ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জোট ও দলে ভাঙ্গা গড়ার খেলা

বড় ছোট সব প্ল্যাটফর্মেই সঙ্কট ॥ নেতাদের বিকল্প বলয় গড়ার চেষ্টা

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

বড় ছোট সব প্ল্যাটফর্মেই সঙ্কট ॥ নেতাদের বিকল্প বলয় গড়ার চেষ্টা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আন্দোলন ইস্যুতে সৃষ্ট কোন্দলে বিএনপিসহ ছোট-বড় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটে ভাঙ্গনের ঘটনা ঘটছে। ভাঙ্গনে জর্জরিত দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন জোটের দু’একটি থাকলেও অধিকাংশই বিরোধী অংশ বা জোটের। এর মধ্যে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দলগুলো বেশি ভাঙছে। অথচ বিরোধী দল বা জোটের পক্ষ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে বারবার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানো হচ্ছে। অথচ নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে পারছে না। বিভিন্ন দল ও জোট ভেঙ্গে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাচ্ছেন নেতারা। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব ও গঠনমূলক রাজনীতি-চর্চার অনুপস্থিতির কারণেই দলগুলোতে এভাবে ভাঙ্গন চলছে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তারা উদ্বেগ জানিয়ে বলছেন, বিরোধী অংশের চলমান ভাঙ্গন গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়। এতে সরকারবিরোধী সমালোচনা কমবে। বাড়বে একাধিপত্য রাজনৈতিক চর্চা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ গণফোরাম, কর্নেল অলির নেতৃত্বাধীন দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), রাশেদ খান মেননের দল ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন দল জেএসডি, বাম জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জোটে ভাঙ্গনের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে। এরমধ্যে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় কর্নেল অলি জামায়াত নেতাদের নিয়ে পৃথক রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ঘরে বাইরে ভাঙ্গনের মুখে গণফোরাম ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। চাপের মুখে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। প্রশ্ন হলো যেসব রাজনৈতিক প্ল্যাট ফরম থেকে বারবার জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে সেখানেই ঐক্যের ঘাটতি কেন। তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা তাদের পক্ষ আদৌ সম্ভব কি না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর রাজনৈতিক ব্যর্থতায় জাতীয় ঐক্য খুব একটা দেখা যায়নি। তবে বারবার বিভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ২০০১ সালে এক অক্টোবর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইয়ের আবিষ্কার তখনই। সাবেক বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় গ্রেনেড হামলাসহ ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে বিএনপির আমলে। তখন সারাদেশে বিএনপি জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে সব পক্ষের মানুষ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা শফি আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক ইস্যুতে দেশবাসীকে একটি প্ল্যাটফর্মে এনে আন্দোলন করার বাস্তবতা অনেকদিন দেশে নেই। এর বড় কারণ হলো রাজনৈতিক দল ও জোটে আস্থাহীনতা ও ঐক্যের সঙ্কট। নিজেদের মধ্যে অব্যাহত ভাঙ্গন। মূলত এসব কারণে বিরোধী দলগুলো আস্তে আস্তে স্তিমিত হচ্ছে। যা রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। তাছাড়া আরেকটি বাস্তবতা হলো, গত তিনবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। এখন দেশে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ নেই। মানুষ ভাল আছে। তাই বিনা কারণে কেউ আন্দোলনের ডাক দিলে মানুষ মাঠে নামবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবশেষ ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে সরকারবিরোধী আন্দোলনের আলোচিত প্ল্যাটফর্ম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন এই দল থেকে সিনিয়র এক নেতাকে বহিষ্কার করাকে কেন্দ্র করে সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতনের নেতৃত্বে একটি অংশ বেরিয়ে গেছে। সম্প্রতি আবদুল মালেক রতনসহ আট নেতা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, তারাই মূল জেএসডি। এমনকি জেএসডির আগামী সম্মেলনকে অবৈধ দাবি করে কনভেনশনের ডাকও দিয়েছেন রতনপন্থীরা। এ বিষয়ে রতন বলেন, এককভাবে দল পরিচালনা করতে গেলে সবাই সব সময় তা মেনে নাও নিতে পারেন। আমরা দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খুব একটা দেখিনা। তাই আমাদের নিজেদের মধ্যে যেমন অনৈক্য অন্য দলগুলোতেও হয়ত একই কারণে দ্বিধা বিভক্তি। সম্প্রতি ভাঙ্গনের মুখে পড়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দল কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি)। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জেরে অলি আহমদকেই বাদ দিয়ে একই নামে আরেকটি দলের ঘোষণা দেন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। সংবাদ সম্মেলন করে তার নতুন প্ল্যাটফর্ম ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন এলডিপির পদবঞ্চিত নেতারা। যদিও এরপর সম্প্রতি এলডিপির এক সভায় সেলিমের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন অলির অনুসারীরা। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ করে অলি আহমেদ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না। আমরা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে শক্তিশালী করতে চাই। এ জন্য মুক্তিমঞ্চ করার প্রয়োজনীয়তা নেই।’ ২০০৬ সালে বিএনপি থেকে বেরিয়ে এলডিপি গঠন অন্যায় ও পাপ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এলডিপির নেতা শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘এলডিপি গঠন করে যে অন্যায় ও পাপ করেছি, আশা করি বিএনপি সে অন্যায় এবং পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেবে। ২০০৬ সালে এলডিপি গঠনের সময় থেকেই শাহাদাত হোসেন দলের যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন। ১৩ বছর পর তিনি বলেন, অলি আহমেদের সঙ্গে রাজনীতি করা আর সম্ভব নয়। এলডিপির আহ্বায়ক আবদুল করিম আব্বাসী বলেন, উনি নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করেন না। তিনি একবার এদিকে আরেকবার ওইদিকে দৌড়ান। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘অলি আহমেদ এলডিপিকে তার পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন। তিনি অকুণ্ঠভাবে জামায়াত ইসলামকে যেভাবে সমর্থন দিচ্ছেন, সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, এটা তিনি পারেন না। এর সঙ্গে আমাদের দ্বিমত আছে। আমরা তার কমিটি মানি না। ২০০৬ সালে বিএনপির ক্ষমতার শেষ দিকে দলে বড় ধরনের বিদ্রোহ হয়। তখন বিএনপির ৩২ জন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ ১০২ জন নেতা একজোটে বেরিয়ে গিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য অলি আহমেদের নেতৃত্বে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপি গঠন করে। একপর্যায়ে এলডিপি ও এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ একীভূত হয়। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পরে দুই দল আলাদা হয়ে যায়। এছাড়া সরকারবিরোধী অংশের প্রধান দল বিএনপি থেকেও পদত্যাগ করেছেন বা সরে গেছেন দলটির বেশ কয়েকজন নেতা। এদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, শমসের মবিন চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় জোটের শরিক দলগুলোর সমালোচার মুখে বিএনপি। নিজ দলের অনেক নেতাও ঐক্যফ্রন্ট করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে জোট থেকে বেরিয়ে যায় শরিক দলের আরও বেশ কয়েকজন নেতা। তাছাড়া গত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থেকেও সমমনা কয়েকটি দলকে সঙ্গে নিয়ে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে আরেকটি জোট গড়ে তোলেন এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। নেতৃত্বের কোন্দলে গণফোরাম থেকে দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু ও রফিকুল ইসলাম পথিকসহ আরও কয়েকজন বেরিয়ে গিয়ে বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
×