ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সন্দেহজনক লেনদেন ॥ মানি লন্ডারিং

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

  সন্দেহজনক লেনদেন ॥ মানি লন্ডারিং

বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ তফসিলি ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহকের হিসাব খোলা ও পরিচালনাকালে তাদের পরিচিতি নিশ্চিতকরণ ও সংরক্ষণের রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করে থাকে, যদিও কিছু কিছু তফসিলি ব্যাংক নিয়মগুলো কঠোরভাবে অনুশীলন করছে না। এ কারণে বেশ কিছু ব্যাংকের কর্মকর্তা ও গ্রাহকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ কিছু অপরাধের কারণে মামলা হয়েছে এবং বর্তমানে সেগুলো চলমান। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ গ্রাহক পরিচিতি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। গ্রাহক পরিচিতি নিশ্চিত করার প্রয়োজনে গ্রাহকের ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে, কোন অবস্থাতেই সন্দেহজনক পরিচিতি সংবলিত হিসাবধারীর বা সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি বা দিতে আগ্রহী নন এমন গ্রাহকের হিসাব খোলা বা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন সংস্থার পরিচালক অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনপূর্বক সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে বিনিয়োগ করছেন। এক্ষেত্রে দেখা যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নম্বরের পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকেন। অর্থাৎ একই ব্যক্তি আট থেকে নয় বছরে ৬/৭ বার পাসপোর্ট পরিবর্তন করেছেন এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন যা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় মর্মে প্রতীয়মান/প্রমাণিত হয়। এমনও দেখা গেছে যে, একই দিনে একই ব্যাংকের একই শাখায় বিপুল পরিমাণ টাকা জমা করেছেন এবং একই দিনে পে-অর্ডারের মাধ্যমে কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ওই হিসাবে জমাকৃত টাকারও কোন উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সঠিক সময়ে স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি অবরুদ্ধ না করলে ওই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক যে কোন সময় সম্পদ হস্তান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং বিচারকালীন রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফত করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ইং এর ধারা ২ এর (য) উপধারায় সন্দেহজনক লেনদেনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেমন সন্দেহজনক লেনদেন বলতে বোঝায় যা স্বাভাবিক এবং সাধারণ লেনদেনের ধরন হতে ভিন্ন বা যে লেনদেন অপরাধ হতে অর্জিত সম্পদ বা কোন সন্ত্রাসী কার্যে, কোন সন্ত্রাসী সংগঠনকে বা সন্ত্রাসীকে অর্থায়ন। সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং মানি লন্ডারিংয়ের মধ্যে যোগসূত্র সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং দুটি ভিন্ন বিষয় হলেও একটির সঙ্গে অপরটি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আইনের পরিভাষায় মানি লন্ডারিং হলো অবৈধ পন্থায় সম্পত্তি/অর্থ অর্জন বা বৈধ সম্পদের অর্থের অবৈধ পন্থায় স্থানান্তর বা ওই কাজে সহায়তা করা। অপরদিকে সন্ত্রাসে অর্থায়ন হলো নাশকতামূলক কর্মকা-ে (যা সমাজের/জাতির জন্য ক্ষতিকর) অর্থের যোগান দেয়া। সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং মানি লন্ডারিংয়ে ব্যবহৃত কলাকৌশল অনেকটা একই ধরনের। অর্থের উৎস গোপন করা কিংবা সন্ত্রাসে অর্থায়নে মোটামুটি একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিংয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজলে দেখা যায়, সাধারণত অধিকতর মুনাফা অর্জন বা অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের উদ্দেশে মানি লন্ডারিং করা হয়ে থাকে। অপরদিকে কোন একটি বিশেষ আদর্শ/বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত হয়ে কোন অপরাধ সংঘটন বা ওই অপরাধমূলক কাজে সহায়তা করার উদ্দেশে সন্ত্রাসে অর্থায়ন করা হয়ে থাকে। মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পদ গোপন করা বা লুকানোর উদ্দেশে সম্পদের রূপান্তর বা হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত সম্পদ কোন বৈধ উৎস কিংবা কোন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হতে অর্জিত অথবা উভয়ভাবেই অর্জিত হতে পারে। অর্থ পাচার এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন দমনে দুদক, বিএফআইইউ, সিআইডি (পুলিশ), এনবিআরকে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রিপোর্টিং এজেন্সি এবং তার মান অনেক বাড়াতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের মধ্যে আরও সমন্বয় বাড়াতে হবে। এলসি সংক্রান্ত আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআরের মধ্যে প্রযুক্তিগত সমন্বয় বেশি প্রয়োজন। কারণ যখন কোন ব্যাংকে এলসি খোলা হয়, যে পরিমাণ টাকার এলসি খোলা হয়েছে সে পরিমাণ পণ্য আনা হয়েছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব এনবিআরের। সেজন্য এনবিআর এবং ব্যাংকের মধ্যে অনলাইনে একটি কো-অপারেশন প্রয়োজন। প্রতিটি এলসি খোলার ক্ষেত্রে তফসিলিভুক্ত ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করতে হবে। উদ্যোগ-প্রচেষ্টা আরও শক্ত করতে হবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধী চক্রও নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন এবং মানি লন্ডারিং কার্যক্রমে তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থ ব্যবস্থার মাধ্যমেই তারা এসব অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ও, বিশেষ করে উন্নত দেশসমূহ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করছে। তবে উন্নয়নশীল দেশসমূহের এসব উদ্যোগ-প্রচেষ্টা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলা যায়। দেশে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জও বাড়ছে। বদলে যাচ্ছে অপরাধের ধরন- পূর্বে অর্থনীতির আকার ছিল ছোট, তাই অপরাধের আকারও ছিল ছোট, তবে এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক ও স্টক মার্কেটসহ আর্থিক খাতে বড় বড় অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি এবং মানুষের জীবন যাত্রায় এটি গুরুতর প্রভাব ফেলছে। বিচারাধীন মামলা, তদন্ত কার্যক্রম, অনুসন্ধান কার্যাবলী আইন ও বিধি মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেই বোঝা যাবে আমাদের অবস্থান কোথায়? লেখক : এ্যাডভোকেট,বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, সম্পাদক ঢাকা ল’ রিপোর্টার্স (ডিএলআর)
×