ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় দিবস ও তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

 বিজয় দিবস ও তারুণ্য

বিকাল ৪টা ৩১ মিনিট। ২৪ বছর পর বাঙালীর মুখে আনন্দোচ্ছ্বাসের জলতরঙ্গ হাসি। মুহুর্মুহু করতালি আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত পুরো রেসকোর্স ময়দান। এক অভূতপূর্ব সুখৈশ্বর্যময় মুহূর্ত। ৯ মাস ৯ দিন আগে এ ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রনিনাদ কণ্ঠে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দিয়ে শিকলে আবদ্ধ বাঙালী জাতির মননে চর্চিত দীর্ঘ লালিত মুক্তির স্বপ্ন পূরণের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ঘাসফড়িংয়ের ডানায় যে স্বপ্ন এঁকে তিনি বাঙালী জাতিকে নতুন ঊষার সন্ধান দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নপূরণের মাহেন্দ্রক্ষণটি তাই আবেগিক দিক দিয়ে তুরীয়ানন্দে ছুটে চলার মতোই হয়েছিল। আবার তেমনি ঐতিহাসিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ওইদিন একদিকে যেমন বাঙালি পাকিস্তানী স্বৈরাচারদের রাহুগ্রাস থেকে, রুদ্ধবাক অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে খুঁজে পেয়েছিল নবপ্রাণের আবেশ, অন্যদিকে বিশ্বের মানচিত্রে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ৯ মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে জায়গা করে নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ নামের এক নৈঃসর্গিক ভূখ- সোনার বাংলা। মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য মুক্তিপাগল বাঙালী লাখো প্রাণ উৎসর্গের বিনিময়ে বিজয়ের লাল সূর্য ছিনিয়ে এনে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বিজয় পতাকা। লন্ডনের নিউ টাইমস পত্রিকা সে সময় বলেছিল, রক্তই যদি কোন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের অধিকারের মূল্য বলে বিবেচিত হয়, তবে বাংলাদেশ অনেক বেশি দাম দিয়েছে। সে দামের বিনিময়েই আমাদের মহান বিজয়। এই বিজয় এমন নয় যে এলাম দেখলাম, জয় করলাম এর মতো কোন গল্প। এসব কিছু এত সহজে অর্জিত হয়নি। এই বিজয়ের পেছনের ইতিহাস অত্যন্ত বেদনার, নির্মমতার। ৩০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, ২ লাখ মা-বোনের কঠিন আত্মত্যাগ ছিল। ছিল কোটি মানুষের সহযোগিতা, আবাল-বৃদ্ধের প্রার্থনা। পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন সর্বপ্রথম তরুণেরাই। সাধারণ ছাত্র সমাজের আন্দোলনের এই অগ্নিশিখা সমগ্র বাংলার তরুণ ছাত্র, কৃষক-শ্রমিকদের মাঝে ছড়িয়ে যায়। হাজারও স্বপ্নবাজ তরুণ যুদ্ধ জয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত। তাদের শয়নে স্বপনে জাগরণে একটাই স্বপ্ন ছিল; এই দেশমাতৃকার স্বাধীনতা। সে সময়ে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের সুর ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই গান তারুণ্যের মন্ত্রে পরিণত হয়েছিল- ‘মা গো ভাবনা কেন? আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।’ অথবা, আপেল মাহমুদের গায়ে আগুন লাগানো গান- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’ ইত্যাদি গানে রক্ত টগবগ করেছে তারুণ্যের। গোটা ৯ মাস উজ্জীবিত ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। সময়ের চাকা ঘুরতেই হয়ত এসবে আগ্রহ হারিয়েছে এখনকার তরুণেরা। সেটাই স্বাভাবিক। আজকের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। ইতিহাস পড়ে অথবা লোকমুখে শুনেছে মাত্র। যুদ্ধকালীন সময়ের তারুণ্যের স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। যেখানে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচুতে ভেদাভেদ থাকবে না। সমাজব্যবস্থা হবে সাম্যতার। একটা সময় মনে হয়েছিল, এই দেশের তারুণ্যের কাছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিজয়ের ব্যাপারটা তেমন আর উপভোগ্য নয়। তারা ব্যাপারটিতে তেমন আন্দোলিত হয় না। সময়টা ছিল এদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়। যারা স্বাধীনতা চায়নি, পাকিস্তানিদের আজ্ঞাবহ ছিল তারাই পঁচাত্তর পরবর্তীতে এদেশের ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছে। তারা এসে যে কাজটি করেছিল সেটা হলো, তারুণ্যের মনোযোগকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা। ইতিহাসের গৌরবময় অর্জনসমূহকে মুছে ফেলেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী ঠিক এ সময়ে এসে বিজয়টাকে সত্যিকারে উপভোগ করতে পারছে, অনুভব করতে পারছে তরুণেরা। তারা দেশকে নিয়ে ভাবছে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানছে। মক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছে। ঐতিহাসিক দলিলগুলো সংরক্ষণ করছে, ভার্চুয়াল আর্কাইভ তৈরি করেছে। সমবেত কণ্ঠে গাইছে, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বলতে হয়, ‘হাজার হাজার শহীদ ও বীর/ স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর/ ভুলিনি তাদের আত্মবিসর্জন/ ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধ:/ কানে বাজে শুধু শিকলের ঝনঝন।’ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর শিকলের সেই ঝনঝনানি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাঙালী। তাই ওই মুহূর্তে বাঙালী নারী-পুরুষ-শিশু সবার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। চিরশত্রুর পদাবনত অবস্থান দেখে স্বজন হারাদের চোখেও ঠাঁই নেয় শোকের পরিবর্তে আনন্দাশ্রু। সেই অশ্রু গঙ্গা-যমুনা হয়ে, সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দেয়, আমরা বাঙালী, আমরা অজেয়, আমরা ওড়াতে পেরেছি লাল-সবুজের বিজয় কেতন। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদমুক্ত শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিমুখী উন্নত-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেই সত্যিকারের বিজয় অর্জিত হবে। আর এ বিজয়ের স্বাদ, মুক্তির আনন্দে তারুণ্যের হাত ধরে জাতি অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করবে। জয় হোক তারুণ্যের। জয় বাংলা।
×