ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁচার তাগিদে ওরা অপরাধমূলক নানা কাজে জড়ায়

পথশিশুদের ৮৫ ভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে মাদকে আসক্ত

প্রকাশিত: ১০:২২, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

 পথশিশুদের ৮৫ ভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে মাদকে আসক্ত

নিখিল মানখিন ॥ দুটি শিশু সন্তান নিয়ে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় ভিক্ষা করে রোকেয়া বেগম (৩৬)। বড় ছেলে ইকবালের বয়স সাড়ে পাঁচ বছর, ছোট হেলাল চারে পা দিয়েছে। অনেক আগেই তাদের ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছেন বাবা উমর আলী। বাংলামোটর পরীবাগে রাস্তার ফুটপাথে পলিথিনের কুঁড়েঘরে থাকে তারা। দোকানদার ও পথচারীদের কাছে রোকেয়া বেগম ভিক্ষা চাইলে শিশু দুটিও হাত পাততে শুরু করে। তাদের হাতে টাকাও তুলে দেন পথচারীদের কেউ কেউ। কাউকে খেতে দেখলেই দুটি শিশু চাইতে থাকে। অনেকে খাবারের কিছু অংশ তাদের খাওয়ান। অজান্তেই মায়ের সঙ্গে ভিক্ষাবৃত্তি করে যাচ্ছে ইকবাল ও হেলাল। এই শিশু দুটির মতো দেশের অসংখ্য পথশিশু এমন জীবন কাটায়। তাদের ভবিষ্যত জীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। অনেকেই নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। পথশিশুরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য পুষ্টিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এদের নেই নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা। খোলা আকাশ, পার্ক, ফুটপাথ, রেলস্টেশন, ফেরিঘাট-লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা বাস স্টেশনই এদের থাকার জায়গা। ওরা সাধারণ শিশুদের মতো নয়। মায়ের স্নেহ, বাবার আদর ওদের ভাগ্যে কমই জোটে। কেউ হয়তো জন্মের পর দেখেনি বাবাকে। একটু বুঝে ওঠার পর থেকে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে জীবিকার খোঁজে। আরেকটু বড় হলে মা এক পথে, ওরা অন্য পথে ঘুরতে থাকে পেটের দায়ে। এভাবে জীবন তাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে মাদকে আসক্ত। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সোস্যাল এ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রামের (সিপ) ‘পথশিশুদের অমানবিক জীবন ও বিভিন্ন সমস্যা শীর্ষক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, অর্থের অভাবে পথশিশুদের ৭৫ ভাগ ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না। অসুস্থ হলে তাদের প্রায় ৫৪ ভাগের দেখাশোনার কেউ নেই। পথ শিশুদের প্রায় ৪০ ভাগ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না, ৩৫ ভাগ খোলা জায়গায় পায়খানা করে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠে। রিপোর্টে বলা হয়, আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে পথশিশুর সংখ্যা। দেশে বর্তমানে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখ। অথচ ক্রমবর্ধমান এসব শিশুর কল্যাণে নেই কোন নীতিমালা। সরকার ঘোষিত ভিশন ’২১ অর্জন করতে হলে এখনই এ শিশুদের কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন। পথশিশুদের প্রায় ৪৪ ভাগ ধূমপান করে, রাতে ঘুমানোর জন্য ৪১ ভাগ শিশুর কোন বিছানা নেই। কোন মতে খাবার জোগাড় করতে ৮০ ভাগ পথশিশু বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। ৮৪ ভাগের নেই কোন শীতবস্ত্র। যুগোপযোগী নীতিমালা না থাকায় এই ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল ধারায় আনার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। পথশিশুদের উন্নয়নে সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ থাকলেও তার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শিশু। পথশিশুদের উন্নয়নে মনোযোগী না হলে, সরকার ঘোষিত রূপকল্প ’২১ বাস্তবায়ন কঠিন হবে। বিগত সরকার আমলে পথশিশুদের উন্নয়নে একটি কার্যকর ও পরিপূর্ণ নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। শতকরা ৩৪ দশমিক ৮ ভাগ পথশিশু কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করে এক থেকে ৬ মাস। ২৯ ভাগ স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আর ৩৩ ভাগ পাহারাদারদের কারণে। এরা ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটালেও প্রায় ৫৬ ভাগ শিশুকে মাসিক ১৫০-২০০ টাকা নৈশপ্রহরী বা স্থানীয় মস্তানকে দিতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানীর একটি বড় সমস্যা পথশিশু। এসব পথশিশু পথে পথে থাকে। পথেই এদের বাস। অনেকেই মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন। পথে কর্মরত পথশিশু যারা রাস্তায় জীবিকা নির্বাহ করে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরিবারে ফিরে যায়। পথে পথে সপরিবারে বাস করে পথশিশু যারা পরিবারসহ পথে বাস করে। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি, রাস্তার ফুটপাথ, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল ইত্যাদিতে এদের বসবাস। অবহেলা, অনাদর, অযতœ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠে। তাদের জীবনের মৌলিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। অনেকে স্কুলে গেলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ে। জীবন-জীবিকার তাগিদে তাদের অনেক ধরনের কাজের সঙ্গেই জড়িত হতে হয়। ভিক্ষাবৃত্তি, ফুল বিক্রি, বিভিন্ন জিনিসপত্র রাজপথে ফেরি করা ছাড়াও গার্মেন্টস, বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োজিত আছে ভাগ্য বিড়ম্বিত এসব শিশু। এ ধরনের বেশিরভাগই শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের একটি বিরাট অংশজুড়ে আছে পথশিশু। তাদের বাদ দিয়ে উন্নয়নের কথা চিন্তা করা যায় না। শুধু সরকার, প্রশাসন, সংস্থাই নয়, আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়বদ্ধতা আছে বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। জীবনের মানোন্নয়নে উদ্যোগ বাড়ছে পথশিশুদের জন্য এগিয়ে আসছে সরকারী-বেসরকারী সংস্থা। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমান সরকার ৪০ হাজার পথশিশুকে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে আট হাজার শিশুকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। তারা নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। মন্ত্রণালয় তাদের লেখাপড়ার তদারকিও করছে। পর্যায়ক্রমে সুবিধাবঞ্চিত সব শিশুকে এ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এদিকে সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউসেফের মতো কিছু সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীরা সীমিত পরিসরে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে। পথশিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা কাজের সুযোগও করে দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে টাকা দিয়েও সহায়তা করছে। এ ছাড়া পথশিশুদের স্বপ্ন পূরণের জন্য অপরাজেয় বাংলাদেশ, পদক্ষেপ, বার্ড, বিকশিত বাংলাদেশ, টিএসটিসি, সুইশ বাংলাদেশ, জাগো ফাউন্ডেশন, একমাত্রা, এএসডিসহ বেশ কয়েকটি এনজিও কাজ করছে। এসব এনজিওর মধ্যে কিছু এনজিওতে ডে-নাইট উভয় সময়ই পথশিশুদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অধিকাংশ পথশিশুই এসব ডে কেয়ার সেন্টারের কথা জানে না। অপরাজেয় বাংলাদেশ পথশিশুদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সহায়তাসহ নানা রকমের পড়াশোনা ও খেলাধুলায় নিয়োজিত করে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছে।
×