ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন রক্তপ্রবাহ

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন রক্তপ্রবাহ

একটি রাজনৈতিক দলের সার্থকতা তার নেতৃত্ব, কর্মসূচী, সংগঠন এবং নিঃস্বার্থ কর্মীদের ওপর নির্ভরশীল। রাজনীতিতে চারটি জিনিসের প্রয়োজন নীতি, নেতা, কর্মী ও প্রতিষ্ঠান। একটির অনুপস্থিতি রাজনৈতিক দলের অগ্রগতির পথে অন্তরায়। সাত দশক পার হতে যাওয়া এদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ১৯৬৪ সালে দলটি পুনরুজ্জীবিত করার কালে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের নীতি আছে, নীতির মাধ্যমে নেতা আছেন, কর্মী আছেন, প্রতিষ্ঠান আছে। জনগণের জন্য সংগ্রামই আওয়ামী লীগের নীতির মূল কথা। সারাদেশে সংগ্রামী ঐতিহ্য বলতে একমাত্র আওয়ামী লীগেরই আছে। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং তা কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। সুতরাং স্বভাবতই জনসাধারণের জন্য মঙ্গলজনক ব্যবস্থাদি গ্রহণের মতো পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে সৃষ্টি করতে হবে।’ নারায়ণগঞ্জে ওই বছরের ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত এক কর্মী সম্মেলনে শেখ মুজিব জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘শখের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে না। আওয়ামী লীগ নীতির রাজনীতি করে। তাই কোন সময় পুলিশের গাড়ি এসে তুলে নিবে, তার জন্য আমরা প্রস্তুত হয়েই থাকি।’ আজ থেকে ৫৪ বছর আগে আওয়ামী লীগ নেতা যে বিশ্লেষণ তুলে ধরেছিলেন, কাল পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ সে অবস্থান থেকে সরে গেছে এমন নয়। নানা বাধা বিপত্তি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, তুফান বয়ে গেছে দলটির ওপর দিয়ে। নিপীড়ন, শোষণ, নির্যাতন, জেল-জুলুম, হুলিয়া, হামলা-মামলার শিকার হয়েছে দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। এ সবই ইতিহাসের অংশ। দলটির রয়েছে দুটি পর্ব। পাকিস্তান পর্ব এবং বাংলাদেশ পর্বে আওয়ামী লীগ ভিন্নতর মাত্রায় উদ্ভাসিত হলেও গণমুখী নীতি থেকে সরে আসেনি। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে দেশ, জাতি ও জনগণের পাশে সব সময় রয়েছে। আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন দেশে পরিণত করেছে এই আওয়ামী লীগই, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। কত অত্যাচার যে সহ্য করতে হয়েছে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের, তার ফিরিস্তি হবে বিশালাকারের। দলটি বহুবার ভেঙ্গেছে। দল থেকে বেরিয়ে ভিন্ন দলও করেছে অনেকে। কিন্তু আওয়ামী লীগ রয়ে গেছে আওয়ামী লীগেই। জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণে এক পাও পিছিয়ে যায়নি। সাহসে ভর করে এগিয়েছে সব সময়। আপোস করেনি বাঙালী জাতিসত্তার বিরোধিতার সঙ্গে। একটি পশ্চাৎপদ শৃঙ্খলিত, শোষিত, উত্থান রহিত জাতিকে তিলে তিলে জাগ্রত করে স্বাধিকার-স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করার কাজটি আওয়ামী লীগই করেছে। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলেছে। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় তুলে ধরেছে। প্রমাণ করেছে বীরের জাতি নিজেদের এবং এই সবই হয়েছে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। যিনি পেয়েছেন পুরো জাতির অকুষ্ঠ সমর্থন। আর সেই জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা পূরণে জেল, জুলুম, নির্যাতন সবই সহ্য করেছেন তিনি যেমন, তেমনি তার সহকর্মী ও সহযোদ্ধারাও। কী কঠিন পরিশ্রমই না করেছেন জীবনভর, দল গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে। সে সবই আজ ইতিহাসের অংশ। