ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

জাতীয় কাউন্সিলে প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

জাতীয় কাউন্সিলে প্রত্যাশা

ইতিহাস, ঐতিহ্য আর উন্নয়নের ধারক বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের একুশতম জাতীয় সম্মেলন আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর। রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠেয় এ সম্মেলন ঘিরে দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক উদ্দীপনা বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে দলের শুদ্ধতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। এটি একটি ইতিবাচক বার্তা। কাজেই আমরা আশা করতে পারি, দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা বাড়াতে এবারের কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। শুধু তাই নয়, বরং বিভাগ বা জেলা পর্যায়ের কিছু সাংগঠনিক নেতা এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্রে স্থান করে নিতে পারেন। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্য বিদ্যমান। সে ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি দলটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে কিনা, সেটাই বা কে জানে। তুলনামূলকভাবে নতুনদের নিয়ে দল গঠনে আওয়ামী লীগ একটি চমক সৃষ্টি করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশবাশীর প্রত্যশা, এবারের কাউন্সিলে মাধ্যমে দলের বিভিন্ন পদে চমক আসবে। নবীন-প্রবীণের সংমিশ্রণে দলটি সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে, সেই প্রত্যাশা সকলের। একুশতম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে। এর মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির মতো জেলা-উপজেলা কমিটিতে উপদেষ্টার সংখ্যা নির্দিষ্ট করা, আইনজীবীদের সংগঠন ‘আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের’ নামের স্থানে ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ’ করা। প্রাথমিক সদস্য পদের ফরমে মোবাইল ফোন নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর সংযুক্ত করা। এ ছাড়া কিছু শব্দ ও ভাষাগত পরিমার্জন আসবে গঠণতন্ত্রে। সাধারণত প্রতিটি সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়ে থাকে। দলের সভানেত্রী পদে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই বললেই চলে। একমাত্র ব্যক্তি শেখ হাসিনার আলোয় আলোকিত বর্তমান দল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের কর্মীরা যদি শেখ হাসিনার মতো করে মুজিবের আদর্শ বুকে ধারণ করত এবং সংগঠনের জন্য কাজ করত, তবে সংগঠন ও দেশ দুটোই উপকৃত হতো। দলের জন্য যেমন শেখ হাসিনার প্রয়োজন, ঠিক তেমনি দেশের জন্যও শেখ হাসিনার দরকার। কাজেই দলের সভাপতি পদে যে পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা নেই; সেটা বহুলাংশে নিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। দলের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা এবং দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাজায় রাখার স্বার্থে শেখ হাসিনা অদ্বিতীয়। এবারের সম্মেলন ঘিরে তিনটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দলের ভেতরে-বাইরে। সেগুলো হচ্ছে, সাধারণ সম্পাদক পদে কি পরিবর্তন আসছে, নাকি ওবায়দুল কাদেরই থাকছেন? বঙ্গবন্ধু পরিবার থেকে কেউ কি কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাচ্ছেন? শুদ্ধি অভিযানের কারণে কারা বাদ পড়ছেন? সার্বিক বিচারে সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন তুঙ্গে। এ পদে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক বহাল থাকবেন কিনা, সেটাই এখন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে মুখ্য আলোচনার বিষয়। দলের মধ্যে যারা ত্যাগী, আদর্শিক, সৎ, দুঃসময়ের সঙ্গী তাদের নিয়ে প্রবীণ ও তরুণদের সমন্বয়ে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা হতে পারে। আরও একটি কথা না বললেই নয় যে, আওয়ামী লীগে প্রচুর মেধাবী তরুণ রয়েছেন, যারা দলে কোন পদ-পদবিতে নেই। ফলে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। এই মেধাবী তরুণদের সম্পৃক্ত করতে পারলে দল সাংগঠনিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী হবে। একসময় রাজনৈতিক সহিংসতা এদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, রাজনৈতিক মত-পার্থক্য, সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নিরসন না করে মীমাংসার পদ্ধতি হিসেবে বেছে নেয়া হয় সহিংসতাকে। এ ছাড়াও বিরোধী দল এবং সরকারী দলের মধ্যে বিরাজমান দূরত্ব একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। যদিও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী দল একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় লক্ষ্য করা যায়, বিরোধী দল শুধু বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে এটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ নিদারুণ বাস্তবতা হচ্ছে বিরোধী