ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনযাত্রা স্থবির

ধেয়ে আসা বরফের তীর বিঁধছে উত্তরের মানুষের দেহে

প্রকাশিত: ০৯:৪৮, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯

ধেয়ে আসা বরফের তীর বিঁধছে উত্তরের মানুষের দেহে

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ ধেয়ে আসা বরফের তীর বিঁধে যাচ্ছে হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলের মানুষের দেহে। এবার পৌষের ঠান্ডায় হাত পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের হিমেল কামড়ে স্থবির উত্তরের মানুষ। বগুড়ায় শুক্রবার দিনভর সূর্য উঁকি দেয়নি। কুয়াশার মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় হেরে যাচ্ছে সূর্যিমামা! কুয়াশা এবার বহুরূপী। বায়ুদূষণের সঙ্গে যুক্ত। শহর ও নগরীর বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বনমনোক্সাইড, সালফারডাইঅক্সাইডের সঙ্গে ধূলি ও বস্তুকণার। প্রলেপ ও মিশ্রণে কুয়াশার ঘনত্ব অস্বাভাবিক বেড়েছে। দূষিত বস্তুকণা মাটিতে পড়তে না পাড়ায় সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত শীতের তীব্রতা কখনও স্থিতি আবার কখনও বাড়ে। আবহাওয়া অফিস জানায়, বগুড়া ও আশপাশের এলাকায় আরও ক’দিন শৈত্যপ্রবাহ থাকবে। তবে এত কিছুর পরও জীবনযাত্রা থেমে নেই। সকালে দেরিতে ঘর থেকে বের হচ্ছে মানুষ। শুক্রবার চাকুরেরা ঘর থেকে বের হয়নি। উচ্চবিত্তরা ছিলেন রুম হিটারে। মধ্যবিত্তরা অনেকটা সময় বিছানায় ছিলেন লেপ মুড়ি দিয়ে। কেউ ঘরের ভেতরে চাদর জড়িয়েও কুলোতে পারেনি, কম্বল জড়িয়ে সকাল দুপুরের খাবার খেয়েছেন। কিন্তু কর্মজীবীদের তো আয়েশ করার জো নেই! সকাল সকালই ঘর থেকে বের হতে হয়েছে। রিক্সাচালকদের দেখা গেছে শরীরে কয়েক প্রস্থ মোটা কাপড়। হকার্স মার্কেটে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য কম দামের গরম কাপড় মিলছে। ভাল জ্যাকেট মাফলার পশমি টুপি হাতমোজা পামোজা এসেছে। দামও সাধ্যের মধ্যে। গরিব মানুষের এখন আর তেমন অসুবিধা হয় না, কিনতে পারে। অসুবিধা একটাই শীতের ছোবলেও ঘর থেকে বের হওয়া। কর্মজীবী মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে দেরিতে। আবার বিকেলের পর ঘরমুখোও হচ্ছে দ্রুত। বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল কৃষ্ণচূড়া চত্বরে (সাতমাথা) সান্ধ্যআড্ডা সীমিত হয়ে এসেছে। সন্ধ্যায় চা কফি কেনাকাটা কিছুটা বাড়ে। তবে বেশিক্ষণ থাকে না। সাতটা/সাড়ে সাতটার মধ্যে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হয়। সিদ্ধ ডিম, ভাজাপোড়ার দোকানে সিঙ্গারা, চটপটি, চপ, পেঁয়াজু, বেগুনী, গোলকাপ্পো (কমন নাম ফুচকা) ইত্যাদি বেচাকেনায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। শীতের