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা এখন দলপ্রধান। প্রায় চার দশক ধরে তিনি দলকে পরিচালনা করে আসছেন। চার দফা ক্ষমতায় এনেছেন দলকে। বিশেষ করে টানা তিন দফা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জোট, মহাজোট গঠন করে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পথ তিনি নিজেই নির্মাণ করেছেন। নেত্রী এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি বিশ্বসভায় নিজস্ব আসনখানি পাকাপোক্ত করতে পেরেছেন। বিশ্ব মানবের কাছে তিনি নিজে যেমন একটি গর্বিত নাম, তেমনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোল মডেলে পরিণত করতে পেরেছেন। শেখ হাসিনা নেতা, চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সফলতার সিঁড়ি পেরিয়ে উচ্চাসনে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যতটা, ঠিক বিপরীত অবস্থানে তার দল পিছিয়ে পড়েছে ততটা। নেতার সঙ্গে দলের নেতাকর্মীরা সমানতালে না হোক, অনতিদূরেও অবস্থান নিতে পারেননি। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। পঁচাত্তর পরবর্তী ঘটনাবলী দলকে নানাভাবে কোণঠাসা করে রেখেছিল একদিকে। অপরদিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানীমনাদের দাপট, নির্যাতন, নিপীড়ন, দলীয় নেতাকর্মী হত্যার ঘটনাগুলো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল নেতৃত্বের বিকাশে। নতুন যারা এসেছে তাতে কচুরিপানার ভিড়ও কম নয়। বদ্ধ জলাশয়ে আবদ্ধ থাকারা তাই রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করে এগুতে পারছে না। গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মহাজোটের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় লাভ করেছে। শরিক দলগুলোও কিছু আসন পেয়েছে। অপরদিকে বনসাঁইয়ে পরিণত হয়েছে বিএনপি নামক জামায়াতের সহোদর দলটি। জামায়াত ‘গায়েবি’ দলে পরিণত হয়েছে। অতীতের তিনটি সরকার গঠনে আওয়ামী লীগ শরিক দলের নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কিন্তু এবারই প্রথম স্রেফ আওয়ামী লীগের সরকার গঠন করা হলো। শরিক দলের কাউকে এখনও নেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ চাইছে শরিকরা বিরোধী দল হিসেবে সংসদে অবস্থান করুক। বিএনপি-জামায়াত খর্বকায় হওয়ার পর রাজনীতিতে বিরোধী দলের অবস্থান যাতে শূন্য না থাকে, কিংবা এই শূন্যতার সুযোগে ধর্মব্যবসায়ী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, বিরোধী দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল অবস্থান যাতে নিতে পারে সম্ভবত সে কারণে সরকারী দল এই পরিকল্পনা নিয়ে থাকতে পারে। সংসদেও যাতে তারা শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশের পথকে মসৃণ করতে পারে এবং একই সঙ্গে দল হিসেবে নিজেদের সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক শক্তিমত্তা বাড়াতে পারে- সে সুযোগটুকু আওয়ামী লীগ দিতেই পারে। মহাজোট নিয়ে আওয়ামী লীগ এখনও কোন তিক্ততার সম্মুখীন হয়নি। তবে পাকিস্তানপর্বে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শেখ মুজিবকে জোট নিয়ে নানা ধকল পোহাতে হয়েছে। তাই তিনি সত্তরের নির্বাচনে কোন জোট গঠন করেননি। একক শক্তি নিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে সাফল্য অর্জন করেছিল। পাকিস্তানী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ও স্বাধিকার আদায়ে নির্বাচনী জোট করার পথে যায়নি দলটি। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী এই একুশ শতকে এসেও দলটি আবার একক শক্তিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার মতো শক্তিমত্তা অর্জন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী দলটিতে ভাঙ্গন এবং দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া নেতাদের আরও দল গঠন এই একক শক্তি অর্জনের পথে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সচেষ্ট থাকলেও পেরে ওঠেনি। ১৯৯৬ সালে প্রায় একক শক্তি নিয়ে দলটি বিজয়ী হওয়ার পর অন্য দলের সহায়তায় সরকার গঠন করেছিল। ২০০১ সালে নির্বাচনী