ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উদ্ধার করা হয় দুই পিকআপ ভর্তি মানুষের কঙ্কাল

কুষ্টিয়ার বৃহৎ বধ্যভূমি বিত্তিপাড়া

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

কুষ্টিয়ার বৃহৎ বধ্যভূমি বিত্তিপাড়া

একাত্তরে কুষ্টিয়ায় নরপিচাস পাক সেনাদের সঙ্গে মিলে এদেশের স্বাধীনতাকামী, নিরাপরাধ বাঙালীর রক্তে যারা হাত রাঙ্গিয়েছিল সেই পালের গোদাদের অন্যতম ছিল বৃহত্তর কুষ্টিয়া পিস কমিটির চেয়ারম্যান শহরের কোর্টপাড়ার এ্যাডভোকেট সা’দ আহমেদ, আড়ুয়াপাড়ার ইয়াকুব আলী, একই এলাকার মুসলিম লীগের ঘুনষি, শেখ আহম্মদ আলী মুন্সি, মিলপাড়ার রাজাকার কুটিখান, শরফু বিহারী, সিরাজ, আমলাপাড়ার মুসলিম লীগের ইয়াকুব মিয়া, রক্সি সিনেমা হলের মালিক হাশেম খান বিহারী, রাজাকার জল্লদ খ্যাত মজিদ বিহারী। এছাড়াও অনেকেই ছিল ওই কিলিং মিশনে। তাদের নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হন হাসান ফয়েজ, সবুরমিয়া, শামসুলহুদা, আবুল কাশেম ও আবুল হাসনাতসহ অন্তত ৬০ হাজার বাঙালী। অপরদিকে পাক সেনা, রাজাকার, শান্তি কমিটি ও বিহারীদের ভোগের সামগ্রী হয় অন্তত দুই হাজার মা-বোন। সেদিন ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ যুদ্ধ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২৫ মার্চ কাল রাতে মেজর শোয়েব’র অধিনায়কত্বে¡ পাক বাহিনীর ২৭ বেলুচ রেজিমেন্ট এ কোম্পানির ২১৬ জন হানাদার যশোর থেকে কুষ্টিয়ায় এসে অবস্থান নেয়। তারা ২৬ মার্চ শহরে একনাগাড়ে ৩০ ঘণ্টার কারফিউ জারি করে সশস্ত্র টহল দিতে থাকে। কিন্তু কুষ্টিয়াবাসী পাক সেনাদের এ কার্যক্রম মেনে নিতে পারেনি। তারা কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং সেনা চলা চলে বিঘœ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যারিকেড দেয়াসহ বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এ সময় রনি রহমানসহ বেশ কয়েকজন পাকি সেনার গুলিতে প্রাণ হারান। এক পর্যায়ে হানাদারদের অত্যাচার ও গণহত্যায় কুষ্টিয়ার মানুষ বিদ্রোহী হয়ে উঠে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। জনগণের এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন যশোর নিয়ন্ত্রণাধীন চুয়াডাঙ্গার ৪ নং উইং এর কমান্ডার বাঙালী মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ইপিআর সৈনিকদের সংগঠিত করেন। সিদ্ধান্ত মতে ৩০ মার্চ ভোর চারটায় কুষ্টিয়ার চারদিক থেকে পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হয়। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীকে পাক ঘাঁটি কুষ্টিয়া জিলা স্কুল, সুবেদার মোজাফ্ফরকে পুলিশ লাইন ও নায়েক সুবেদার মনিরুজ্জামানকে (শহীদ) ওয়ারলেস অফিস আক্রমণের নির্দেশ দেন। এ ছাড়াও নূর আলম জিকু, জিয়াউল বারী নোমান, শামসুল হুদা, বদরউদ্দিন বদু, শামসুল হাদী, আব্দুল বারী, আব্দুল জলিল, আব্দুল মোমেন, নাসিম আহমেদ প্রমুখের নেতৃত্বে পুলিশ, আনসার ও জয়বাংলা বাহিনী এই যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। প্রচ- আক্রমণে এবং হাজার হাজার মানুষের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে পাক বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। ফলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শুধু জিলা স্কুল বাদে পুরো কুষ্টিয়া শহর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে যায়। এ সময় বহু পাক সেনা নিহত হয় এবং অফিসারসহ কিছু ভীতসন্ত্রস্ত্র সৈন্য অস্ত্র ফেলে পালিয়ে সদর দফতর জিলা স্কুলে আশ্রয় নেয়। এ অবস্থায় চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য সারাদিন সারারাত জিলা স্কুল ঘেরাও করে রাখা হয়। ৩১ মার্চ দুপুরে একটি বিমান এসে জিলা স্কুলের আশপাশে গুলিবর্ষণ করে চলে যায়। ১ এপ্রিল ভোরে অফিসারসহ অর্ধশত পাক সেনা দু’টি জীপ ও একটি ডজ গাড়িতে করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে যশোরের দিকে পালিয়ে যাবার সময় ঝিনাইদহ গাড়াগঞ্জ ব্রিজের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা ‘গর্তের ফাঁদ’-এ পড়ে পাক সেনার অধিনায়ক মেজর শোয়েবসহ অনেক সেনা নিহত হয়। অন্যরা ডজ গাড়ি থেকে নেমে আশপাশের গ্রামে পালিয়ে গেলেও কেউ জীবন রক্ষা করতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীরা তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। এর ফলে ১ এপ্রিল দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম এবং প্রথমবারের মত কুষ্টিয়া শক্র মুক্ত হয়। পরে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের অডিটোরিয়ামের স্টেজের নিচ থেকে যুবতী মেয়েদের ১০/১২টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এদিকে পাক হানাদাররা তাদের শোচনীয় পরাজয় ও হত্যর পরিশোধ নিতে পুনরায় কুষ্টিয়া দখলের প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। তারা সড়ক ও রেলপথে আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে আকাশ পথের আশ্রয় নেয়। ১৪, ১৫ ও ১৬ এপ্রিল কুষ্টিয়ার ওপর চলে প্রচ- বিমান হামলা। বিমান বাহিনীর ছত্রছায়ায় পাক সেনারা অগ্রসর হতে থাকে। এসময় তারা রাস্তার দু’পাশের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে থাকে। নিরীহ মানুষজনকে হত্যা এবং কামানের গুলি বর্ষণে আতংক সৃষ্টি করে অবশেষে ১৬ এপ্রিল কুষ্টিয়া শহর পুনরায় দখল করে নেয়। কুষ্টিয়ায় ঢুকেই তারা অধিকাংশ ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সমস্ত অবাঙালীকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে দেয় ও তাদের রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। পাক বাহিনী ও রাজাকাররা সারা শহরে ত্রাসের সৃষ্টি করে এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে মেতে উঠে। তাদের দোসর জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ এবং বিহারীর দল-রাজাকার মিলে নির্বিচারে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণ। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয় স্বজনদেরকে ধরিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন স্থান থেকে যুবতী মেয়েদেরকে ধরে এনে ভোগের সামগ্রী হিসেবে পাক হায়েনাদের হাতে তুলে দেয়। জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়কের পাশে উজানগ্রাম ইউনিয়নের বিত্তিপাড়া ছিল পাক হানাদার, রাজাকার, আলবদর, আল সামস বাহিনীর বৃহৎ বধ্যভূমি। কুষ্টিয়া পিস কমিটির চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা এ্যাডভোকেট সা’দ আহমেদের নেতৃত্বে এ সময় বিহারী, রাজাকার ও পিস কমিটির সদস্যসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা হয়ে ওঠে বেপরোয়া। শহরের রেণউইক ঘাট, রক্সি সিনেমা হলের উত্তর পাশ থেকে মিলপাড়া গড়াই নদীর শ্মশান ঘাট পর্যন্ত বেশ কয়েটি স্পট এবং মোহিনী মিল কলোনির পেছনে কালী নদীর ধার ছিল তাদের বধ্যভূমি। এসব স্পটে বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালীদেরকে ধরে এনে ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে জবাই করা হতো। গুলি করলে ভয়ে শহরবাসী পালিয়ে যেতে পারে। তাই ছিল লোমহর্ষক এই জবাইয়ের ব্যবস্থা। বিহারী ও রাজাকার মিলে কোহিনুর বেকারীর মালিক পরিবারের দুধের বাচ্চা থেকে শুরু করে মহিলা বৃদ্ধসহ ১৮ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া হানাদারমুক্ত হলে জেলার বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কার হতে থাকে একটার পর একটা গণকবর ও বধ্যভূমি। এসব বধ্যভূমি পূর্ণ ছিল বাঙালীর কঙ্কাল আর হাড়ের স্তূপে। পরিত্যক্ত বাড়ির কুয়ার মধ্যেও পাওয়া যায় গলিত পচা লাশ ও মানুষের কঙ্কাল। কুষ্টিয়ার বৃহত্তম বধ্যভূমি বিত্তিপাড়ায় ছিল পাক আর্মিদের ক্যাম্প। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজনকে এখানে এনে টর্চার করা হতো। এছাড়া বিত্তিপাড়ায় কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়কে চালাচলকারী যানবাহন থামিয়ে সন্দেহভাজন পুরুষ-নারীকে নামিয়ে নেয়া হতো। পরে তাদের আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন। মারা গেলে ক্যাম্পের আশপাশেই পুতে রাখা হতো কিংবা পুকুর-খাদে ফেলে দেয়া হতো। দেশ স্বাধীনের পর জন স্টোন হাউস ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের উপস্থিতিতে বিত্তিপাড়া বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় দুই পিকআপ ভর্তি মানুষের কঙ্কাল, মাথার খুলি ও হাড়। কুষ্টিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘বিত্তিপাড়া’ অন্যতম বৃহৎ বধ্যভূমি। -এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে
×