ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা আব্দুর রাজ্জাক

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

 গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা আব্দুর রাজ্জাক

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১১ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জননেতা আব্দুর রাজ্জাক লন্ডনে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ৬৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি লন্ডনের কিংস হসপিটালে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডাক্তারদের পরামর্শে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়ার পর ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৫০ মিনিটে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক এবং দুই পুত্র নাহিম রাজ্জাক ও ফাহিম রাজ্জাক। ২৫ ডিসেম্বর দুপুর সোয়া ১২টায় বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে লন্ডন থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় আবদুর রাজ্জাকের মরদেহ। সেখান থেকে নেয়া হয় তার গুলশান বাসভবনে। প্রথম জানাজা বেলা ৩টার পর পরই জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে আব্দুর রাজ্জাকের দ্বিতীয় জানাজা জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। ২৬ ডিসেম্বর ১০টায় হেলিকপ্টারযোগে আব্দুর রাজ্জাকের মরদেহ তার জন্মস্থান শরীয়তপুরের ডামুড্যায় নেয়া হয়। সেখানে তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠানের পর ঢাকায় এনে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আব্দুর রাজ্জাক তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালীর স্বাধিকার, স্বাধীনতা, শান্তি ও সামাজিক মুক্তির আন্দোলনে। ছাত্রজীবন থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রথম সারির সংগঠক ও নেতা। রাজনীতিবিদ আব্দুর রাজ্জাক শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামে ১৯৪২ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইমাম উদ্দিন এবং মাতার নাম বেগম আকফাতুন্নেছা। তিনি ১৯৫৮ সালে ডামুড্যা মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং পরে মাস্টার্স পাস করেন। এরপর তিনি এলএলবি পাস করেন এবং ১৯৭৩ সালে আইনজীবী হিসেবে বার কাউন্সিলর নিবন্ধিত হন। আব্দুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে। তিনি ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র-ছাত্রী সংসদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫-৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পর পর দুই বার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ থেকে ৭২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের প্রধান ছিলেন। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৪ সালে প্রথম তিনি গ্রেফতার হন এবং ৬৫ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। কারাগার থেকেই মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর ৬ দফা আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার (মুজিব বাহিনীর ৪ সেক্টর কমান্ডারের একজন) ছিলেন। তিনি মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষকও ছিলেন। তিনি দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। মুজিব বাহিনী গঠনে অন্যতম রূপকার ছিলেন। মুজিব বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস (Bangladesh Liberation Forces - BLF) (বাংলা : বাংলাদেশ স্বাধীনতা বাহিনী)- তিনি ছিলেন ৭১-এর ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকরা হত্যা করার পর আব্দুর রাজ্জাক পুনরায় গ্রেফতার হন। ৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দী ছিলেন। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৭ সালে আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেফতার করা হয়। আব্দুর রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তার নির্বাচনী এলাকা শরীয়তপুর-৩ (ডামুড্যা-গোসাইরহাট)। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আব্দুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৭ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯১-০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের পর তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ২০০৯ সালের জুলাই-আগস্টে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করে। একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও সুখী সুন্দর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রামে প্রয়াত জননেতা আব্দুর রাজ্জাকের অনন্য অবদান বাঙালী জাতির স্মৃতিতে অম্লান থাকবে। লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
×