জোট করেও ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে জোট গঠন করে বিজয়ী হওয়ার পর শরিকদের নিয়েই সরকার গঠন করেছে। অবশ্য এটাকে এক ধরনের ‘কোয়ালিশন’ও বলা যায়। দলটির একক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত হয়েছে যেমন, তেমনি সাংগঠনিক শক্তিও হয়েছে দুর্বল। ‘হাইব্রিড’ ‘কাউয়া’ ইত্যাকারের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির লোকরাও প্রকাশ্যে-গোপনে দলে অবস্থান নিয়েছে। কোথাও কোথাও নেতৃত্বে আসীন হয়েছে। ফলে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল সাংগঠনিক ক্ষেত্রে। সেসব কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা এবার পরিলক্ষিত হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি হ্রাস পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম কার্যকারণ হচ্ছে, দল এবং সরকার একাকার হয়ে যাওয়া। বলা যায়, আওয়ামী লীগ নামক দলটিকে গিলে ফেলেছে সরকার, সরকার আর দল হয়ে গেছে একীভূত। তাদের পৃথক সত্তা মেলেনি। দলের কোন প্রভাব মেলেনি সরকারে। ভারতে দেখা যায়, দল আর সরকার পৃথক সত্তা এবং সরকার পরিচালনায় দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারী নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে দলের চাপ থাকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দলে আলোচনা হয়। দলীয় সমর্থন ছাড়া সিদ্ধান্ত হয় না সহজে। দলীয় ফোরামে আলোচনার পর সরকার নীতিগত অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। দলের যারা দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকেন তারা সরকারে যোগ দেন, এমনটা নয়। আর যদি অংশ নেন, তবে দলীয় পদ ছেড়েই তা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করলেও দলকে সরকারের মধ্যে টেনে নেননি। বঙ্গবন্ধু দলকে দলের স্থানেই রেখেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদককে সরকারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধু নিজেও পঞ্চাশ দশকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু একালে দল ও সরকার একাকার হওয়ার ফলে দলীয় সাংগঠনিক শক্তি ক্রমশ লোপ পেয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশই গত দু’দফায় মন্ত্রিসভার সদস্য বা সরকারী অন্যান্য পদে ছিলেন। একই সঙ্গে সরকার ও দলে থাকায় সংগঠনটির পৃথক অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। সাংগঠনিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ায় সারাদেশে দলীয় নেতাকর্মীর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়নি। সবকিছু যেন ফ্রি স্টাইলে চলছিল। যে কারণে বরগুনায় একটি আসনের জন্য ৫৫ জন মনোনয়ন চেয়েছিলেন। সারাদেশেই এই হাল হয়েছে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে দেখা গেছে, জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ে নিয়মিত কাউন্সিল না হওয়ায় নতুন নেতৃত্ব যেমন গড়ে ওঠেনি তেমনি নতুন প্রাণশক্তিরও সম্মিলন ঘটেনি। আর তা না হওয়ায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ফুলের তোড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনে বরণ করা হয়েছে। আর এই দল ভারির প্রচেষ্টা মূলত সাংগঠনিক ভিত্তিকে দুর্বল করেছে। ছাত্র ও যুব সংগঠন রাজনীতিতে কোন ভূমিকা রাখতে না পারলেও সুনাম ক্ষুণœ হওয়ার মতো অনৈতিক সহিংস কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে নিজেদের ‘লুটেরা’ চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছে। গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছে ‘অপকর্মের’ ফিরিস্তি। সারাদেশে সংগঠন বা সাংগঠনিক শক্তি তেমন নেই, এমন যুব সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী গত দশ বছরে হানাহানি এবং দলীয় কোন্দলে প্রাণ হারিয়েছেন। দলে নতুনদের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ থাকায় নানা