঘিরে ধরেছিল। চকলেট বিতরণ ও ছবি তোলার এক ফাঁকে কথা হয় সান্তাক্লজের সঙ্গে। বাস্তবে তার বয়স ৩৩ বছর। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সকাল ১০টা থেকে সান্তার পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। শিশুদের স্বাগত জানাচ্ছি। চকলেট বিতরণ করছি। খুবই ভাল লাগছে। দুপুরের পর পর্যন্ত কয়েক হাজার চকলেট বিতরণ করেছেন বলে জানান তিনি। চকলেট ছাড়াও শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। মঞ্চ থেকে ভেসে আসছিল বড়দিনের গান। শিশুরা একটু পর পরই গাইছিল: জিঙ্গেল বেলস, জিঙ্গেল বেলস/ জিঙ্গেল অল দ্য ওয়ে...। বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গাওয়া হচ্ছিল: উই ওয়ানা উইশ ইউ এ ম্যারি ক্রিসমাস/ফ্রম দি বটম অব আওয়ার হার্ট...। একই মঞ্চে ছিল নৃত্যায়োজন। আর ম্যাজিকের সময় তো চোখের পলক ফেলা দায় ছিল। শিশুদের জন্য খেলাধুলারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। গ্রামীণ ঐতিহ্যের নাগরদোলায় চড়ছিল তারা। সবুজ ঘাসের ওপর পাতা হয়েছিল ট্রেন লাইন। সেখানে টয়ট্রেন চলছিল। ঘোড়ার গাড়িও বাদ যায়নি। হোটেল সংলগ্ন লেকপাড়ে রাখা ছিল ঘোড়াচালিত গাড়ি। সারাদিনই এটি চলেছে। উৎসবে দেখা মেলে গনক টিয়া পাখির। ঠোঁট দিয়ে খাম তুলে এনে মালিকের হাতে দেয় সে। চিঠি পড়ে মালিক আগ্রহী ব্যক্তির ভবিষ্যত বলে দিতে থাকেন! সার্কাসসহ আরও কিছু আয়োজন দেখে আস্ত একটি দিন দিব্যি কেটে যায়। এদিন উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন মনিপুরী পাড়ার বাসিন্দা রাহুল রোজারিও। স্ত্রী সন্তানসহ এসেছিলেন তিনি। বললেন, ক্রিসমাসের জন্য একটা বছর অপেক্ষা করে থাকি। সময় ঘনিয়ে এলে মনটা এখনও আনন্দে নাচতে থাকে। এখানে ছেলেকে নিয়ে এসেছি। ওর আনন্দ দেখে নিজের আনন্দটা আরও বেড়ে গেছে। নিজের ধর্মের বাইরের কয়েক বন্ধুকে রাতে বাসায় দাওয়াত করেছেন বলেও জানান তিনি। উৎসবে যোগ দেয়া আখতার হোসেন বলছিলেন, ধর্ম যে যার মতো করে পালন করবে। উৎসব সবার। আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করি। বড়দিনের আনন্দ থেকে তাই নিজেকে বঞ্চিত করতে পারলামনা। বড়দিনের উৎসবের প্রশংসা করে তিনি বলেন, এমন উৎসবমুখর দিন বার বার আসুক। জয় হোক অসাম্প্রদায়িক বাঙালী চেতনার।
×