ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধা

লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা জাতির পরম সম্পদ। অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার ক্ষতবিক্ষত বিপর্যয়ও মুক্তিকামী মাতৃভূমির এক অনবচ্ছেদ করুণ আখ্যান। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ স্বাধীনতার আগ মুহূর্তে এক মর্মস্পর্শী, বিষাদঘন অনুভব। আর সাত কোটি বাঙালীর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, বিপর্যয়, সঙ্কট দুঃসহ ঘটনার এক বিক্ষুব্ধ পালাক্রম। সিংহভাগ জনগোষ্ঠী স্বাধীনতা আর অধিকার আদায়ের লড়াইতে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একাত্ম ও সুসংহত হয়। কিন্তু কিছু মানুষ তো স্বাধীনতাবিরোধী পাক হানাদারের সহযোগী শক্তি হিসেবে তাদের হিংসাত্মক ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে অংশীদারিত্বও প্রমাণ করেছে। এমন সব ঘটনাপরম্পরা শুধু ইতিহাসই নয়, ঐতিহ্যেরও এক পর্যায়ক্রমিক সুসংবদ্ধ একাত্মতা। স্বাধীনতার ৪৯তম জন্মবর্ষে পা রেখে আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে সচেতন মানুষদের সোচ্চার হতে হয়। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার কসাই কাদের মোল্লার বিচারে ফাঁসির কাষ্ঠে জুলানোর পরও গণমাধ্যমে সংবাদ উঠে আসে শহীদ কাদের মোল্লা। এর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা তো পরের ব্যাপার, তার আগে সংবাদ মাধ্যমে অপরাধীর দুঃসাহসই শুধু নয়, তার চেয়েও বেশি স্বাধীন ভূখণ্ডে এমন জঘন্য অপরাধীকে ‘শহীদ’ নামে চিহ্নিত করে এই মহান শব্দটির মর্যাদা লুণ্ঠিত করার অধিকারও যে এখনও থাকতে পারে তাতে বিস্ময়ে বিমূঢ় হওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবাও যায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কিছু ষড়যন্ত্রকারী আজ অবধি সতর্ক ও সক্রিয় দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে আঘাত হানতে। প্রসঙ্গক্রমে বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর একটি সুললিত বাণী উল্লেখ্য- স্বাধীনতাকে প্রেমের মতো প্রতিদিন জয় করতে হয়। প্রতিবার জয়ের পর যেমন নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকি তখন যেমন প্রেমকে হারাতে হয় ঠিক সেভাবে স্বাধীনতাকেও হারাতে বসি। স্বাধীনতার যুদ্ধ কখনও শেষ হয় নাÑ সেটা নিরন্তন বহমান একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। সুবর্ণজয়ন্তীকে স্বাগত জানাতে আমরা যখন প্রস্তুত তেমন দীর্ঘ সময় অতিক্রমান্তের কালও যে নিরবচ্ছিন্ন মুক্তির প্রবাহকে হরেক রকম ক্রান্তিকাল পার হওয়া এখনও চলছে। আমরা প্রতিনিয়তই ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তিকে দৃঢ় মনোবলে ঠেকানোর প্রবল প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। সময়ের দুঃসহ প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন পড়ছে যথার্থ মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করা। বিপরীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বরূপ উন্মোচন করে তাদেরও চিহ্নিত করা। স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে ৩ বছরের মাথায় রক্তের আলপনায় আঁকা লাল-সবুজের পতাকাকে লুণ্ঠিত করা হয়। প্রায় ২১ বছর মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ চেতনা তার মর্যাদা হারাতে সব ধরনের অপকর্মের শিকার হয়। আবহমান বাংলার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে চিরতরে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রও পাকাপোক্তভাবে এগিয়ে নেয়া হচ্ছিল। কিন্তু অপশক্তি ভ্রমেও ভাবতে পারেনি ইতিহাস বিকৃতির জবাব ইতিহাসই যথার্থভাবে দিয়ে দেয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনায় সফল হলেও বিধাতার অদৃশ্য ইঙ্গিতে দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। একুশ বছর অপেক্ষা করতে হলেও ইতিহাসের যাত্রাপথ কোন এক সময় তার সুসংবদ্ধ, যথার্থ গন্তব্য খুঁজেও পায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা দৃপ্তচেতনা আর