দল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতদিনেও কোন প্রকার জনবান্ধব ইস্যু নিয়ে বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে পারেনি। শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে। কাউন্সিলে যে কমিটি হবে তার প্রতি যেন দলের সব নেতাকর্মীর সমর্থন ও আনুগত্য থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, নতুন কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীরা বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তেমনটি হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। কারণ, নতুন নেতৃত্ব না এলে দলকে সুসংগঠিত করা সম্ভব হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, দল এবং সরকার দুটো ভিন্ন বিষয়। দলের একটি অংশ সরকার পরিচালনায় ব্যস্ত থাকে। সে কারণে দলের নেতৃত্বে যারা থাকবেন, তাদের হতে হবে চৌকস ও সচেতন। যারা সরকারের মন্ত্রী হন, তাদের দল পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া উচিত নয়। আর যারা দল পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন, তাদেরও সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়া উচিত নয়। অন্যথায় দলটি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, কাউন্সিলের পর ঐতিহ্যবাহী এ দলটি বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে আরও মনোযোগী হবে। প্রতিটি স্তরে গণতন্ত্রায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দলের কাজকর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আসবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতানুগতিক ধারা বদলাতে হবে। অন্যথায় প্রকৃত গণতন্ত্র সুদূরপরাহত। আসন্ন জাতীয় কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিবর্তনের পাশাপাশি দরকার অধিক পরিমাণে গণতন্ত্রের চর্চা। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত দলে গণতন্ত্রায়ণ হবে বলে আশা করছি। এ কাউন্সিলের মাধ্যমে সরকার থেকে দলের অবস্থান আলাদা করতে পারলে সেটা হবে বিশাল বড় অর্জন। আওয়ামী লীগের কাছে আপামর মানুষের প্রত্যাশা বেশি। সে কারণে আওয়ামী লীগের আসন্ন কাউন্সিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দলে সংস্কার প্রয়োজন আছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল নিয়ে দলের নেতাকর্মী তো বটেই, সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, দলের কাউন্সিলে পরীক্ষিত প্রবীণ নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হলে তা দল ও জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে সর্বক্ষেত্রে তরুণ, গতিশীল, যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বই প্রত্যাশিত। জাতীয় কাউন্সিলে কি তার প্রতিফলন ঘটবে? অন্যান্য বড় দলের সঙ্গে তুলনা করলে স্বীকার করতে হবে, একমাত্র আওয়ামী লীগের মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে, বর্তমান গণতন্ত্র পর্যাপ্ত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দিন বদলের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিল। বাস্তবেও দিন বদলে গেছে। বর্তমানে রাজনীতির ধরন বদলে গেছে। রাজনীতি করতে গেলেই সন্ত্রাসী লাগবে, প্রচুর টাকা-পয়সা লাগবে ইত্যাদি ধারণা ধীরে ধীরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের মধ্যে একটি শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা দলকে শুধু ব্যবহার করে টাকা রোজগারের মাধ্যম হিসেবে। তাদের পরিহার করে নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে পারলে দলটি সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হতে পারে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে ঘিরে সকলের প্রত্যাশা এই যে, সাংগঠনিক নেতাদের বড় পদ দেয়া হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা দল গঠনের ক্ষেত্রেও নবীন ও প্রবীণের সমন্বয় ঘটাবেন বলে আশা করছেন অনেকে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে সামনে রেখে আমাদের প্রত্যাশা, নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তরুণ প্রজš§কে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। মনে রাখতে হবে যে, গণতন্ত্র চর্চার অভাবে একটি শক্তিশালী দলও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সে বিবেচনায় আওয়ামী লীগের ভেতরে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা বাড়ানো আবশ্যক। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে চান। আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের লক্ষ্যে জাতীয় সম্মেলন সফল হোক- সেই প্রত্যাশা রইল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে সোনার দেশ গড়তে নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে হবে। আওয়ামী লীগ দেশের শাসক দল। ফলে সর্বস্তরের মানুষের তীক্ষœ নজর থাকবে এই সম্মেলনের দিকে- এটাই স্বাভাবিক। সকল সম্মেলনেই কিছু পরিবর্তন হয়। এ সম্মেলনেও হবে। তবে মানুষ প্রত্যাশা করে, সেই পরিবর্তন হবে সৎ, নির্লোভ ও শান্তিপ্রিয় মানুষের পক্ষে। লেখক : আইনজীবী [email protected]
×