ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শঙ্কিত বাঙালীদের কাল কমিশনের শুনানি প্রতিহতের ঘোষণা

ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় উত্তপ্ত পাহাড়

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯

ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় উত্তপ্ত পাহাড়

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ কাল সোমবার ২৩ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে জমা পড়া প্রায় ২২ হাজার আপত্তি আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের শুনানি শুরুর কর্মসূচী রয়েছে। ভূমি বিরোধ নিয়ে নিষ্পত্তি কমিশনের এ শুনানি প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে পাহাড়ে বাঙালীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনসমূহের অন্যতম পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি কমিশনের আগামীকালের শুনানি শুরুর বিষয়টি একপেশে বলে দাবি উঠেছে। ইতোমধ্যে খাগড়াছড়ির শাপলা চত্বর, বনরূপা ও বান্দরবান প্রেসক্লাব চত্বরে বাঙালীদের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল এবং মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২৩ নবেম্বর রাঙ্গামাটির সার্কিট হাউসে এক বৈঠক অনুষ্ঠানের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ারুল হক জানান দেন যে, আগামীকাল ২৩ ডিসেম্বর বিরোধ নিয়ে আবেদনসমূহের শুনানি শুরু হবে। বাঙালীদের পক্ষে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, ৫ সদস্যের এ কমিশনে বাঙালীদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। সুপ্রীমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত এ বিচারপতি চেয়ারম্যান, সদস্য আছেন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান (উপজাতীয়), জেলা পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান (উপজাতীয়) সংশ্লিষ্ট তিন সার্কেলের তিন চীফ (উপজাতীয়)। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার বা তার প্রতিনিধি থাকবেন। কমিশনের সচিব এবং কর্মকর্তা- কর্মচারীদের অধিকাংশই উপজাতীয়দের থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগের অধিকার লাভ করবেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর যেসব শর্ত বাস্তবায়নের কথা রয়েছে এবং একে একে হচ্ছে তার মধ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি সবচেয়ে জটিল এবং স্পর্শকাতর। এছাড়া পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন -২০০১ সংশোধিত হওয়ার পর এটি পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালীদের জন্য মারাত্মক হয়েছে বলে দাবি রয়েছে স্থানীয় বাঙালী সংগঠনগুলোর। তাদের ধারণা, সংশোধিত আইনে ভূমি কমিশনের নিয়ন্ত্রণ পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের হাতে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তিন পাহাড় থেকে বাঙালীদের ভূমিহীন করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে যাবেন বলে ধারণা রয়েছে বাঙালী সংগঠনগুলোর। কমিশনকে ব্যবহার করে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বাঙালী পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করলে রাষ্ট্রের বিদ্যমান কোন আইন-আদালতে প্রতিকারের সুযোগ নেই। কেননা, ভূমি কমিশন আইনের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, ‘ধারা-৬(১) এ বর্ণিত কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের ওপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানি আদালতের ডিক্রী বলিয়া গণ্য হইবে, তবে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা বা যথার্থতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৬ সালের ১ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬ চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি ভূমি নিরোধ সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য একটি ল্যান্ড কমিশন গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। ১৯৯৯ সালের ৩ জুন ল্যান্ড কমিশন গঠিত হয়। এরপর সরকার ২০০১ সালের ৫৩নং আইন তথা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি আইন কমিশন-২০০১ ’ পাস করে। সংশোধিত এ আইনেই পাহাড়ে বাঙালীদের ভূমির অধিকার খর্ব হয়ে যাবে বলে জোরালো দাবি রয়েছে বাঙালী সংগঠনগুলোর পক্ষে। এরপর জনসংহতি সমিতি প্রধান ও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার দাবির প্রেক্ষাপটে আইনের কিছু সংশোধনী আনা হয়। এতেই বাঙালীদের অধিকারের ওপর উপজাতীয়দের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি রয়েছে। ২০১৬ সালে যে ১৪টি সংশোধনী হয় তাতে জনসংহতি সমিতির সিদ্ধান্ত পুরোপুরিভাবে হাসিল হয়েছে বলে দাবি রয়েছে। বর্তমানে ভূমি কমিশন আইন বাস্তবায়ন নিয়ে বাঙালীরা শঙ্কিত। এ কারণেই পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালীদের বিভিন্ন সংগঠন পাহাড়ের পরিবেশকে উত্তপ্ত করতে শুরু করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সংশোধিত আইনটি বৈষম্যমূলক ও সংবিধানবিরোধী বলে দাবি করে বাঙালী সংগঠনগুলো হরতাল-অবরোধসহ নানান কর্মসূচী পালন করেছে। গত ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে সংশোধনী পাস হলে বাঙালী সংগঠনগুলো এ আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা করে, যা এখন জোরালো রূপ নিচ্ছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে দ্বিতীয় দফায় ৪৫ দিনের মধ্যে আবেদন আহবান করে কমিশন গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এ প্রেক্ষিতে ১৫ হাজার আবেদন জমা পড়ে। ফলে দুদফায় ২২ হাজার ৯০টি আবেদন জমা রয়েছে। এসব আবেদন নিয়ে কাল থেকে কমিশনের শুনানির কর্মসূচী রয়েছে। কিন্তু বাঙালী সংগঠনগুলো এ শুনানি প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে। খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি থেকে জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনের দাবিতে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। শনিবার সকালে জেলার শাপলা চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি কমিশনের শুনানি করতে দেয়া হবে না। এ সময় নেতৃবৃন্দ বলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালীদের কোন প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সাধারণ বাঙালী জনগোষ্ঠী সুবিচার না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অবিলম্বে কমিশনে পাহাড়ী-বাঙালী জনসংখ্যা’র অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানান। এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে সংগঠনটি। কমিশন গঠনের ১৮ বছর পর আগামী ২৩ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের প্রথম শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
×