বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব রাজাকার আলবদর মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিতসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের বিচার হচ্ছে। ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ আলোকে পাকি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজনৈতিক দল ও শান্তি কমিটি। তাদের আক্রমণে ৩০ লাখ নর-নারী শহীদ হন, প্রায় ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়। প্রায় এক কোটি লোক শরণার্থী হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। অভিযানের সূচনায় জেনারেল টিক্কা খানের আদেশ ছিল আমি মানুষ চাই না, ভূমি চাই’। অভিযানের নির্মমতা চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, এমনকি ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারকেও ছাড়িয়ে যায়। টিক্কার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন জেনারেল রাও ফারমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাদের সেই দোসর রাজাকার আলবদরদের বিচার হচ্ছে। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৪১ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এ ১০৫ আসামির মধ্যে দন্ড দেয়া হয়েছে ৯৫ জনকে, ছয় জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। আরও ৩৩ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে আসামি রয়েছে ২১৫। ’১০ সালের ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রসিকিউশন প্যানেল ও তদন্ত সংস্থা গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইতিহাসের দায় শোধের পালা। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে উড়িয়েছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ছিলেন এরাই দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। একের পর এক মৃত্যুদ- কার্যকরের মধ্য দিয়ে এ কলঙ্ক মোচন করছে জাতি। গত ৯ বছরে কুখ্যাত ৬ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উল্লেখ করে। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী। সেই অনুযায়ীই ’১০ সালের ২৫ মার্চ পুরনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলা কথা বিবেচনা করে ’১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। মামলার সংখ্যা কমে আসায় পরবর্তী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ নামে একটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
এর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) গঠন করেন। এতে সারাদেশে ৭৩ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। দালাল আইন জারির পর ’৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ৩৭ হাজার ৪১৭ দালালকে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় রাজাকার আলবদর আলশামসদের বিচার। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৮৪৮ মামলা নিষ্পত্তি হয়। তার মধ্যে দন্ডিত হয় ৭৫২, খালাস পায় ২ হাজার ৯৬। এরপর সাধারণ ক্ষমায় আরও ৩৭ হাজারের মধ্যে ২৬ হাজার ছাড়া পেয়েছিলেন। ১১ হাজারের বেশি তখন আটক ছিলেন। ’৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নৃশংসভাবে হত্যার ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি সায়েম ও জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করে। ফলে এই ১১ হাজারের পক্ষে আপীল করে জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে।
রাজাকার আলবদরদের বিচারের জন্য ’১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর স্বাধীনতার ৪২ বছরের মাথায় প্রথম রায় আসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল রাজাকার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। এর পর একে একে আরও ৪০টি রায় প্রদান করা হয়। আপীল বিভাগে সাতটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। আর আপীলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ৩১ মামলা। সাত রায়ের মধ্যে ছয়টিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর ও নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপীল বিভাগ চূড়ান্ত রিভিউয়ের রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সাঈদীর সাজা আমৃত্যু কারাদন্ড বহাল রাখা হয়েছে। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলামকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়েছে। এখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আসামি পক্ষ রিভিউয়ের আবেদন করবে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত জাপার সাবেক কৃষিপ্রতিমন্ত্রী ও কায়সার বাহিনী প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপীলের রায় ঘোষণা হবে আগামী ১৪ জানুয়ারি। এছাড়া রায় হওয়ার আগেই মারা গেছে ৮। পলাতক অবস্থায় মারা গেছে ২ জন। এর মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে এক, মৃত্যুদন্ড ৬৯, আমৃত্যু কারাদন্ড ২৪, সশ্রম কারাদন্ড একজনকে। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের মধ্যে আটক আছে ৩৩। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক রয়েছে ৩৬, আমৃত্যু কারাদন্ডের মধ্যে পলাতক ১২, আমৃত্যু কারাদন্ডের মধ্যে আটক ১২, যাবজ্জীবন এক ও সশ্রম কারাদন্ডের একজন।
স্মর্তব্য শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বের করার উছিলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে একাত্তরের ১৫ মার্চ এক দল জেনারেলসহ ঢাকায় এসে কালক্ষেপণ করতে থাকেন ইয়াহিয়া খান। এই কালক্ষেপণের পেছনে গোপন উদ্দেশ্য ছিল নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আসা জেনারেল আব্দুল হামিদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাও ফারমান আলী, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ঢাকা সেনানিবাসে গোপন প্রস্তুতির পরিকল্পনায় নিযুক্ত ছিলেন। ১৮ মার্চ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ পরিকল্পনা নিয়ে বাঙালী সেনাদের নিরস্ত্র করার গোপন চক্রান্তের অভিপ্রায়ে ১৯ মার্চ ঢাকার অদূর জয়দেবপুরে রাজবাড়ীতে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের হাতিয়ার ছিনিয়ে নেয়ার অভিপ্রায়ে লিপ্ত হলে বাঙালী সৈনিকরা তা নস্যাত করে দেয়।
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালীর বিরুদ্ধে হানাদার পাক বাহিনী অভিযান শুরুর পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাত একটা দশ মিনিটে একটি দল পাকি সেনা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ি ঘেরাও করে ব্যাপক গুলি চালায়। বঙ্গবন্ধুকে আটক করে নিয়ে যায় ঢাকা সেনানিবাসে। পরবর্তীতে তাকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে আটক করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুর অন্তরীণ অবস্থায় তারই আহ্বানে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের আপামর মানুষ হানাদার পাক বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিরোধে মরণজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। জামায়াতসহ ডানপন্থী দলগুলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তৎকালীন প্রাথমিক পাকিস্তান সরকারের সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গে সাক্ষাত করে নৈতিক সমর্থন দেয়। জামায়াতে ইসলামীসহ ডানপন্থী দলগুলো তৎকালীন হানাদার পাকিস্তান সরকারের সেনাদের পরামর্শে কথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে ’৭১ সালের ৯ এপ্রিল ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করে। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৭১ সালের মে মাসে জামায়াত নেতা মাওলানা একেএম ইউসুফ খুলনার খান জাহান আলী রোডে আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জামায়াত কর্মীকে নিয়ে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করে।
১০ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত ১৬৯ জনের মধ্যে ১৬৭ প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার আলোকে মুজিবনগরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা জারি করেন। এক পর্যায়ে ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: