ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাঠের বাইরে প্রতিবাদী ওজিল

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯

মাঠের বাইরে প্রতিবাদী ওজিল

বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার মেসুত ওজিল। বল কন্ট্রোল, বিশাল রেঞ্জের নিখুঁত পাস, গোল করাতে সহায়তা এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ দেখিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নিজে গোল করার চেয়ে সতীর্থদের দিয়ে গোল করাতে বেশি ভালবাসেন তিনি। জোশে মরিনহো তাকে জিনেদিন জিদানের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। গোল দিতে সহায়তায় শুধুমাত্র জিদান নয়, ওজিল ছাড়িয়ে গেছেন রোনালদিনহো, ডেভিড বেকহাম থেকে শুরু করে সবাইকে। জাতীয় দলকে বিদায় বলে দিয়েছেন গত বছর। ক্লাব ফুটবলে এখনও আলো ছড়াচ্ছেন আর্সেনালের জার্সিতে। সাবেক জার্মানির এই তারকা ফুটবলার মাঠের বাইরেও আলোচিত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে। সম্প্রতি চীনে উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে হওয়া আচরণ নিয়েও আওয়াজ তুলেছেন ওজিল। সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম টুইটারে মেসুত ওজিল চীনের উইঘুর মুসলিমদের ‘নির্যাতনের প্রতিরোধকারী যোদ্ধা’ বলে প্রশংসা করেন। পাশাপাশি, উইঘুরে নির্যাতিত মুসলমানদের রক্ষায় মুসলিম বিশ্ব কেন এগিয়ে আসছে না, সেজন্য হতাশার পাশাপাশি ক্ষোভও প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে আর্সেনালের এই সুপারস্টার লিখেছেন, ‘পূর্ব তুর্কিস্তানে কোরআন আগুনে জ্বালানো হচ্ছে, মসজিদে তালা দেয়া হচ্ছে, মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে মুসলিমদের এবং যুবকদের বন্দী করে দাসত্বের সম্মুখীন করা হচ্ছে।’ এর পরও এই ঘটনার প্রতিবাদে মুসলিম বিশ্বের নীরবতায় অবাক মেসুত ওজিল। উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনাদের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, মুসলিম ঘর থেকে পুরুষদের সেনাছাউনিতে বন্দী করে রেখে প্রতিটি পরিবারের অন্তত একটি মেয়েকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে একজন কমিউনিস্ট পুরুষের সঙ্গে। এর পর উইঘুর মুসলিমদের জন্য দোয়া করে ওজিল লিখেছেন ‘হে মহান প্রতিপালক! পূর্ব তুর্কিস্তানে আমাদের উইঘুর ভাইদের সঙ্গে থাকো ...।’ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, উইঘুরে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে কোন বিচার ছাড়াই কড়া নিরাপত্তায় বিশেষ ক্যাম্পে আটকে রেখেছে চীন। এমন সব অভিযোগের উত্তরে চীন অবশ্য সব সময়ই বলেছে, উইঘুর মুসলিমরা যেন জঙ্গী ক্রিয়াকলাপে না জড়িয়ে পড়ে সে লক্ষ্যে তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক মহলে উইঘুর নিয়ে বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে চীন, যদিও সেই চাপকে অবশ্য খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না তারা। যার ফলে, উইঘুরে যা করার তাই করে যাচ্ছে চীন। কিন্তু চুপ থাকতে পারেননি মেসু ওজিল। তার এই টুইটারে প্রতিবাদী পোস্ট এখন গোটা বিশ্বে আলোচিত। এর ফলে চীন একটি প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে তার ক্লাব আর্সেনালকে। শুধু তাই নয় ওজিলকে বরখাস্তের আহ্বানও জানিয়েছে। ওজিলকে যদি বরখাস্ত না করে তাহলে, আর্সেনালের সঙ্গে সব ধরনের চুক্তি বর্জন করবে চীন। এরপরই বিবৃতি দিয়েছে প্রিমিয়ার লীগের ক্লাবটি। যেখানে তারা লিখেছে, এটা ওজিলের নিজস্ব মতামত। আর্সেনাল ক্লাব কখনও কোন রাজনীতির মধ্যে ছিল না। ভবিষ্যতেও থাকবে না। সুতরাং, ওজিলের স্ট্যাটাসের সঙ্গে আর্সেনালের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই। জার্মানির জাতীয় দলের সাবেক এই তারকা তুর্কী বংশোদ্ভূত। তুরস্কে জন্ম নেয়া ওজিল বড় হয়েছেন জার্মানিতে। দাদা তুরস্কের কিন্তু বাবা-মা ও তার জন্ম জার্মানি। বেড়ে উঠা জার্মানির জেলসেনকির্সেন শহরে। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি তার অন্যরকম ভালবাসা। কলেজে ফুটবল খেলায় মেতেছেন এবং সেখান থেকেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন বাড়তে থাকে। এর পরের গল্পটা তো সবারই জানা। বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের আলোচিত মুখ। ওজিল প্রথমদিকে তার শহরের বিভিন্ন যুব ক্লাবে খেলা শুরু করেন। এরপর ৫ বছর তিনি রট-উইস এসেনের হয়ে খেলেন। কলেজের ক্লাস রুম থেকে দেখা সেই শালকে জিরো ফোরের মাঠেই তার খেলা শুরু। ২০০৫ সালে শালকের যুব দলে যোগ দেন। এখানে তিন বছর কাটিয়ে ক্লাবের সঙ্গে বনাবনি না হওয়ায় ২০০৮ সালে তিনি শালকে ছেড়ে চলে যান ওয়ের্ডার ব্রেমেনে। ২০০৮ সালে ৪.৩ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে চলে আসেন ওয়ের্ডার ব্রেমেনে। দলকে ২০০৯ ডিএফবি পোকাল জেতাতে ও উয়েফা কাপের ফাইনালে উঠাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ২০০৯-১০ মৌসুমে ব্রেমেন বুন্দেসলিগায় সম্মানজনক তৃতীয় স্থান লাভ করে, ওই মৌসুমে ওজিল ৩১ খেলায় ৯ গোল করে ও ১৭ গোলে সহায়তা করে। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে ওজিল মুগ্ধ করে ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবগুলোকে। বড় বড় জায়ান্ট ক্লাব তাকে ভিড়ানোর জন্য বিভিন্ন গুজব ছড়ানো শুরু করে। শেষ সব গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে সেই সময়ের জোশে মরিনহো তাকে রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবে ১৫ মিলিয়ন ইউরো ফি দিয়ে নিজেদের দলে নেয়। বর্তমানে আর্সেনালে রয়েছেন ওজিল। ২০২১ সাল পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন নতুন করে। ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে ক্লাব ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনে নেয় এই ক্লাবটি। তখন জার্মানির সর্বকালের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় হন। আর্সেনাল তাকে ১১ নম্বর জার্সি ও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের ভূমিকা দেয়। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে অত্যন্ত খারাপ পারফর্মেন্স করে জার্মানি। যার ফলে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে যায় তারা। এমন সময় ওজিলের তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাত জার্মানি মিডিয়া জগাখিচুরি বানিয়ে ফেলে। তখন জার্মানির সঙ্গে তুরস্কের রাজনৈতিক তোলপাড় চলে। একই সঙ্গে জার্মান দর্শক উগ্রবাদী হয়ে বর্ণবাদের শিকারে পরিণত করেন ওজিলকে। এমন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে জার্মান জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন ওজিল। খোদ জার্মানি ফুটবল ফেডারেশনের (ডিএফবি) প্রধান রাইনহার্ড গ্রিন্ডেলের বিরুদ্ধেই বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ আনেন তুর্কী বংশোদ্ভূত জার্মান মিডফিল্ডার। অবসরে যাওয়ার পর ওজিল বলেছিলেন, ‘আমি জিতলে জার্মানি জিতে যায়, আর হারলে আমি হয়ে যাই শরণার্থী।’ তবে জার্মানির গোলকিপার ও অধিনায়ক ম্যানুয়েল নিউয়ের বলেছিলেন, ডিএফবিতে কোন খেলোয়াড়ই বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে পারেন না।
×