ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের তথ্য মিলেছে

সগিরা মোর্শেদ হত্যার সাত প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯

সগিরা মোর্শেদ হত্যার সাত প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ত্রিশ বছর পর উন্মোচিত হওয়া বহুল আলোচিত সগিরা মোর্শেদ হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একজন নয়, সাত জনের সন্ধান পেয়েছে পিবিআই। এক রিক্সাচালকের দেয়া জবানবন্দীর সূত্র ধরে হত্যাকা-ের রহস্যের জট খুলে। এদিকে ছিনতাই নাটক সাজিয়ে সগিরাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ব্যবহৃত সেই মোটরসাইকেলটি সম্পর্কেও তথ্য মিলেছে। হত্যাকারী সগিরাকে হত্যার পর এক ড্রাইভারকেই মোটরসাইকেলটি দিয়ে দেয়। মূলত আলামত গায়েব করে দিতেই পরিকল্পিতভাবে মোটরসাইকেলটি দিয়ে দেয় খুনী। সেই ড্রাইভারও শনাক্ত হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই তাকে ডাকা হবে। তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হবে। মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে জানান, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে মোসাম্মৎ সগিরা মোর্শেদ সালাম (৩৪) তার ভিকারুননিসা স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে সারাহাত সালমাকে (৮) আনতে বাসা থেকে বের হন। স্কুলের সামনে পৌঁছা মাত্রই অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা তার হাতে থাকা বালা টেনে খুলে নেয়ার চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তাকে গুলি করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সগিরার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সগিরার স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ১৯৯০ সালে ডিবির পরিদর্শক আবদুল জলিল শেখ ছিনতাইকারী মিন্টুর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। বিচার চলাকালে নানাভাবে সাক্ষীদের জবানবন্দীতে মারুফ রেজার নাম আসে। মামলাটি ২৬ তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করেন। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ চলতি বছরের ১১ জুলাই ক্রিমিনাল মিস মামলাটি খারিজ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেয়। মামলাটির তদন্তের এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে ঘটনাটি ছিনতাই নয়, পরিকল্পিত হত্যাকা-। হত্যাকা-ে জড়িতদের নামও উঠে আসে। চলতি বছরের ১০ নবেম্বর মামলার সন্দেহভাজন আসামি আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে (৫৯) ঢাকার রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক গত ১২ নবেম্বর ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে (৬৪) ধানম-ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। এদের দেয়া তথ্য মোতাবেক গত ১৩ নবেম্বর মোঃ মারুফ রেজাকে (৫৯) বেইলি রোডে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা আদালতে সগিরা হত্যায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। পিবিআই প্রধান জানান, সগিরা হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আসামি ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন (৬৪)। আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান (৫৯) ও মোঃ মারুফ রেজা পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যায় অংশ নেয়। পারিবারিক কলহের জেরে হত্যাকা-টি ঘটে বলে জবানবন্দী এবং তদন্তে বেরিয়ে আসে। তদন্ত মোতাবেক, মামলার বাদী সগিরার স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী ও তার অপর দুই বড় ভাই সামছুল আলম চৌধুরী, মেজ ভাই ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী। সগিরা ও আব্দুস সালাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে লেখাপড়া করার সময় তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর তাদের বিয়ে হয়। ১৯৮০ সালে সগিরা ও তার স্বামী শিক্ষকতা করার জন্য সপরিবারে ইরাক চলে যান। ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণে ১৯৮৪ সালে তারা আবার দেশে ফেরেন। বসবাস শুরু করেন পৈত্রিক বাড়ি রাজারবাগ পেট্রোল পাম্পের কাছের দোতলা বাড়িতে। সঙ্গে তাদের তিন কন্যা সারাহাত সালমা চৌধুরী (৮), সামিয়া সারোয়াত চৌধুরী (৫) ও সিফাত আবিয়া চৌধুরী (২) ছিল। আর সগিরার ভাসুর ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী বারডেম হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে কর্মরত। তিনি ১৯৮০ সালে সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে বিয়ে করেন। ১৯৮০ সালের ২২ জুন এই দম্পতি লিবিয়ায় চলে যান। আবার ১৯৮৫ সালে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ দেশে ফেরেন। বসবাস শুরু করেন ৯৫৫ আউটার সার্কুলার রোডের রাজারবাগের ওই বাড়িতেই। যে বাড়িতে সগিরারা দ্বিতীয় তলায় বসবাস করত। পিতা মাতা ছাড়াও আরেক ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে নিচতলায় একত্রে কিছুদিন বসবাস করেন। তারপর বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় আব্দুস সালাম চৌধুরীর বাসায় একটি রুমে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী ও তার পরিবার। এক বাসায় থাকার কারণে ডাঃ হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে সগিরার ঝামেলা হতে থাকে। মাস ছয়েক পরে ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে বাড়িটির তৃতীয় তলার কাজ শেষ হয়। ডাঃ হাসান আলী পরিবার নিয়ে তৃতীয় তলায় ওঠেন। তৃতীয় তলা থেকে প্রায়ই ময়লা ফেলা হতো। এ নিয়ে ডাঃ হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনের সঙ্গে সগিরার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তা এক পর্যায়ে চরম আকার ধারণ করে। সেই দ্বন্দ্ব আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে নিহত সগিরার গৃহকর্মী জাহিনুরের থু থু ফেলার ঘটনায়। একদিন ছাদ থেকে কাপড় আনার সময় মনের অজান্তে জাহিনুর ডাঃ হাসান আলীর ফ্ল্যাটের সামনে থু থু ফেলে। এ নিয়ে জাহিনুরকে নিয়ে বাসায় সালিশ দরবার হয়। জাহিনুরকে বেধড়ক মারধর করে হাসান আলী ও তার পরিবার। এই পরিবারের ধারণা সগিরার নির্দেশ মোতাবেক জাহিনুর তাদের বাসার সামনে থু থু ফেলেছে। এরপর থেকেই সগিরাকে শায়েস্তা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন মাহমুদা শাহীন। ডাঃ হাসান আলী ও তার স্ত্রী শাহিন সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য পরিকল্পনা করেন। ডাঃ হাসান আলীর রোগী ছিলেন তৎকালীন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার নামকরা সন্ত্রাসী মারুফ রেজা। রেজা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব) মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে। ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফ রেজাকে ২৫ হাজার টাকা দেয়। ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজওয়ানকে মারুফ রেজার সহযোগী হিসেবে কাজ করতে বলেন। আনাস মাহমুদ সগিরাকে চিনতেন। ঘটনার দিন ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজওয়ানকে দুপুর ২টার দিকে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলেন। অপর আসামি মারুফ রেজা মোটরসাইকেলযোগে মৌচাক মার্কেটের সামনে যায়। ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালককে মারুফ রেজার সঙ্গে গিয়ে সগিরাকে শায়েস্তা করতে বলেন। আনাস মাহমুদ ও মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে করে সিদ্ধেশ^রী কালিমন্দিরের গলিতে যায়। তারা সগিরাকে রিক্সাযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে যেতে দেখে পিছু নেয়। স্কুলের সামনে মারুফ রেজা মোটরসাইকেল দিয়ে সগিরার রিক্সা আটকায়। মারুফ রেজা সগিরার হাতব্যাগ নিয়ে নেয়। আর হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি খুলে নেয়ার চেষ্টা করে। সগিরা আনাস মাহমুদকে চিনে ধমক দেন। ধমক দেয়ার পর মারুফ রেজা ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে সগিরাকে কোমর থেকে রিভলভার বের করে গুলি করে। প্রথম গুলিটি সগিরার হাতে লাগে। এরপর সে সগিরাকে আরও একটি গুলি করে। গুলিটি বাম বুকে বিদ্ধ হয়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সগিরার মৃত্যু হয়। মারুফ রেজা আরও দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে মোটরসাইকেলযোগে দু’জনই পালিয়ে যায়। পিবিআই প্রধান জানান, হত্যাকা-ের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল রিক্সাচালক। যে রিক্সায় সগিরা ছিল। ওই রিক্সাচালক ছালাম মোল্যাকে শেষ পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়। খুনের ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ২৬ বছর। পরে রিক্সাচালক সগিরা খুনের বিষয়ে আদালতে জবানবন্দী দেন। মামলাটির তদারকি কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহাদাত হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, শায়েস্তা করার দায়িত্ব পাওয়ার পাশাপাশি ২৫ হাজার টাকা পেয়ে মারুফ রেজা সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। এজন্য সে যাত্রাবাড়ী-শ্যামপুর এলাকার ওই সময়ের বহুল আলোচিত সন্ত্রাসী হরর মুন্নার কাছ থেকে একটি রিভলভার ভাড়া করে। সেই রিভলভার দিয়ে সগিরাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশে ছিনতাই নাটক করার চেষ্টা করে। সগিরা বাধা দিলে মারুফ রেজা সগিরাকে এক পর্যায়ে গুলি করে। সেই গুলিতে সগিরার মৃত্যু হয়। ওই সন্ত্রাসী পরবর্তীতে র‌্যাবের অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। হত্যার পর মারুফ রেজা মামলার আলামত হিসেবে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি তার এক পরিচিত ড্রাইভারকে দিয়ে দেয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটির অধিকতর তদন্ত চলছে। সেই তদন্তের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ড্রাইভারকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আশা করছি চলতি সপ্তাহেই সেই ড্রাইভারকে ডাকা হবে। তার জবানবন্দী রেকর্ড করা হবে। এই কর্মকর্তা আরও জানান, রিক্সাচালকের তথ্য মোতাবেক মামলাটির অনেক অজানা রহস্য সামনে চলে আসছে, বর্তমানে হত্যাকা-ের সাত জন প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য মিলেছে। এমন কি প্রত্যক্ষদর্শীরা আদালতে জবানবন্দীও দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দীতেও সগিরা মোর্শেদ যে পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার, তা একেবারেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
×