রাতে কে আর বেশিক্ষণ ঘরের বাইরে থাকে। বাড়িতে গৃহিণী ও ছোট্ট ছেলেমেয়েরা অবশ্য খুশি। তাড়াতাড়ি কাছে পাচ্ছে। শহরের রাস্তায় পথশিশুদের আবর্জনা খড়কুটো যানবাহনের পরিত্যক্ত টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে শরীর তাপিয়ে নিতে দেখা যায়। রাত দশটার পর শহর হয়ে যায় নিঝুমপুরী। শহরতলি এলাকায় শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক শোনা যায়। কিছু কুকুর ঘেউ ঘেউ ডাকে তেড়ে আসে। শিয়াল-কুকুরের রাত দখলের যুদ্ধের ডাক শুনতে মন্দ লাগে না। প্রাণিকুলের এমন নাটকীয় অধ্যায় শীতের রাতেই মেলে। গ্রামের চিত্র অন্যরকম। এবার পৌষে শীত পুরো ফণা তুলছে। মৃদু বাতাসের শব্দ ফোঁসফোঁস শব্দ করছে । লক্ষ্মী পেঁচা হুতুমপেঁচা ঠাহর করতে পারে না কখন প্রহরের ডাক দেবে। গ্রামও তো এখন শহরের মতো। বিজলি বাতিতে সারাক্ষণ ঝল্্সে উঠেছে। কৃষকের বাড়িতে ধানসিদ্ধ করার সময় চুলার চারধারে বসে তাপ পোহায় ছোট্ট ছেলে মেয়েরা। সকালও সন্ধ্যায় খড় ও লতাপাতা জ¦ালিয়ে চারধারে বসে শরীর তাপিয়ে নেয়। বাদ যায় না জীবনের গপ্পসপ্প থেকে দেশের খবর। রাতে দ্রুত ঘরে ঢুকে লেপের মধ্যে শুয়ে বসে আয়েশ করে টিভির অনুষ্ঠান দেখছেন অনেকে। কেবল সংযোগটি হতে বিদেশী অনুষ্ঠান ও সিরিয়াল দেখে গ্রামের মানুষ। সকালে কুয়াশায় কনকনে শীতে পুরো শরীর চাদরে ঢেকে জমিতে যেতে হয়। এই সময়ে আলুর আবাদে কুয়াশার ছোবল থেকে বাঁচাতে কলা গাছের ঢোঙা কেটে ছইয়ের মতো করে কেউ ঢেকে দিচ্ছে। বোরো আবাদের জমি ঠিকঠাক করতে হচ্ছে। শীত যত কাবু করুক কৃষককে জমিতে না গেলেই নয়। কৃষকই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। শীতের উপসর্গ রোগব্যাধি পিছু ছাড়ছে না। ঘরে ঘরে সর্দি কাশি জ¦রজ¦ারি। নাক দিয়ে পানি পড়া আরেক যন্ত্রণা। গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গার্গিলিং (গড়গড়া করা) করে কাশি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা। শিশু বয়স্ক ও যাদের হাঁপানি আছে তাদের কষ্ট বেশি। লেপ জড়িয়েও শীত যেতে চায় না। শীতের এত যে কাসুন্দি তারপরও শীত এনে দিয়েছে নানা জাতের পিঠাপুলি। শহরে পিঠাপুলির পসরা বসায় হকাররা। অনেকে চিতই পিঠা কিনে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে খেজুরের গুড়ে দুধ জাল দিয়ে ভিজিয়ে রেখে সকালে খাচ্ছে। পাটিসাপ্্টা কুশলি পিঠা তেলপিঠাসহ কত জাতের যে পিঠা এখন রেসিপিতে এসেছে। বৈচিত্র্য এসেছে শীতের পোশাকেও। তবে এসব বৈচিত্র্য হালে টিকছে না। ছেলেরা কোট প্যান্ট শাল চাদর পরলে তো শার্ট দেখা যায় না। মেয়েদেরও তো একই অবস্থা। কার্ডিগান শাল পরলে তো শাড়ির নক্সা ঢেকে যায়। কে বলে শীতের পোশাকে বৈচিত্র্য। হ্যাঁ, তাই তো, বিষয়টা ভেবে দেখার। তবুও জয়তু শীত।
×