ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তোয়াব খান

আমার তীর্থ যাত্রা

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯

আমার তীর্থ যাত্রা

(গতকালের পর) স্বাধীন বাংলা বেতারের একনিষ্ঠ কর্মী সাংবাদিক ও শিল্পীদের সঙ্গে একে একে পরিচিত হতে শুরু করলাম। তবে সৌভাগ্যের বিষয়- অনেকেই পূর্ব পরিচিত। বার্তা বিভাগের দায়িত্বের কামাল লোহানী তো সংবাদে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পরে আজাদ ও পূর্বদেশে যোগ দেন। ছিলেন সাদেকিন ও অন্যরা। প্রশাসনের আসফাকুর রহমান, বাংলা সংবাদ পাঠক সৈয়দ হাসান ইমাম, ইংরেজী সংবাদের আলী যাকের ও আলমগীর কবির। আমার সংবাদ ভাষ্যটির নাম দেয়া হলো পিণ্ডির প্রলাপ। শিরোনামেই সুস্পষ্ট বিষয়বস্তু কি থাকছে ভাষ্যটিতে। সত্যি কথা বলতে কি, স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান শোনার জন্য শরণার্থী শিবিরে এবং শিবিরের বাইরে আশ্রয় গ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। শুধু যে শরণার্থীরাই অনুষ্ঠান শুনতেন, এমন নয়। মনে রাখা দরকার একাত্তর সালেই পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই ছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে আগত। এরা সকলেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একনিষ্ঠ শ্রোতা। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হওয়া সম্প্রচারটি চলত সন্ধ্যা থেকে ৪/৫ ঘণ্টা। সকালেও অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার মধ্যে সংবাদ, সংবাদভাষ্য, দেশাত্মবোধক গান, নাটক ইত্যাদি ছিল। প্রচার করা হতো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও ভাষণের চুম্বকাংশ- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল এমআর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’। মুকুল সাহেব ‘চরমপত্র’ নিজে লিখতেন এবং স্বকণ্ঠে ঢাকাইয়া উচ্চারণে বিশেষ বাচনভঙ্গিতে পাঠ করতেন। অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য শরণার্থী শিবিরের লোকজন, বাড়িঘরে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা, পূর্ববঙ্গ থেকে আগত পশ্চিমবঙ্গবাসী এবং রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা সকলেই উদগ্রীব হয়ে থাকত কখন চরমপত্র প্রচারিত হবে তার প্রতীক্ষায়। এছাড়াও পাকিস্তানের লম্পট স্বৈর সেনাশাসক ইয়াহিয়া খানের কার্যকলাপ নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক ধারাবাহিক নাটক জল্লাদের দরবারও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অমর রণধ্বনি ‘এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এটা লক্ষবার প্রচারেও তার আকর্ষণ বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি। প্রতিবারে প্রচারে মানুষকে নতুন করে উদ্দীপ্ত করত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কোন দেশের প্রতিষ্ঠিত রেডিও স্টেশন নয়। এটি মুক্তিযুদ্ধের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবেই কাজ করছিল। শত্রুর প্রতিটি পদক্ষেপ মোকাবেলায় মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে সহায়তা করা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্তব্য। একটি বাড়ির কয়েকটি কক্ষে অফিস রুম, নিউজ রুম, অনুষ্ঠান রেকর্ডিং রুম, প্রশাসনিক কাজকর্মের ব্যবস্থা ছিল। অনুষ্ঠান রেকর্ড ও ধারণ করে সম্প্রচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। গোপনীয়তা রক্ষা করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে না পারলে মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা অবধারিত ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতারের কাজ পূর্ণোদ্যমে চলছে। এমন সময়ে খবর এলো হাকিমপুর থেকে পাকি বাহিনীর শেলিংয়ে গ্রামে কয়েকজনের মৃত্যু ঘটেছে। এ অবস্থায় আমার বাবা-মা আমার স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন। তারা মনে করেন, আমার সন্তানদের সীমান্তের গ্রাম থেকে যেন কলকাতায় নিয়ে যাই। দিন- তারিখও ঠিক হয়ে গেল। কলকাতার বেলেঘাটা এলাকায় সস্তায় দু’কামরার একটি বাড়িও পাওয়া গেল। বেলেঘাটা এক সময়ে ছিল নকশাল প্রভাবিত এলাকা। নকশাল নির্মূল অভিযান শুরু হওয়ার পর সেখানে খুন, গুম ইত্যাদি নিত্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সন্ত্রাস, খুন, গুম আর সিআরপি’র ভয়ে এই এলাকায় কলকাতার নাগরিকদের বাড়ি ভাড়া নিতে নিদারুণ বিতৃষ্ণা ছিল। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের মতো। সবখানেই একই অবস্থা। তবে এটাও শুনেছি, নকশালরা জয় বাংলার লোকদের ঘাঁটাতে চাইত না। সিআরপি বা প্রাদেশিক পুলিশ তো শরণার্থীদের সাহায্যই করত। যাই হোক বেলেঘাটায় বাসা ভাড়া নেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর আমার ছিল না। মধ্যরাতে বিধান রায় শিশুপার্ক থেকে গুলির আওয়াজ শুনলেও কি করা যাবে। পাকিস্তানী সেনা স্বৈরশাসক চক্রের অবস্থা ক্রমান্বয়ে চরম পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত বিচার প্রহসনের সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানীরা মধ্যস্থতা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন গোপনে চীন সফরে গেলেন পাকিস্তান হয়ে। তাদের লক্ষ্য, ভারতের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করা। নিক্সনের ভারতবিরোধী মনোভাব সুপরিজ্ঞাত। তিনি তো এক সময়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে খুব বাজে ভাষায় গালিগালাজ করেছিলেন [কিসিঞ্জারের হোয়াইট হাউস ইয়ার্স দ্রষ্টব্য]। অন্যদিকে শান্তশিষ্ট হয়ে বসে থাকার মতো অবস্থা ভারতের ছিল না। আত্মরক্ষার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ভারতের জন্য জরুরী হয়ে দেখা দেয়। মিসেস গান্ধী এই সময়ে দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। প্রথমত, সশস্ত্র সংঘাত পরিহার করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধের নিষ্পত্তি, দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন বন্ধ করা। এজন্য তিনি ওয়াশিংটন সফরও করেন। কিন্তু নিক্সন প্রশাসনের একগুঁয়ে নীতি দৃশ্যত মিসেস গান্ধীকে হতাশই করে। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের বিশ্ব কূটনৈতিক তৎপরতা এক নতুন পর্যায়ে উপনীত হলো ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। এই চুক্তির মাধ্যমে কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষার গ্যারান্টি প্রদান করে। পক্ষান্তরে নিক্সন প্রশাসন একনাগাড়ে পাকিস্তানকে সব ধরনের সহায়তা ও সাহায্যের আশ্বাস দিলেও মার্কিন জনমত ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে। মার্কিন সিনেটে প্রস্তাব গ্রহণ এবং জোরালো বক্তব্য পেশ ছাড়াও বেসরকারী পর্যায়ে নানা সাহায্য ও সহায়তা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পাঠানো হয়। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দমদমে শরণার্থী শিবিরে অবস্থানকারীদের প্রতি সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। নিউইয়র্কে রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কনসার্ট দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এ্যালেন গিনসবার্গের সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। সামগ্রিকভাবে মার্কিন পত্রপত্রিকা, বুদ্ধিজীবী, লেখক, অধ্যাপকসহ সমাজসচেতন মানুষ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানায়। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও অসমে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সংখ্যা এক কোটিতে পৌঁছে যায়। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর ত্রাণ, চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করা ভারত সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তা সত্ত্বেও মিসেস গান্ধীর সরকার কার্ডের মাধ্যমে রেশন বরাদ্দের মতো প্রতি সপ্তাহে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখে। অক্টোবরের শেষদিকে এবং নবেম্বরে সীমান্ত এলাকার অবস্থা উত্তপ্ত হতে থাকে। একদিকে পাকি দখলদার বাহিনীর শেলিং, অন্যদিকে গেরিলা ও মুক্তিবাহিনী ভারি অস্ত্রপাতি নিয়ে পাকি অধিকৃত এলাকায় প্রবেশ করতে শুরু করে। পাকি বাহিনীর বেপরোয়া গোলাগুলি বর্ষণও চলতে থাকে। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর মুজিবনগর সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের সব দলের সরকারে পরিণত করার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা লক্ষ্য করা গেলেও সেটা বাস্তবায়নের কোন সুযোগ ছিল না। কারণ, মুজিবনগরে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ভিত্তিই ছিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরাই মুজিবনগরে সমবেত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে জারি করেন। এটাই মুজিবনগর ঘোষণপত্র হিসেবে পরিচিত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মূল ভিত্তি। নির্বাচনে বিজয়ী প্রতিনিধিরাই সরকার ঘোষণার আইনগত ও আনুষ্ঠানিক এখতিয়ারের অধিকারী। তাই সর্বদলীয় সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য দলের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার উদ্দেশে গঠন করা হলো উপদেষ্টা পরিষদ। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মুজাফফর), বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও জাতীয় কংগ্রেস- উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। এভাবে ক্রামান্বয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের ভেতরের আপোসকামীদের চরিত্রও উন্মোচিত হতে থাকে। কুমিল্লার এক সংসদ সদস্য কলকাতায় মার্কিন উপরাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাত করে মধ্যস্থতার তাগিদ দিতে থাকেন। হেনরি কিসিঞ্জার ও লরেন্স লিপসুজের লেখা বইয়ে এদের বিবরণ দেয়া আছে। এরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে স্বায়ত্তশাসন মেনে নিতে সম্মত আছে বলে জানায়। খন্দকার মোশতাক তো বলেই ফেলেন- স্বাধীনতা না বঙ্গবন্ধুর মুক্তি কোন্টা চাও জানাও। যেন দুটো বিনিময়যোগ্য। বাংলাদেশের মানুষ ত্রিশ লাখ জীবন দিয়েছে। দুটো দাবিকে অর্জনের জন্য আরও ত্রিশ লাখ শহীদ হতে দ্বিধাবোধ করবে না। মোশতাক গংয়ের এই বোধশক্তি লোপ পেয়েছিল। তাই তারা মার্কিন উপদূতাবাস এবং ইরানের শাহেনশাহের মাধ্যমেই চক্রান্তের জাল বিস্তারের চেষ্টা করছিল। আর এ কাজে মোশতাকের মূল পা-া ছিল পররাষ্ট্র সচিব পদে অধিষ্ঠিত মাহবুবুল আলম চাষী। এদের চক্রান্ত ফাঁস হওয়ার পর ভারত সরকার মোশতাকের কর্মতৎপরতার ওপর অলিখিত বিধিনিষেধ আরোপ করে, এমন খবর মুম্বাইয়ের সাপ্তাহিক ব্লিৎস পত্রিকায় ছাপা হয়। বাংলাদেশ সরকার চাষীকে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে অপসারণ করে। প্রবীণ কূটনীতিক আবুল ফতেহ পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্ত হন। আমার কাছেও এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, কেন তাহের ঠাকুর আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করতে দিতে চাননি। নবেম্বরের শেষদিকে রণাঙ্গনের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচ- আক্রমণের মুখে পাকি দখলদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ডিসেম্বরের শুরুতেই পাকিদের বস্তুত দহনকাল আরম্ভ। কোন কোন স্থানে মুক্তিবাহিনীর বড় ধরনের বিজয়ও করায়ত্ত হয়। ৩ ডিসেম্বর মিসেস গান্ধী এলেন কলকাতায়। গড়ের মাঠের ময়দানে তাঁর ভাষণ দেয়ার কথা। সব মহলেই নানা গুঞ্জন। পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার ঘোষণা তিনি দেবেন। মুজিবনগর সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের ঘোষণাও আসতে পারে। এসবের নানাদিক আলোচনা করতে করতে আমরা কয়েকজন গেলাম ময়দানে শ্রীমতি গান্ধীর বক্তৃতা শুনতে। মিসেস গান্ধী তার ভাষণে বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর কোনটির ধারেকাছে গেলেন না। পরিবর্তে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনা করে গেলেন। তিনি বললেন, যুদ্ধ মানেই মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে আমি লন্ডনে ছিলাম। দেখেছি, মানুষ একটি রুটির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শীতে কী কষ্টটা স্বীকার করছে। শীতে ঘরে বিদ্যুত নেই। জার্মান বোমা বর্ষণে বিদ্যুত লাইন উড়ে গেছে। যুদ্ধের দিনগুলোতে ব্রিটিশরা কত ধৈর্য ধরে এসব সহ্য করেছে। আমি চাই না ভারতের মানুষ এমন কষ্ট পাক। বক্তৃতা শুনে ফিরে এলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। বন্ধুরা সকলেই মোটামুটি হতাশ। মিসেস গান্ধী পাকিস্তানের নিন্দা করা তো দূরস্থান তাদের নাম পর্যন্ত নেননি। বাংলাদেশ বিষয়েও একই ধরনের নীরবতা। কোথায় কূটনৈতিক স্বীকৃতি অথবা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সহায়তার কথা! বাংলাদেশের কথা উল্লেখই করলেন না। আমাদের ভুল ভাঙল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। সন্ধ্যায় ঘোষণা হলো, পাকিস্তান ভারতের কয়েকটি স্থানে একযোগে আক্রমণ করেছে বিমান থেকে বোমা বর্ষণের মাধ্যমে। এ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান থেকে পাল্টা আক্রমণ করে তাদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশ্চিম রণাঙ্গনেও হামলা চালিয়েছে ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বহর নিয়ে। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরন সিং কেউই দিল্লীতে ছিলেন না। মিসেস গান্ধী কলকাতায়, জগজীবন রাম বিহারে, শরন সিং পাঞ্জাবে। সবাই এখন দিল্লী ফিরছেন। মিসেস গান্ধী বিশেষ বিমানে কলকাতা থেকে দিল্লী চলে গেলেন সন্ধ্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই। দেশের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ এসব ভিআইপির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সব কয়টি মেশিনই যথাসময়ে সঠিক কাজটি করে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়- কেন মিসেস গান্ধী জনসভায় যুদ্ধের ভয়াবহতা আর কষ্ট স্বীকারের কথাই শুধু বলে গেলেন। তার আহ্বান ছিল মূলত ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের জন্য। তিনি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ এবং কষ্ট স্বীকারে তৈরি থাকার জন্য জাতিকে সজাগ করে গেলেন। গভীর রাতে মিসেস গান্ধী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন আকাশবাণী থেকে। ডিসেম্বর ৪ তারিখে ভারত ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হলো। মিসেস গান্ধী বললেন, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন দেশ। ৪ ডিসেম্বর ভুটান স্বীকৃতি দিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে এলো ভারতীয় স্বীকৃতি। এরপর আর আমাদের পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সামনে শুধু প্রসারিত দিগন্ত। প্রথম দিনেই বাংলাদেশের আকাশ একেবারে মুক্ত। পাকিদের সব বিমান শেষ। প্রতিদিনই পাকি দখলদাররা লোটা-কম্বল ফেলে পালিয়েছে উর্ধশ্বাসে। তাদের প্রতিটি রক্ষাব্যূহকে বাইপাস করে অর্থাৎ পরিহার করে মিত্রবাহিনী এগিয়ে গেছে ঢাকা অভিমুখে। একে একে মুক্ত হয়েছে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, ময়মনসিংহ। যৌথ বাহিনী একেবারে ঢাকার দোরগোড়ায়। ইতোমধ্যে খবর পাওয়া গেল- পাকি হানাদার বাহিনী তাদের পোষ্য দালাল জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক চক্র আলবদর, আলশামসের মাধ্যমে দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আলবদর, আলশামসের অনেকেরই ফাঁসি হয়েছে। তবুও জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ঘাটতি তো রয়েই গেছে। জাতি দিনটি স্মরণে প্রতিবছর পালন করছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ ৯১ হাজার পাকি দখলদার সেনা বিনাশর্তে মিত্রবাহিনীর কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরা এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। পাকি দখলদারদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান লেখা হলো তাৎক্ষণিকভাবে- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই বাংলার ঘরে ঘরে।’ সুর দিলেন সুজেয় শ্যাম। সুরের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল বাংলার ঘরে ঘরে। এরপর মুক্ত স্বদেশে ফেরার পালা। ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করছি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এমন সময় জানানো হলোÑ কাল অর্থাৎ ২৩ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার দেশে ফিরে যাবে সন্ধ্যায়। সকালে স্বাধীন বাংলা বেতারের একটি বিশেষ দল ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ বিমানে ঢাকা যাবে। এই বিমানে আমাকেও যেতে হবে। এই দলটিকে একটি বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঢাকায় ফিরে রেডিও বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সম্প্রচার চালু করতে হবে। নানা ঝুটঝামেলায় বিগত কিছুদিন যাবত ঢাকা কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ আছে। তারা এ সময়ে শুধু স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারের পরিসমাপ্তি ঘটবে। রাতে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে আমার স্ত্রীর কাছে দিয়ে ভোররাতে ছুটলাম দমদম বিমানবন্দরের উদ্দেশে স্কুটারে করে। শীতে ঠা-ায় হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছিল। তবুও ঘরমুখো বাঙালী কোন বাধাই মানে না। বিমানবন্দরে আরেক বিপত্তি। অনুমোদিত তালিকা থেকে একজন প্যাসেঞ্জার বেশি হচ্ছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘোরতর আপত্তি জানাল। অনুমোদিত তালিকার বহির্ভূত কাউকে বিমানে উঠতে দিতে তারা রাজি নয়। অনেক দেন-দরবার করে বুঝিয়েসুঝিয়ে নিরাপত্তা গ্যারান্টির বন্ডে সই-স্বাক্ষর করিয়ে তারা ক্ষুব্ধ সম্মতি জানাল। বিমানটি হেলিকপ্টারের চেয়ে একটু উন্নত ধরনের। তাতে আবার মালপত্তর বোঝাই। তবুও সময়মতো ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছানো গেল। নমো নমো নমো, সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ তথা মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য মে মাসে আমার যে তীর্থ যাত্রা শুরু হয়েছিল, তেজগাঁওয়ের মাটি স্পর্শ করেই তার প্রথম পর্যায় শেষ হলো। (সমাপ্ত) লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ
×