অনমনীয় দেশাত্মবোধে পিতার অসমাপ্ত কাজ স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরির ভূমিকায় নিজের সর্বশক্তি আর কর্মপ্রচেষ্টাকে নিঃশর্তে উজাড় করে দেন। একদিন সংবিধানে যে আইন পাকাপোক্তভাবে আসন গেড়েছিল তাকে বিচারিক কার্যক্রমে প্রতিরোধ করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে না- এমন আইনকে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ আমলে নিয়ে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পথে তাকে বাতিল করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পারতেন ক্ষমতার জোরে পুরনো আইনকে জিইয়ে রেখে নতুন মোড়কে পিতার হত্যার বিচার করতে। কিন্তু তিনি তা না করে বিচারিক লড়াইয়ে ২১ বছর টিকে থাকা এমন জঘন্য আইনকে বাতিল করতে সব ধরনের কর্মপ্রস্তুতি প্রয়োগ করেন। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে পুরনো সব আবর্জনা ও জঞ্জাল সাফ করতেও কম সময় লাগেনি। পিতার হত্যার সুষ্ঠু আইনী প্রক্রিয়ায় সমাধা করতে তাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষাও করতে হয়। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয়বার জনগণের রায় মাথায় নিয়ে পুনরায় শাসনক্ষমতা ফিরে পেলে শেষ অবধি অপরাধীদের শাস্তির বিধানও করতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিদিনের যাপিত জীবনের হরেক রকম বিপদ আর বিপর্যয় ও সর্বক্ষণিক তাকে আবর্তিত করে রাখে। মূল্যবান প্রাণটাও কখনও নিরাপদ ও নির্বিঘœ ছিল না। চারপাশে অগণিত শত্রু পরিবেষ্টিত বঙ্গবন্ধুকন্যা অপশক্তির সমস্ত দুরভিসন্ধিকে দুঃসাহসিক মনোবলে অতিক্রম করতে বিন্দুমাত্রা বিচলিত হতেও দেখা যায়নি। তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নিজের জীবন নয়, দেশ ও জনগণই প্রতি মূহূর্তের আরাধ্য বিষয়। দ্বিতীয়বার জনগণের রায় পেয়ে ২০০৯ সাল থেকে যে আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মসূচীতে দেশকে উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট ধারায় এগিয়ে নিতে বিভিন্ন কর্মপ্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে যা যা প্রয়োজন সবটাই করতে একেবারে দ্বিধাহীন ছিলেন। তার যথার্থ সুফল এখন দেশ আর বিশ্ব সভায় স্বীকৃত ও অভিনন্দিত। অনুন্নত আর স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের সম্প্রসারিত পরিধি সংযুক্তকরণ প্রধানমন্ত্রীর অবিস্মরণীয় সাফল্য। উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় দেশ ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে অগ্রসরমান। তার পরেও বাধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতার সূক্ষ্ম জাল বিস্তারও পাশাপাশি সমান তালে বিভ্রান্তির আবর্তে ফেলতে পিছু ছাড়ছে না। স্বাধীনতাবিরোধীরা সংখ্যায় আর শক্তিতে দুর্বল হলেও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে এতই পারদর্শী যে, বিভিন্ন সময় মাথা চাড়া দিয়েও ওঠে। অদ্ভুত সহনশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং তাৎক্ষণিক উপস্থিত পারদর্শিতায় তা সামলেও নিচ্ছেন শেখ হাসিনা। গত দুই বছরে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত, বাস্তু ও গৃহচ্যুত রোহিঙ্গারা যে মাত্রায় অনুপ্রবেশের ঢল নামায় তাতে সংশ্লিষ্ট জায়গাতে অনেক সমস্যা উদ্ভূত হলেও প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতা এবং সচেতন দায়বদ্ধতায় বেসামাল প্রতিকূল পরিবেশকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তাও বিশ্ব সভায় নন্দিত হয়েছে। এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্যই প্রধানমন্ত্রীকে ‘মানবতার জননী’ হিসেবে অভিষিক্ত করা হয় আন্তর্জাতিক সীমানায়। দেশ স্বাধীনতার মর্মবাণী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আজ সংহত এবং শক্তিশালী। ২১ বছরের দুঃশাসনের বিপণœতা কাটিয়ে দেশের অগ্রগতি আর সমৃদ্ধি একেবারে নজরকাড়া। নতুন প্রজন্মের কাছে আজ স্বাধীনতার স্থপতির মর্যাদা অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা ভবিষ্যত প্রজন্মও আজ দেশ ও জাতির অহঙ্কার। তার পরেও চেতনাবিরোধী