ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পথে পথে লাল সবুজের মিছিল

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯

পথে পথে লাল সবুজের মিছিল

মনোয়ার হোসেন ॥ একটি পতাকার জন্য হয়েছিল প্রাণক্ষয়ী যুদ্ধ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতার প্রতীকী পতাকা। বিজয় দিবসে পথে পথে ঘুরেছে সেই পতাকার রঙের লাল-সবুজের মিছিল। মনের রঙে ভিজেছে শরীর। জাতিসত্তার জন্মের অহঙ্কারে জেগেছে আত্মা। বাঙালীর বিজয় দিবসে পোশাকে দৃশ্যমান হয়েছে প্রাণপ্রিয় পতাকা। কপালবন্ধনী থেকে শুরু করে শরীরের নানা অঙ্গজুড়ে উঁকি দিয়েছে মাতৃভূমির মমতামাখা দুটি বিশেষ রং লাল-সবুজ। শিশুর হাতের মুঠোয় ভর করে অলিগলি থেকে শহরের প্রশস্ত সড়ক প্রদক্ষিণ করেছে সবুজে আবৃত লালবৃত্তের পতাকা। রাষ্ট্রীয় স্থাপনা থেকে দালানকোঠার ছাদে ছাদে উড়েছে পতাকা। এভাবেই প্রাণের আবেগে লাল-সবুজের প্রতি ভালবাসায় ধরা দিয়েছে বিজয় দিবস। সকাল থেকেই লাল-সবুজের পাঞ্জাবি আর সবুজ জমিনে লালপাড়ের শাড়ি পরে নগরজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে অগণন নরনারী। রমণীর কপালের টিপে ঠাঁই পায় জাতীয় পরিচয়ের প্রতীকী সেই রং। শহীদের রক্তঋণে কেনা পতাকার গৌরবে উজ্জ্বল ছিল বাবা-মার সঙ্গী হওয়া শিশুর মুখ। কচি মুখগুলোর চাওয়া ছিল উন্নতির সোপানে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ। সব বাধা পেরিয়ে পৌঁছুতে হবে সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির স্বদেশ বিনির্মাণের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। তাহলেই আসবে প্রকৃত স্বাধীনতা। বিবর্ণ হবে না প্রাণপ্রিয় জাতীয় পতাকার রং। সোমবার আটচল্লিশতম বিজয় দিবসে এমন বর্ণিল রূপে ঝলমল করেছে রাজধানী। অলিগলি থেকে রাজপথে চোখে পড়েছে বর্ণিল উৎসব। সকাল থেকেই রাস্তায় ভিড় জমিয়েছে বিজয় দিবস উদ্যাপনে বেরোনো পতাকার রংমাখা নাগরিকরা। উদ্যাপনের সুন্দরতম দৃশ্যপটে নয়ন জুড়িয়েছে শহর চষে বেড়ানো সবার পোশাকে। নারী, পুরুষ কিংবা শিশুর পোশাকে বিস্তৃত হয়েছে চেতনার রং লাল-সবুজ। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে বাড়ির ছাদ, রাস্তার মোড়ে মোড়ে উঁকি মেরেছে ভালবাসার ওই দুটি রং। স্বাধীনতার প্রতীকী ওই দুটি রং যেন স্বদেশের পক্ষ হয়ে বলেছে, বাংলাদেশ এখনও পৌঁছেনি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। এখনও বাকি আছে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। সেই লড়াইয়ে প্রেরণার উৎস হবে লাল-সবুজ। মানবিক সমাজের কথা বলবে পতাকার রং। আদায় করে নিতে হবে সোনার বাংলার স্বপ্নমাখা শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণ। তাহলেই ধরা দেবে প্রকৃত স্বাধীনতা। নগরের পথে-প্রান্তরে-বাতাসে দোল খাওয়া পতাকা বয়ে বেরিয়েছে ফেরিওয়ালারা। কিছু পয়সার বিনিময়ে লাল-সবুজের মাঝে হলুদের মানচিত্র আঁকা এসব পতাকা উঠে এসেছিল পরিবারের শিশুসন্তানের হাতে। সোনামণিদের কোমল স্পর্শে ভাাবাসার সেই পতাকা পাড়ি জমিয়েছে মিরপুর থেকে সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ি, ধানম-ি থেকে বনানী, রমনা থেকে বসুন্ধরা, শহীদ মিনার থেকে স্মৃতিসৌধে। বিজয় দিবসে এমন করেই শোভা ছড়িয়েছে পূর্বপুরুষের সংগ্রামে পাওয়া পতাকার রং। ছোটদের গালেও জুড়েছিল শখের আঁকিয়েদের লেপে দেয়া বাঙালীত্বের বিজয়স্মৃতির বর্ণবৈভব। দিনভর বিজয় দিবস উদ্যাপনের মঞ্চে মঞ্চে নাচ-গান করা শিল্পীরাও শরীরে জড়িয়েছিল ওই দুটি রং। লাল-সবুজের প্রতি মানুষের এই ভালবাসা ছিল সকাল থেকে গভীর রাত অবধি। কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে লাল-সবুজের প্রতি তাদের আকুলতার কথা। উঠে এসেছে দেশপ্রেমের বার্তাবহ টুকরো টুকরো অনেক কথা। বিজয় দিবসের বেলা বারোটা। ছুটির আমেজে ভরপুর শহরে বইছিল রাশি রাশি আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ঢাবি ক্যাম্পাসসহ শহীদ মিনারের চারপাশ ঘিরে চোখে পড়ে বিজয় দিবস উদ্যাপনে পথে নামা মানুষের ঢল। চিকচিকে রোদ্দুরে অনেকের শরীরেই দেখা মেলে জাতীয় পরিচয়ের প্রতীকী সেই ভালবাসার রং। ভাষা শহীদদের স্মৃতির স্মারক শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নজর কাড়ে লাল-সবুজ পোশাকে জড়ানো এক নারী। শামীমা আফরিন নামের ওই কর্মজীবীর নারীর পোশাকের সঙ্গে কপালের টিপেও পতাকার রং। জনকণ্ঠকে বললেন, এমন দিনে পোশাকে লাল-সবুজ না থাকলে অতৃপ্ত থাকে মন। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এমনিতে সারাবছরই পোশাক কিংবা সাজসজ্জায় আমরা বেছে নেই ওই দুটি রঙের একটি। আমার কাছে মনে হয়, লাল-সবুজের পোশাক ছাড়া বাঙালী আর বাংলাদেশ হয় না। নতুন প্রজন্মের অনেকের মাঝে দেশপ্রেমের অভাব দেখে প্রায়ই হতাশ হই। তখন মনে হয়, এই লাল-সবুজ রংই একদিন তাদের ভেতর জাগিয়ে তুলবে দেশের প্রতি মমত্ববোধ। একপর্যায়ে আফসোসের সুর থেকে পতাকার রঙের মাঝে আশার আলো দেখা এই দেশপ্রেমিক বললেন, আজ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছে বাংলাদেশ। সমৃদ্ধির সোপান বেয়ে এগিয়ে চলেছে দেশ। তবুও উন্নতির পথে এখনও অনেক বাধা রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী মানুষগুলো অগ্রগতির নানা ক্ষেত্রে দাঁড়ায় বাধা হয়ে। এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও ঘাপটি মেরে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবিশ্বাসী কিছু মানুষ। সেসব বাধা এখনও জয় করতে পারিনি আমরা। তাই একাত্তরে স্বাধীন একটি দেশ পেলেও আসেনি আমাদের কাক্সিক্ষত বিজয়। আজও খুঁজে বেড়াতে হয় স্বাধীনতার মানে। বিশ্বাস করি, এই লাল-সবুজের পতাকাই পৌঁছে দেবে সেই কাক্সিক্ষত বিজয়ের পথে। যেখানে রচিত হবে সম্প্রীতির বাংলাদেশ। থাকবে না ধর্মান্ধতা। মানবিক আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের উদাহরণে পরিণত হবে দেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম সেই কাক্সিক্ষত স্বদেশ বিনির্মাণে রাখবে অগ্রণী ভূমিকা। দোয়েল চত্বর এলাকার আশপাশে পতাকা হাতে বাবা আরিফ রহমানের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মেয়ে আদিবা। বিজয় দিবসে পতাকা নিয়ে ঘুরতে কেমন লাগেÑএমন প্রশ্নের জবাবে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী আদিবা বলেন, এই পতাকা বহনের মাধ্যমে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের, যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই বাংলাদেশ। আর এই লাল-সবুজ তো শুধু আমাদের পতাকার রং নয়, এটা আমাদের অস্তিত্বের অহঙ্কার। লাল-সবুজের মাঝে খুঁজে পাই পাকবাহিনীকে পরাজিত করা বাঙালীর সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের গৌরব। ঢাবি ক্যাম্পাসে টিএসসি এলাকায় কথা হয় কেরানীগঞ্জ থেকে পতাকা বিক্রি করতে আসা রমজানের সঙ্গে। শুধু পতাকাই নয়, তার সঙ্গে ছিল লাল-সবুজের পতাকা থেকে চড়কি, বুকের ব্যাজ, মাথার ব্যান্ডসহ নানা কিছু। ঢাকা শহর ঘুরে ফেরা এই ফেরিওয়ালা বলেন, ডিসেম্বর ধইরাই এই পতাকা বেচছি। দেশের পতাকা বেইচ্যা এই ক’দিন সংসারটা ভালই চলছে। তয় আজকা বিজয় দিবসে বেশি ভাল লাগতাছে। মানুষের মনের আনন্দ দেইখা দ্যাশের লাইগা আরও বেশি মায়া জন্মাইতাছে। ঢাবিতে বিজয় দিবস বিশ^বিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে মহান বিজয় দিবস পালিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিজয় দিবস উদযাপনে সোমবার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচীর আয়োজন করে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ডাকসুসহ টিএসসিভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃৃতিক সংগঠনগুলো। সকাল সোয়া ছয়টায় উপাচার্য ভবনসহ বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচীর সূচনা হয়। সাড়ে ছয়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ‘অপরাজেয় বাংলা’র পাদদেশে জমায়েত। ছয়টা ৩৫ মিনিটে সেখান থেকে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের উদ্দেশ্যে যাত্রা। বিকেল চারটা ১০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ডাকসু ও ছায়ানটের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সঙ্গীতানুষ্ঠান। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় টিএসসি মিলনায়তনে বিজয় দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের চিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়। বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসহ বিভিন্ন হল মসজিদ ও উপাসনালয়ে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য দোয়া মাহফিল হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি ‘সাহসের জয়’ শীর্ষক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। টিএসসি করিডরে আয়োজিত এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আখতারুজ্জামান। বিজয় কনসার্ট মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখার প্রয়াসে ডিএমপি ও ডাকসুর সহযোগিতায় আয়োজন করা হয় এই বিজয় কনসার্ট। ‘গৌরবময় বিজয়ের ৪৮ বছর’ শিরোনামে হাজী মুহম্মদ মহসিন হলের মাঠে বেলা দুটো থেকে শুরু হয় কনসার্ট। অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ঢাবি শহীদ শিক্ষকবৃন্দ ও বাংলাদেশ পুলিশের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান এবং মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঞ্চ মাতান সংগীতস¤্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম, জেমস ও তার ব্যান্ড নগর বাউল এবং চিরকুট ব্যান্ডের শারমিন সুলতানা সুমিসহ অন্য সঙ্গীত শিল্পীরা। বিজয়ের গান গেয়ে শোনান ফকির আলমগীর। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন দেবাশীষ বিশ্বাস ও ইসরাত পায়েল। এতে ছিল বাংলাদেশ পুলিশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও ডাকসুর মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। বিজয় কনসার্ট উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী। অনুষ্ঠানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। বিজয় কনসার্টের অনুষ্ঠান মনোজ্ঞ ফায়ার ওয়ার্কসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
×