ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাঝে মধ্যেই ট্রেন লাইনচ্যুত

পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইন বেহাল ॥ বিড়ম্বনায় যাত্রী

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইন বেহাল ॥ বিড়ম্বনায় যাত্রী

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ সংস্কার কাজে যথাযথ তদারকির অভাবে ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে পশ্চিমাঞ্চলের রেল ট্রাক। ফলে গতি কমেছে ট্রেনের। নির্ধারিত সিডিউলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারছে না কোন ট্রেন। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যাত্রী বিড়ম্বনা। জানা গেছে, সপ্তাহে দুদিন সরেজমিনে ঘুরে রেলওয়ে ট্রাকের (লাইন) প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে প্রকৌশলীদের। তবে পরিদর্শনের সেই নির্দেশনা রয়েছে শুধু কাগজে-কলমেই। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের নড়বড়ে লাইন ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে হরহামেশায় ঘটছে লাইনচ্যুতির ঘটনা। এ রুটে প্রায় লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটলেও ট্রাক মেরামতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এতে কিছুদিন পরপরই ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। সরেজমিনে এ রেল রুটের রাজশাহীর হরিয়ান স্টেশনের কাছে গিয়ে দেখা যায়, লাইনের ভগ্নদশা। সেখানে সমান্তরাল তিনটি ট্রাকের মধ্যে তিন নম্বর লাইনটি চলাচলের অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে। গত ১১ মার্চ রাতে রাজবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীমুখী ‘মধুমতি এক্সপ্রেস’ নামের একটি ট্রেন রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে হরিয়ান স্টেশনের কাছে এসে হঠাৎ লাইনচ্যুত হয়। অথচ দুর্ঘটনার দিন সেই লাইন দিয়েই চালানো হয় ট্রেনটি। সেই ট্রাকে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন কাঠের সিøপারগুলোকে সারিবদ্ধ করে ধরে রাখতে ৫৪ নম্বর রেল ব্রিজের ওপর স্লিপারগুলোতে প্রযুক্তিগত পদ্ধতির বাইরে বাঁশের বাতা ব্যবহার করে জোড়াতালি দেয়া। আর ৬৮০ মিটার সংস্কারাধীন দুই নম্বর লাইনটির মেরামত কাজ শেষ না হতেই তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হয়। পবার হরিয়ান স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার লাইনের দুই ধারেই বিরাট গর্ত। নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়ায় রেল লাইনগুলো গড়ে উঠেছে। স্টেশনের তিনটি রেল লাইনের মধ্যে ২ নম্বর লাইনে মেরামতের কাজ করা হয়েছে। তবে সংস্কার করা লাইনটিতে এখনও পাথর বসানো হয়নি। কংক্রিট সিøপারের সঙ্গে লাইনের সংযোগ ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ক্লিপ বসানো হয়নি। এক ও তিন নম্বর লাইনের পাত ঘেঁষে বিভিন্নস্থানে ফেলে রাখা হয়েছে পাথর ও মাটির স্তূপ। একই স্থানের তিন নম্বর লাইনের পুরোটা জুড়ে গজিয়েছে ঘাস। অযতœ ও অবহেলায় লাইনটির এখন বেহাল দশা। তার ওপর দিয়েই চলছে আন্তঃনগরসহ মালবাহী ট্রেন। এছাড়া গত ১০ জুলাই রাজশাহীর চারঘাটের দীঘলকান্দিতে তেলবাহী ট্রেনের আটটি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়। এতে প্রায় ২৮ ঘণ্টা রাজশাহীর সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে আবদুর রশিদ নামে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একজন সহকারী প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আর এ ঘটনার ধকল সামলাতে আরও প্রায় এক সপ্তাহ সিডিউল বিপর্যয় চলে পশ্চিমাঞ্চল রেলে। এদিকে, ঈশ্বরদী-জয়দেবপুর পর্যন্ত থাকা সিঙ্গেল লাইন, সিগন্যাল ব্যবস্থাকেও হুমকির মুখে ফেলছে বলে মনে করেন উর্ধতন কর্মকর্তারা। তবে পূর্ব রেলের আওতাধীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের কর্মকর্তা। রাজশাহী-ঢাকা রুটসহ পশ্চিমাঞ্চলের রুটগুলোতেও নেয়া হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে দেড় হাজার কিলোমিটার পথে ১ হাজার ৩৬৭টি সেতু রয়েছে। তবে এগুলো বেশিরভাগই ব্রিটিশ আমলের তৈরি। এরপর থেকে সেতুগুলোর ব্যবহার চলছে কোন রকমে জোড়াতালি দিয়ে। বছরে কেবল মেরামত করা হয়েছে। ফলে সেতুগুলো এখন বেহাল অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। প্রায় প্রতিটি সেতুই হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, সপ্তাহে অন্তত দুইদিন লাইন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। তবে এ নিয়ে সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি রেলওয়ের সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, লোকবল সঙ্কটে ভুগছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। যে কারণে নিয়ম বা ইচ্ছা থাকলেও সব সময় তা মানা সম্ভব হয়ে উঠেছে না। তবে এর পরও তাদের তদারকি কাজ প্রায় ঠিকঠাকই চলছে। এদিকে, ঈশ্বরদী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সিগন্যাল ব্যবস্থাকেও বর্তমানে হুমকির মুখে ফেলেছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আসাদুল হক বলেন, প্রতি সপ্তাহে দুইবার করে একজন সাব এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে রেলওয়ে লাইন পরিদর্শন করা হচ্ছে। এরপরও বিভিন্ন কারণে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই এখন বাড়তি সতর্ক অবলম্বন করা হয়েছে। আর পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান সঙ্কেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সুশীল কুমার হালদার জানান, পাবনার ঈশ্বরদী থেকে জয়দেবপুর স্টেশন পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইনটি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেকশন। এই সেকশনটা সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ। তবে সেখানে শীঘ্রই ডাবল লাইন ও ডুয়েল গেজ হবে বলে জানান তিনি। এই কর্মকর্তার ভাষ্য, কাজটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই সেকশনটিতে ডুয়েল লাইন হলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ট্রেন চলাচলে আশানুরূপ পরিবর্তন আসবে। এটি বাস্তবায়ন হলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের রুটগুলোতে বিরতিহীন ট্রেন চলাচলসহ অন্যান্য আন্তঃনগর ট্রেন চলাচলের জন্য তা মাইলফলক হয়ে দাঁড়াবে বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা। প্রকৌশলী সুশীল কুমার হালদার বলেন, লাইনের কারণে সময় বেশি লাগলেও স্টেশন মাস্টার ও চালকদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে গতিসীমা ঠিক করে দেয়াসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। তিনি বলেন, নির্দেশনা রয়েছে কোন ধরনের ত্রুটি ধরা পড়লে তার সঙ্গে সঙ্গেই চিহ্নিত করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সেখানে দ্রুত প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে।
×