অপশক্তির মূল উৎপাটন করা এখনও সম্ভব হয়নি। সে কাজটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্ব এবং সময়ের দাবি। যথার্থ মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের ঘাতক দালাল যারা পাকবাহিনীকে নিরন্তর সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যায় তাদের তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনে গবেষণার আওতায় এনে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা দেশ ও জনগণের কল্যাণে অত্যন্ত জরুরী। ’৭১-এর অস্থির, অস্থিতিশীল, প্রতিকূল সংগ্রামী পরিবেশে যারা জাতি ও দেশের মান রাখতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপ দেন তারা প্রিয় মাতৃভূমির অহঙ্কারই শুধু নন, সম্পদও বটে। আর যারা সেই লড়াইয়ের দুঃসহ পথযাত্রায় পাকিস্তানী দোসর হয়ে বাঙালী নিধন আর নির্যাতনের পথকে প্রশস্ত করেছিল তারা জাতির বেইমানই শুধু নয়, বিশ্বাসঘাতক চিরশত্রু হিসেবে চিহ্নিত এবং নিন্দিত। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী এসব চির শত্রুকে শনাক্ত করতে গেলে সতর্ক আর সাবধানতায় তালিকা প্রস্তুত করাও জাতীয় কর্তব্য। এখানে কোন ভুল-ভ্রান্তির অবকাশ দেশকে নতুন সঙ্কটে ফেলে দিতে সময় নেবে না। স্বাধীনতা-উত্তর মুক্ত মাতৃভূমিতে বঙ্গবন্ধু এমন সব রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটির সদস্যদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। সেই পটভূমিতে কয়েক হাজার স্বাধীনতাবিরোধী আটকও হয়। অনেকেই বিচারিক আদালতে দ-প্রাপ্ত আসামি হিসেবেও বিবেচিত হয়। সে সময় করা তালিকাটি এখন হয়তবা দুষ্প্রাপ্য হতে পারে। কারণ ২১ বছরের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির দুঃশাসনে মূল নথিপত্র নষ্ট করে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়। সেসব পাওয়া আসলেই অত্যন্ত কঠিন। তবে স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আরও সচেতন, দায়বদ্ধতায়, সুসংহত নজরদারির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দুষ্টচক্রকে জনসমক্ষে নিয়ে আসতে কর্মপরিকল্পনাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো নৈতিক দায়িত্ব। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তুত করা তালিকা নিয়ে সারাদেশে বিভ্রান্তি আর বিক্ষোভের অবতারণা হয়েছে। অনেক ভাল মুক্তিযোদ্ধার সংশ্লিষ্ট তালিকা থেকে বাদ পড়ার তথ্যও উঠে এসেছে। আবার চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের জন্য করা তালিকার অন্তর্ভুক্তি না হওয়ার অভিযোগও সংবাদ মাধ্যমে চলে এসেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও বেহাল অবস্থায়। বাংলাদেশে এখনও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন। অর্ধশত বছরের আগ মুহূর্তের স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার দুরবস্থা না হলে তাদের পক্ষেও সম্ভব অন্তত নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের চিহ্নিত করা। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাকেও আরও নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অনেক বেশি আস্থা অর্জন করাও অত্যন্ত জরুরী। প্রয়োজনে এত বড় জাতীয় দায়িত্ব সম্পাদনে অঞ্চলভিত্তিক সরাসরি পর্যবেক্ষণকে সমধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তবে একটি ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যায় হিন্দু সম্প্রদায় যাদের জীবন, মান, সম্পদ সবই হানাদারদের জিম্মিতে সেসব অসহায় মানুষ কোনভাবেই পাকিস্তানী দোসর কিংবা সহযোগী হওয়া কল্পনায়ও আসা অনুচিত। এমন সব স্পর্শকাতর চিহ্নিতকরণ সংশ্লিষ্টদের কতখানি মানসিক অস্বস্তিতে ভোগাবে সেটাও ভাবতে হবে দায়িত্ব নিয়ে। খেয়াল-খুশিমতো কোন তালিকা কোনভাবেই গ্রাহ্য হবে না সেটা যেমন সত্যি, পাশাপাশি অসংলগ্ন ভুল ও অযৌক্তিক তথ্যে পুরো দেশ ও জাতির দুর্ভোগকে এড়ানো সম্ভবই নয়। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক ও অবিচ্ছিন্ন সুতায় গাঁথা। এটাই আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। লেখক : সাংবাদিক
×