ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তালিকায় নাম থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মিলছে না

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

তালিকায় নাম থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মিলছে না

প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে তাদের আবেগ ফিরে নিয়ে যায় ৪৮ বছর আগের দিনগুলোতে। বিজয়ের আনন্দ তারা পালন করেন প্রজন্মের মুখের হাসি দেখে। প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার বর্ণনা দেন দেশে ও বিদেশে। তাদের জীবনের বড় বেদনার অধ্যায় আজও বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রণীত মুক্তিযোদ্ধার প্রথম তালিকার তারা ছিলেন প্রথম দু’জন। পরবর্তী সময়ের গেজেটে ভুল করে নাম বাদ পড়ে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে প্রবাসী সরকারের মুক্তিযোদ্ধার তালিকার সেই ভলিউম পাওয়া যায়। তা সংরক্ষিত হয় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে। তারপর তা নেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদ্বয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানানো হয়, তাদের নাম তালিকায় আছে। তারপর শুধুই কালক্ষেপণ। সকল দলিল ও প্রমানাদি থাকার পরও আজও তাদের স্বীকৃতি মেলেনি। এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন ডাঃ আহসান হাবিব ও ডাঃ আরশাদ সায়ীদ। তারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বিশেষ গেরিলা কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত। তাদের দুঃসাহসিক কমান্ডো অভিযানে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অনেক দূর্গ ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে তারা বগুড়ায় বাংলাদেশের মাটিতে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে তাদের (পাকিস্তান) স্বাধীনতা দিবস পালন করতে দেয়নি। ওইদিন উড়িয়ে দিয়েছিলেন বগুড়ার পাওয়ার স্টেশনের ঘাঁটি। ডাঃ আহসান হাবিবের ডাক নাম ওয়ালেস। মুক্তিযুদ্ধে আহসান হাবিব ছিলেন একটি গ্রুপের কমান্ডার। পরিচিতি ছিল ওয়ালেস গ্রুপ। তার অধীনে সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন ডাঃ আরশাদ সায়ীদ। তিনি জানালেন, ভলিউমটি উদ্ধারের পর ক’বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্টে ধর্না দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্ট মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের সচিবকে এক চিঠিতে এই দুই কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধার বিয়য়টি নিশ্চিত করে। তারপর শুধুই টালবাহানাই চলছে। জীবন সায়েহ্নে পৌঁছে ডাঃ আরশাদ সায়ীদের কথা- ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে তারা কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ও ওয়ালেস বিশেষ ট্রেনিংয়ের গেরিলা যোদ্ধা। প্রবীন ও বর্তমান প্রজন্ম তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে জানে। সকল দালিলিক প্রমানাদি ও নথি খুঁজে পাওয়ার পরও সরকারের স্বীকৃতি মিলছে না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ডাঃ আহসান হাবিব ওয়ালেস ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষ ও ডাঃ আরশাদ সায়ীদ এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ট্রেনিং নেন। দেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ফিরে ডাক্তারি পড়ায় মনোনিবেশ করেন। তারপর এমবিবিএস পাশ করে চিকিৎসা সেবায় যোগ দেন। ডাঃ আরশাদ বললেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ও সহকর্মীরা সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটের কুরমাইল ক্যাম্পে পৌঁছেন। ৭ নম্বর সেক্টরের ট্রানজিট এই ক্যাম্পে তিনি ও আহসান হাবিব নাম লেখান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর কমান্ডিং অফিসার মেজর নাজমুল হক (শহীদ হয়েছেন) তাদের মেডিক্যাল স্টুডেন্টের পরিচয় পেয়ে ডেকে পাঠান তরঙ্গপুর ক্যাম্পে। সেখানে প্রথম বিশেষ গেরিলা কমান্ডোর প্রশিক্ষন দেয়া হয়। ট্রেনিংয়ের সময়ই মেজর নাজমুল হক জানান প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করছে। সেই ভলিউমে প্রথম নাম ওঠে ডাঃ আহসান হাবিবের, দ্বিতীয় নাম ওঠে আরশাদ সায়ীদের। তৃতীয় নাম মাসুদ হোসেন আলমগীরের। এরপর অন্যদের নাম ওঠে। তিনি বলেন এটাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ভলিউম। তারা হানাদার পাকিস্তানী সেনা কবলিত বগুড়ার কয়েকটি এলাকায় কমান্ডো অভিযানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আস্তানা তছনছ করে দেন। একের পর অপারেশন চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব গাঁথা যুদ্ধে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। মক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর এই ভলিউমটির হদিস মেলে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ভালিউমটি খুঁজে পাওয়া যায়। ডাঃ আরশাদ সায়ীদ উদ্যোগী হয়ে এই ভলিউম খোঁজাখুঁজি করলে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্টে খুঁজে পান। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কল্যাণ বিভাগ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এক চিঠিতে জানান, যাচাইবাছাই করে দেখা গেছে ৭ নম্বর সেক্টরের ওই তালিকায় এক নম্বর ক্রমিকে ডাঃ আহসান হাবিব ও ২ নম্বর ক্রমিকে ডাঃ আরশাদ সায়ীদের নাম উল্লেখ আছে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই ভলিউম সেখানে সংরক্ষিত ছিল। বিষয়টি নিয়ে ডাঃ আরশাদ মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। মন্ত্রী ভলিউমটি মন্ত্রনালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর থেকে তা মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত হচ্ছে। মন্ত্রী ভলিউমটি দেখে সচিবকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন। ব্যবস্থার পালা আর শেষ হচ্ছে না...। ডাঃ আহসান হাবিব বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী। কিছুদিন আগে তার হার্ট এ্যাটাক হলে বাইপাস সার্জারি করতে হয়। ডাঃ আহসান হাবিব স্কুলে ও কলেজে এই প্রতিবেদকের ক্লাসমেট ছিলেন। আহসান হাবিব একসময় এই প্রতিবেদককে আক্ষেপ করে বলেন, ‘জীবন সায়েহ্নে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলাম না রে! প্রজন্মরা নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণ করবে।’ ডাঃ আহসান হাবিব আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি বগুড়ায় এসে কয়েকটি স্কুলে ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। ডাঃ আরশাদ সায়ীদ বর্তমানে বগুড়ায় প্রাকটিস করছেন। বগুড়া জিলা স্কুলে পড়ার সময় ড. জাফর ইকবাল তার সহপাঠী ছিলেন। বন্ধুত্ব অটুট আছে। ড. জাফর ইকবাল বিষয়টি জানেন। ডাঃ আরশাদ সায়ীদ বগুড়ায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন’ অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের বিজয়ের গল্প বলে শিশু মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেঁথে দেন। ডাঃ আরশাদ ক্ষোভে বললেন, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বারবার মন্ত্রণালয়ে গিয়েছেন। মন্ত্রীকে জানিয়েছেন। তারপর কালক্ষেপণে কিছুই হচ্ছে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিচ্ছেন। আশা করে আছেন এই দুই গেরিলা কমান্ডো স্বীকৃতি পাবেন। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×