ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারে তিন মাস বিদ্যুতবিহীন ৪০ গ্রাহক

বিদ্যুত বিভাগের কারসাজি ॥ জিম্মি ফ্ল্যাট মালিকরা

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

বিদ্যুত বিভাগের কারসাজি ॥  জিম্মি ফ্ল্যাট মালিকরা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ কক্সবাজারের কলাতলীতে পিডব্লিউডির আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে দেলোয়ার প্যারাডাইস নামের আবাসিক হোটেল। ভূমি মালিকের বিরুদ্ধে পিডিবির ১১ কেভি’র আওতায় থাকা মিটারে রিডিং জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ও বিদ্যুত বিভাগের আইন অমান্য করেছে ভূমি মালিক দেলোয়ার হোসাইন এমন অভিযোগ পিডিবির কয়েক কর্মকর্তার। ১০তলা ভবনের ৭২টি ফ্ল্যাটে চাইল্ড মিটার না লাগানোর পেছনে কক্সবাজার পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীর কারসাজি রয়েছে বলে খোদ পিডিবি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন। সাব মিটার দিয়ে ফ্ল্যাট মালিক থেকে গড় বিল আদায়ে সহায়তা করেছে উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাহবুব আলম। চট্টগ্রামস্থ বিদ্যুত ভবন থেকে নেয়া বিবরণী বিদ্যুত বিলের তথ্য থেকে অভিযোগ উঠে এসেছে পিককে অফপিক আর অফপিককে পিক দেখিয়ে সরকারী রাজস্ব আত্মসাত করছে ভূমি মালিক। ফ্ল্যাট মালিকরা তথ্য ফাঁস করায় ভূমি মালিক দেলোয়ার হোসেন মাদার মিটার থেকে ৪০ ফ্ল্যাট মালিকের সাব মিটারে বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন গত ২ অক্টোবরে। এই ভবনের গত দুই বছরের পিডিবির বিবরণী বিল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জালিয়াতি করতে গিয়ে মিটার রিডার পিক আওয়ারে কম আর অফপিক আওয়ারে বিল বেশি দেখিয়েছে। সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিতে ৩৮০ কিলোওয়াট বরাদ্দের আওতায় থাকা মাদার মিটারের সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের বিলে পিক আওয়ারে ৭ হাজার ইউনিট ও অফপিক আওয়ারে ১০ হাজার ইউনিট বিদ্যুতের ব্যবহার দেখানো হয়েছে। চলতি বছরের আগস্টে ২ লাখ ৪১ হাজার টাকা, জুলাই মাসে মাত্র ১৫ হাজার ৪১৮ টাকা ও জুন মাসে ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৭ টাকা বিল বকেয়া দেখানো হয়েছে। আবার সেপ্টেম্বর মাসের বিল দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ২৮৩ টাকা। মোট ৪ মাসের বিল দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৫১ হাজার ২১২ টাকা। জালিয়াতির কারণে প্রশ্ন উঠেছে, এক মাসের বিলের সঙ্গে অন্য মাসের বিলের কোন সামঞ্জস্যতা নেই। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২ বছরের বিল বিশ্লেষণে দেখা গেছে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে বিল মাত্র ২৪ হাজার ৪৯১ কিন্তু ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের বিল ৯৭ হাজার ৫২৬ টাকা। ২০১৮ সালের জুলাই মাসের বিল ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩২৬ টাকা ও ২০১৯ সালের জুলাই মাসের বিল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯১৬ টাকা। এদিকে, গত ২অক্টোবর থেকে ৪০টি ফ্ল্যাটে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফ্ল্যাট মালিকদের ভোগান্তিতে ফেলে ফ্ল্যাট হাতিয়ে নিতে জিম্মি করেছে এই প্রতারক। আবাসিক এলাকায় বিলাসহুল হোটেল নির্মাণ করে কক্ষ হিসেবে ভাড়া দিচ্ছে প্রতারক দেলোয়ার। এমনকি ফ্ল্যাট মালিকদের ৪০টি ফ্ল্যাটও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চায় ভূমি মালিক। অপরদিকে, ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে ফ্ল্যাটের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে দেয়ার পরও রেজিস্ট্রেশন না দিয়ে নানা চক্রান্ত শুরু করেছে প্রতারক চক্র। বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ফলে ব্যবহারকারীরা বিদ্যুত ব্যবহার করতে পারছে না ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। এ বিষয়ে গত ৯ অক্টোবর জেলা প্রশাসনে অভিযোগ করা হলে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কক্সবাজার বিদ্যুত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বিধি মোতাবেক বিদ্যুত সংযোগ পুনর্স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে গত ১৪ অক্টোবর। এ নির্দেশনার প্রেক্ষিতে নির্বাহী প্রকোশলী এ সংযোগ স্থাপনের জন্য উপসহকারী প্রকৌশলী মাহবুব আলমকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসন থেকে প্রেরিত অভিযোগকারীর অভিযোগে নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী স্বাক্ষর করলেও এই দুই কর্মকর্তা প্রতারকের পক্ষ নিয়ে আদৌ কোন সংযোগ স্থাপন করেনি বলে অভিযোগ করেছেন ৪০ ফ্ল্যাটের মালিক। এদিকে এ ব্যাপারে কক্সবাজারে এসপি বরাবর গত ৯ অক্টোবর অভিযোগ করা হলেও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল কাদের গণি জনকণ্ঠকে জানান, এইচটি লাইন থেকে মাদার মিটারের আওতায় চাইল্ড মিটার স্থাপনের নিয়ম রয়েছে। দেলায়ার হোসেন কি কারণে ৪০টি ফ্ল্যাটের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন এ বিষয়ে তিনি উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাহবুব আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। মোবাইলে নির্বাহী প্রকৌশলীর সামনেই মাহবুব আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভূমি মালিকের অনুমতি ছাড়া চাইল্ড মিটার লাগাবে না পিডিবি। কিন্তু এই আবাসিক ভবনের বিপরীতে মাদার মিটারের আওতায় সাব-মিটার লাগিয়েছে। মাদার মিটার স্থাপনে ভূমি মালিককে আবেদন করতে হবে। বিদ্যুত ভবন চট্টগ্রামের দফতর সূত্রে জানা গেছে, মাদার মিটারের আওতায় চাইল্ড মিটার লাগানোর নিয়ম রয়েছে। প্রতিটি চাইল্ড মিটারের আওতায় সরকার রাজস্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু দেলোয়ার হোসেন সাব মিটার বসানোর কারণে সরকার মিটারের লাইনরেন্ট যেমন পাচ্ছে না তেমনি ভ্যাটও আদায় করতে পারছে না। আবার এসব ফ্ল্যাট মালিকরা যে পরিমাণ বিদ্যুত ব্যবহার করত তা থেকেও সরকার রাজস্ব আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে সরকার ত্রিমুখী রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে, ভূমি মালিক সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিতে ও নিজের আয় বাড়াতে জালিয়াতির উদ্দেশ্যে সাব-মিটার বসিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পার্শ্ববর্তী ভবন মালিকরা। আবার আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক হোটেল পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে এই ধুরন্ধরের বিরুদ্ধে। পিডিবির এক উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে মাসিক মোটা অঙ্কে ম্যানেজ করে নিয়ে পিক আওয়ারে কম ও অফপিক আওয়ারে রিডিং বেশি দেখিয়েও সরকারের রাজস্ব আত্মসাত করার মতো অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে, ভবনে মোট ৭২টি ফ্ল্যাট থাকলেও একটি মাদার মিটারের আওতায় ৭২টি সাব মিটার লাগানো হয়েছে । কিন্তু এই ভবনে ৭২টি সাব মিটার লাগিয়ে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে গড় বিল আত্মসাত করেছেন ভূমি মালিক দেলোয়ার হোসেন। অথচ গত পাঁচ বছর ধরে এসব সাব মিটারের আওতায় হাতে লিখা বিদ্যুতের গড় বিল আদায় করেছেন এই প্রতারক। কিন্তু এই অর্থ ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিদ্যুতের সরকারী বিল প্রায় সাড়ে ৬ লাখ বকেয়া ছিল গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ বিষয়ে জনকণ্ঠে সম্প্রতি সংবাদ প্রকাশের পর বকেয়ো বিল দ্রুত পরিশোধ করেছে কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, কক্সবাজারের কলাতলীতে পিডব্লিউডির আবাসিক এলাকার ‘এ’ নং ব্লকে ১৩নং হোল্ডিংয়ে গড়ে উঠেছে কনফিগার দেলোয়ার প্যারাডাইস নামের বিলাসবহুল আবাসিক ভবন। কনফিগার ডেভেলপারর্স লিমিটেড এই ভবন নির্মাণ করেছে। এ ভবনে নিচতলার পার্কিং স্পেস ছাড়াও মোট ৭২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এরমধ্যে ভূমি মালিক হিসেবে দেলোয়ার হোসাইন ৩২টি ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান কনফিগারের মালিক খোরশেদ আলম অপুর ৪০টি ফ্ল্যাটের মালিকানা রয়েছে। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের ৪০টি ফ্ল্যাট সাফ কবলা মালিকানায় বিক্রি করেছেন। কিন্তু সময়ের নয়-ছয় দেখিয়ে নিরবছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের জন্য বসানো হয়েছে ১১ কেভির এইচটি লাইনের পাওয়ার স্টেশন। গ্রাহক নং ৮৩৮১২৮৮৩ এর আওতায় বসানো হয়েছে একটি মাদার মিটার যার নম্বর ২১৪০৮৩৯২৯ই।
×