ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সোনারগাঁর পরিত্যক্ত টাকশাল

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯

সোনারগাঁর পরিত্যক্ত টাকশাল

ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিক দিয়ে সোনারগাঁয়ের সুনাম বিশ্বব্যাপী। এক সময় সোনারগাঁ ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। সোনারগাঁ বাংলার রাজধানী হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সময় এখানে ভিন্ন ভিন্ন শাসকরা তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে সোনারগাঁ থেকে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলনও করেছিলেন তৎকালীন রাজন্যবর্গ। সে সময় এ মুদ্রা তৈরির জন্য সোনারগাঁয়ে গড়ে উঠেছিল নিজস্ব মুদ্রাগার বা টাকশাল। সোনারগাঁয়ের আমিনপুর ও মহজমপুরে ঐতিহাসিক দুটি টাকশাল রয়েছে বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা। প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঐতিহাসিক সোনারগাঁ এক সময় বিত্ত বৈভব আর জৌলসে জাঁকজমকপূর্ণ নগরী হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত ছিল। কিন্তু বহুকাল আগেই পতন ঘটেছে সেই প্রাচীন নগরীর। এক সময়কার রাজধানী এখন প্রাণহীন এক স্মৃতি চিহ্ন। সময়ের আবর্তনে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন নগরীর ভগ্ন ইমারতগুলো এখন পর্যটকদের এক অন্যতম আকর্ষণ। বাংলার প্রাচীন রাজধানী থাকা কালে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে স্বয়ং স¤পূর্ণ এ নগরীতে ছিল বেশ কয়েকটি মুদ্রার প্রচলন। আর এসব মুদ্রা তৈরি করা হতো তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিজস্ব টাকশালে। সোনারগাঁয়ে এ পর্যন্ত দুটি টাকশালের সন্ধান পাওয়া গেছে। দুটি টাকশালের মধ্যে মহজমপুরের টাকশালটি ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সোনারগাঁয়ের জামপুর ইউনিয়নের মহজমপুর এলাকায় ছিল সুলতানী আমলের টাকশালটি। ১৬শ’ শতকে সুলতানী শাসনের শেষ দিকে এখানে শাহী লঙারের মসজিদ ও এতিমখানা ছিল। ইতিহাসে আছে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে সুলতানী আমলের একমাত্র টাকশালটি ছিল তৎকালীন মোয়াজ্জেমাবাদ বর্তমান মহজমপুরে। ইলিয়াছ শাহী বংশের শাসন আমলে অনেক মুদ্রা সোনারগাঁয়ের এ টাকশালে মুদ্রিত হয়েছে। সোনারগাঁয়ে ইলিয়াছ শাহী বংশের শাসন আমল শুরু হয় ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে। শামসুদ্দিন ইলিয়াছ শাহ ছিলেন এ বংশের প্রথম শাসক। ইলিয়াছ শাহী আমলের অন্যতম শাসক ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ। তার আমলেই সোনারগাঁয়ে স্বাধীনভাবে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন ঘটে। সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরের কাছে অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে ক্রোড়ি বাড়ি টাকশাল। প্রায় চার শতাব্দীর পুরনো এ টাকশালটি এখন পরিত্যক্ত একটি ভবন। গৌড়ীয় দোচালা স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এ টাকশালটি চারদিকে রয়েছে পাতলা জাফরি ইটের উঁচু দেয়াল। যা দেখলেই অনুমান করা যায় এ স্থানটি তৎকালীন সময়ে একটি সংরক্ষিত এলাকা ছিল। টাকশালটির উত্তরে রয়েছে বিশাল দীঘি। এক সময়ে দীঘির চারদিকে প্রকা- আকারের শান বাঁধানো ঘাট ছিল। বর্তমানে ঘাটের কোন অস্তিত্ব¡ নেই। তবে দীঘিটি আগের মতোই রয়েছে। স্থানীয় লোকেরা আমিনপুরের এ টাকশালটিকে ক্রোড়ি বাড়ি বলে থাকে। মুঘল স¤্রাট আকবরের সময়ে পরগনার রাজস্ব অধিকর্তা ও রাজস্ব সংগ্রাহকের পদবি ছিল ক্রোড়ি। তিনি ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে ১শ’ ৮২ জন ক্রোড়ি নিয়োগ করেছিলেন আর্থিক কাজকর্ম দেখভালের জন্য। ধারণা করা হয় সে থেকেই এ বাড়ির নাম ক্রোড়ি বাড়ি। সুরম্য এ টাকশালটির স্থাপত্যকলা বেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মুসলিম এবং হিন্দু স্থাপত্যের অপূর্ব সংমিশ্রণে এ টাকশালটি তৈরি করা হয়েছিল। টাকশালের দেয়ালে রয়েছে লতাপাতাসহ নানা ধরনের অলঙ্করণ। রয়েছে ঢেউ খেলানো খিলান, খিলানের মাথায় রয়েছে বাজপাখি ও পদ্ধফুলের খোদাই করা প্রতিকৃতি। ভগ্নপ্রায় ইমারতে রয়েছে অসংখ্য খুপরি ও কুঠুরি। ভূগর্ভস্থ কুঠুরিগুলোতে সরকারি মুদ্রা ও সোনার মোহর রাখা হতো বলে ধারনা করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, সম্রাট আকবর ও শের শাহের আমলে এ ভবনটি ছিল ‘ট্রেজারার হাউস’। সম্রাট শের শাহের আমলে এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে ছিল। শের শাহের আমলে প্রচলিত মুদ্রাগুলো ক্রোড়িবাড়ি টাকশালে তৈরি হতো বলে ধারণা করা হয়। ঐতিহাসিক স্বরূপ চন্দ্র রায় ‘সুবর্ণগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সামসুদ্দিন আবুল মুজাফফর শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রা সোনারগাঁয়ে তৈরি হয়েছিল। তা ছাড়া ঐতিহাসিক ব্রাডলি বার্ট তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রোমান্স অব এ্যান ইস্টান ক্যাপিটালে’ ক্রোড়িবাড়ির নাম উল্লেখ করেছেন। দুটি টাকশালের মধ্যে একটি বিলীন হয়ে গেলেও জারাজির্ণভাবে দাড়িয়ে আছে ক্রোড়িবাড়ি টাকশালটি। অযতœ অবহেলায় জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে উঠেছে এ টাকশাল। এটি সংস্কারে সরকারী ভাবে নেওয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। অথচ সোনারগাঁয়ের ইতিহাসের সাথে এ টাকশালটি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। বর্তমানে স্থানীয় অসীম দাস গুপ্ত নামে এক ব্যক্তি সেবায়েত হিসাবে টাকশালটি ভোগ দখল করছেন। স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদ হোসেন জানান, টাকশালটি যদি দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করে সংস্কার করে আদিরূপে ফিরে আনা যেত তা হলে এর দৃশ্যপট বদলে যেত। তা হলে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ হতো। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সোনারগাঁয়ের সাইড ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া জানান, টাকশালটি উদ্ধারের জন্য কয়েক বার আমরা চেষ্টা করেছি। প্রতœতত্ত্ব আইনী সাইনবোর্ড দিয়েছিলাম সেখানে সেটিও গায়েব হয়ে গেছে। -ফারুক হোসাইন, সোনাগাঁ থেকে
×