নামে সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জায়গা জমি দখলসহ নানাবিধ অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। খোদ ঢাকা মহানগরীতে দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি, তেমনি বহু জেলায় এক দশক ধরে সম্মেলনও হয়নি। ছাত্রলীগের সম্মেলন শেষে সর্বত্র পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। বরং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করা হয় নানা অভিযোগে। সাংগঠনিক এই স্থবিরতা দলকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যে, সংশয় তীব্র হয় একক শক্তি নিয়ে দলটির মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারা সহজসাধ্য নয়। ক্ষমতায় থেকে দলকে শক্তিশালী করা না গেলে ক্ষমতাকে সংহত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। নিয়ন্ত্রণহীন দলীয় নেতাকর্মীর অপকর্মের মাশুল অতীতে বহুবার দিতে হয়েছে। বলা যেতে পারে, এ রকম দুরবস্থা হলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলটি ভূমিধস বিজয় কিভাবে অর্জন করতে পেরেছে? এর উত্তর সবার জানা। এবার জনগণ প্রার্থীকে ভোট দেয়নি। সত্তরে শেখ মুজিবের নৌকাকে ভোট প্রদানের মতো এবারও জনগণ শেখ হাসিনা ও নৌকাকে ভোট দিয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন কথাও উঠেছিল যে, বঙ্গবন্ধু কেন জোট গঠন না করে এককভাবে নির্বাচন করছেন। নির্বাচনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু সে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘বলা হচ্ছে, নির্বাচনী ঐক্যজোটে সম্মত না হয়ে আমরা বাংলার স্বার্থেরই ক্ষতি করছি। কিন্তু বাংলার স্বার্থের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যই আমরা নির্বাচনী ঐক্যজোটে আর বিশ্বাসী নই। অতীতে বহুবার, এমনকি ১৯৫৪ সালে ঐক্যজোট গঠনের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। বাংলার মানুষ গভীর আশায় বুক বেঁধে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করেছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি, যুক্তফ্রন্টের নাম নিয়েই আওয়ামী লীগের সদস্য ছাড়া আর সব দলের সদস্যই কেন্দ্রের সেই ধিক্কৃত দলটিতে ভিড়ে গিয়েছেন। যে দলকে দু’দিন আগে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ বাংলার মাটি থেকে সমূলে উৎখাত করেছে। ফলত সর্বনাশ হয়েছে বাংলার আর বাঙালীর। সর্বনাশ হয়েছে এদেশের মানুষের। তাই এবার আমরা ভিন্ন চিন্তাদর্শের মানুষের সঙ্গে ঐক্যজোট গঠন করে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষ্যের প্রতিফলন পরবর্তীকালেও পরিলক্ষিত হয়েছে। ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট গঠন করেছিল। দেখা গেছে, নির্বাচিত শরিক দল বাকশালের সদস্যরা জাতীয় পার্টিতে এবং সিপিবি ও ন্যাপ সদস্যরা বিএনপিতে যোগ দেয়। অথচ আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করে এরা বিজয়ী হয়েছিল। এখনকার বাস্তবতায় অবশ্য শরিক দলের অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও তারা সংগঠিত শক্তি হিসেবে বিরোধী দল গড়ে তুলতে পারে। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে অপশক্তির কোন ষড়যন্ত্রই ক্ষতির কারণ হয় না। হবেও না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেছিল। আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিল অধিবেশনে দলটি চাঙ্গা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দলের ভেতর অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বের করে দেয়ার কথা বারবার বলা হলেও কার্যত তেমন কোন ঘটনা দৃশ্যমান হয়নি। আওয়ামী লীগ এবারের কাউন্সিলে নতুন রক্তপ্রবাহ করতে চায়, যে রক্ত দূষিত নয়। জনগণ চায় আওয়ামী লীগ থাকুক আওয়ামী লীগেই। নীতি-আদর্শের ধারায় প্রবাহিত হতে থাকুক বাঙালীর স্বপ্নপূরণে। লেখক : মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
×