ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঝপ ঝপাঝপ পলো বাও মজার মজার মাছ খাও

প্রকাশিত: ১০:০৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

ঝপ ঝপাঝপ পলো বাও মজার মজার মাছ খাও

সমুদ্র হক ॥ উত্তরবঙ্গের হাজার বছরের বৈচিত্র্যের জীবন সংস্কৃতির কত যে উৎসব। শীতের শেষ বিকেলের লাজুক আলোয় গোধূলিবেলার হলদেটে রূপও কুয়াশায় ঢেকে দেয়। শিশিরভেজা গল্পকথার শেষ নেই। ভাতে-মাছে বাঙালীর শীতের প্রাক্কালটি আসে নতুন ধানের ম ম গন্ধে নবান্নের নৃত্য ছন্দে। কত তাল কত সুর “ও ধান ভানিরে ঢেকিত পার দিয়া...’। গাঁও গেরামে কিষাণ বধূর সুরের এই শোরগোল চাপা দিতে পারেনি ‘ঝপ ঝপা ঝপ পলো বাও মজার মজার মাছ খাও...’। নবান্নে নতুন চালের ভাত রান্না হবে আর মাছ খাওয়া হবে না তা কি হয়! বাঙালীর মাছ ধরার আনন্দ নিয়ে এসেছে পলো। বাঁশের কাঠিতে বানানো পলো দিয়ে দলবেঁধে মাছ ধরার আয়োজন পরিচিতি পেয়েছে বাউত উৎসবে। এই উৎসবের হরেক নাম। বগুড়ার যমুনা ও বাঙালী তীরের গ্রামগুলোতে নাম ‘বইত নামা’। রংপুর অঞ্চলে চেংরাগুলার বত্যে নাচা। কোথাও কাদা প্যাঁকে পলই লাচ। তবে সব ছাপিয়ে চলনবিল অঞ্চলের নাম বাউত বা বাউত উৎসব পরিচিতি পেয়েছে বেশি। বাউত উৎসব হলো : শীতের শুষ্ক মৌসুম ঘনিয়ে এলো নদ-নদী, খালবিলে ও নিচু এলাকার পানি অনেক কমে যায়। ভোরে ঘুম থেকে জেগে সকালে বিলের হাঁটুপানি ও কোমর পানিতে নেমে কাদার মধ্যে দলবেঁধে পলো ঠেসে মাছ ধরার মহাআনন্দ বহুকালের। পলো বাপলই, কোথাও আবার পলি নামে পরিচিত এই মাছ ধরার উৎসব। পলো হচ্ছে মাছ ধরার এক ধরনের উপকরণ। বাঁশ-বেতের কাঠিতে নিচের দিকে গোল উপরের দিকে কিছুটা ভাঁজ হয়ে চারদিকে বের দিয়ে উপরে হাত ঢোকানোর অল্প গোল করে রাখা। প্রায় চার ফুট উচ্চতার ও ৪/৫ ফুট ঘেরের (ব্যাসার্ধ) এই পলো নিয়ে বিলের মধ্যে গিয়ে কাদাপানিতে গেড়ে মাছ ধরা। পলোতে মাছ বন্দী হলে উপরের গোল ফুটো দিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে মাছ ধরে খাঁচায় ভরা। যে খাঁচায় মাছ ধরে রাখা হয় তার নাম খলই (কোথাও নাম খালুই বা খলি)। বাঁশের তৈরি ছোট খলই গ্রামের কিষাণ বাড়ির ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়। বাউত উৎসবে দলবেঁধে যাওয়ার সময় হাতে পলোর সঙ্গে কোমরে থাকে খালই, অবশ্য এলুমিনিয়ামের। বর্তমানে পাতিল মাছ ধরার খাঁচা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাউত উৎসব শুরুর দিনাকয়েক আগে গ্রামে প্রচার করা হয়। অতীতে ভোটের প্রচারের মতো চোঙ্গা ফুঁকে বাউত উৎসবের দিনক্ষণ জানিয়ে দেয়া হতো। এখন চোঙার বদলে এসেছে হ্যান্ডমাইক। বাউত উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা প্রস্তÍুতি নেয়। নির্দিষ্ট দিনে বিভিন্ন গ্রামের যুবক, তরুণ, মধ্যবয়সী বা দলবেঁধে হৈহুল্লোড় করতে করতে নদী ও বিলের দিকে ছোটে। ঢাকঢোল বাজানো হয়। মনে হবে মানুষের ঢল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকের তালে নেচেগেয়ে কাদাপানিতে পলো ঠেসে মাছ ধরতে ধরতে এগিয়ে যাওয়া। ছোট, মাঝারি ও বড়মাছ বুঝতে পারে কিভাব আক্রমণ চালাচ্ছে। ছুটতে থাকে এদিক-সেদিক। চারদিক থেকে ঘিরে পালাবার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। শত শত পলোর মধ্যে আটকে যায় মাছ। ছোট রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, শোল, গজার, টাকি, কাকলি, শিং, মাগুর, ভ্যাদা, কৈ, খলসে, পুঁটি, সরপুঁটিসহ সব দেশী মাছ মেলে। শিশু-কিশোররা ঠেলা জাল নিয়ে এগোতে থাকে। ঘরে ফিরে একাধিক খালই ভর্তি মাছ আঙিনায় ঢেলে গায়ের বধূদের মাছ কাটার আনন্দই আলাদা। বাউত উৎসবে যাওয়ার সময় বাড়ির লোকজন প্রস্তÍুতি নেয়, ভাতে-মাছে বাঙালীর খাবার আজ পূর্ণতা পাবে। রান্না ছাড়াও মাছ ভাজা, মাছের ঝোল, চর্চরি, ভর্তা-কত কি? গরম ভাতের সঙ্গে মাছের এসব খাবার (বর্তমান নাম রেসিপি) জিহ্বায় লেগে থাকে। অতীতে উৎসবের দিনে মেয়েজামাইর বাপের বাড়িতে নাইওর মাছ ধরার এই পলো উৎসবকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে নানা ধরনের পলো নেমেছে। বাউত উৎসবে পলো,ঠেলাজাল,পলোজাল, চাটজালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ পাওয়া যায়। তবে উৎসবে পলো দিয়েই বেশি মাছ ধরা হয়। মাথায় গামছা,লুঙ্গি মালকোচা করে পরে উৎসবে নামে সবাই। বর্তমানে কেউ কেউ প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুঁজে বিলে নামে। তবে মাথায় গামছা বাঁধা চিরন্তন হয়েই আছে। বাউত উৎসবে আগে শুধু শৌখিন শিকারিরা মাছ ধরতে নামত। পরে তরুণ ও মধ্যবয়সীরা যোগ দিতে থাকে। কখনও গ্রামের বয়স্ক লোকজনও উৎসবে ভাগ বসায়। কেউ বারণ করে না। তরুণরা তাদের চাচা, জ্যাঠা, কাকা-দাদা-নানা সম্বোধন করে বলে, শীতের মধ্যে টিকতে পারবা তো! বয়স্করাই বা কথায় হার মানবে কেন। ফোঁকলা দাঁতে মিষ্টি হাসিতে বলেন, ‘বয়সকালে বিলে কত নামছি। তোরা তো সেদিনের ছল’। বাউত উৎসব সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলে। গেরস্ত, ধনী, গরিব সবাই বছরের এই একটি সময়ে পলো উৎসবে যোগ দিয়ে বাঙালীর চিরন্তন ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। পাবনার গ্রামের বাজিত বাড়িতে পলো আছে। পলো শুধু বাউত উৎসবের জন্য নয়, মুরগিছানা যাতে দৌড়ে কোথাও না যেতে পারে সেজন্যও বাড়িতে পলো রাখা হয়। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার পুংরুহালি মন্ডুমালা গ্রামের প্রবীণ আব্দুর রহমান (৭৬) বললেন- বিলে সেই মাছ আর নেই। সেই বাওয়া নেই। যেটুকু ছিল তাও চলে গেছে প্রভাবশালী সেঁতিওয়ালাদের তোপে। স্থানীয় কথায় সেঁতিওয়ালা হলো বিলের মাছ জোর করে নেয়া মহাজন। তারা একশ্রেণীর তরুণকে টাকা-পয়সা দিয়ে হাত করেছে। এরাই বিলের মাছ লুট করে। লোকজন সেঁতিওয়ালাদের বলে ‘মাছখেকো’। চাটমোহর উপজেলার গফলচড়া গ্রামের রথীন্দ্রনাথ বললেন, পলো বাওয়া হয় তবে তেমন মাছ মেলে না। ‘মাছখেকোদের’ জুলুমের কথা তিনিও বললেন। খালিশাগাড়ির বিল, জিয়েলগাড়ি, ডিকসির বিল, শাপলার বিল, বিলকুড়ালিয়া ও ছোট নদী বড়াল, চিকনাই,গুমানি, করতোয়ায় বাউত উৎসব চলনবিল অঞ্চলের ঐতিহ্য, টিকে আছে বহুকাল ধরে।
×