ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বের সব সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:০৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

বিশ্বের সব সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল বাংলাদেশ

মোরসালিন মিজান ॥ আর কখনও এ ঘটনা ঘটেছে কিনা, জানা নেই কারও। তবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঠিকই ঘটেছিল। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করেছিল বাঙালী। বিশ্বের প্রায় সব সংবাদপত্র সে খবর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ছাপিয়েছে। প্রত্যেকেরই শিরোনামে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ নামটি। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা দুর্লভ সংবাদপত্র দিচ্ছে এমন তথ্য। পরাশক্তিগুলো যুদ্ধকে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করায় তাদের জন্যও ফলাফলটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তারও আগে বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে উঠেছিল বিশ্ব জনমত। সে প্রভাব পত্রিকায় পড়েছে বলেই মনে করেন গবেষকরা। গত বেশ কিছুদিন পুরনো পত্রিকা ঘেটে দেখা যায়, যুদ্ধের খবর প্রথম থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে আসছিল দেশী পত্র-পত্রিকা। বিদেশী গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত নানা খবর প্রতিদিন প্রকাশিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের যুদ্ধ জয় এবং পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর সর্বত্র হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের খবরটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। কোন কোন দৈনিকের পুরোটা জুড়েই ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও আগে-পরের ইতিহাস। প্রায় সব পত্রিকার প্রথম পাতায় আলাদা আলাদা ছবিসহ একাধিক স্টোরি ছাপা হয়। সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কাড়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজির আত্মসমর্পণের ছবিটি। দেশীয় পত্রিকাগুলোর সংবাদ শিরোনামে বিশেষ প্রাধান্য পায় ঐতিহাসিক সেøাগান ‘জয় বাংলা’। যুক্তরাষ্ট্রসহ পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়া অন্য দেশগুলোর কোন কোন পত্রিকায় কিছুটা ঘুরিয়ে বলার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এদিকে, বাঙালী নিধনে নামা পাকিস্তানীরা কিছুতেই মানতে চাইছিল না পরাজয়। দেশটি থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রিকা ঘেটে দেখা যায়, আরও কোন যুদ্ধের হুঙ্কার দিচ্ছে পাকিস্তান। যুদ্ধ জয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। তবে ঢাকার পত্রিকাগুলো ওইদিন বা পরদিন এত বড় খবরটি দিতে ব্যর্থ হয়। এর অবশ্য কারণও আছে। কারণটি ব্যাখ্যা করে প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, একাত্তরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল ঢাকার সংবাদপত্র। পত্রিকার অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানীরা। অব্যাহত বাধা ও প্রাণ হারানোর শঙ্কায় অফিস ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন সংবাদকর্মীরা। এর ফলে ১৬ ডিসেম্বর বা ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে খুব কম পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানান তিনি। তবে ১৭ ডিসেম্বর ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকাটি বিজয়ের খবর দিয়েছিল ‘দৈনিক বাংলা’ নামে। পত্রিকার মাস্টহেডে পাকিস্তান শব্দটির গায়ে ‘ক্রস’ চিহ্ন এঁকে দেয়া হয়। যোগ করা হয় ‘বাংলা’ শব্দটি। এভাবে দারুণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা পত্রিকাটির ৮ কলামে লিড করা হয় বাঙালীর যুদ্ধ জয়ের সংবাদ। শিরোনাম ছিল ‘জয় বাংলার জয়।’ মূল ছবিতে দৃশ্যমান হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘আজাদী’ পত্রিকারও পুরোটাজুড়ে ছিল নতুন বাংলাদেশের খবর। যুদ্ধ জয়ের খবরটি লাল কালিতে ব্যানার হেডলাইন করে পত্রিকাটি। ঐতিহাসিক সেøাগান থেকে শিরোনাম করা হয় ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’ মূল খবরে আবেগঘন উচ্চারণ। সেখানে লেখা হয়- ‘জয় বাঙলা। বাঙলার জয়। বাঙলার জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের সকল আশা-আকাক্সক্ষা এই একটিমাত্র জয়ধ্বনিতে ভাষা পাইয়াছে। দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানবাদী জল্লাদ গোষ্ঠীর খঞ্জর বাঙালীর রক্তে লাল হইয়াছে। বার বার মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার বীর জনতার বুকের রক্তে লাল হইয়াছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার জল। কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গার জল। জল্লাদরা ইসলামের ভাঁওতা দিয়া পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির দোহাই দিয়া আকণ্ঠ পান করিয়াছে বাঙালীর বুকের রক্ত।’ বহু দিনের পুরনো এই দৈনিকে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি মাঝখানে আলাদাভাবে করা হয়। বক্স আইটেমের শিরোনাম ছিল ‘মুক্তি ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নিকট বাংলা দেশ দখলদার পাক সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ।’ এতে লেখা হয়, ‘পাকিস্তানের স্বঘোষিত সৈনিক প্রেসিডেন্ট নরপশু জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ সেনাবাহিনী লক্ষ লক্ষ নিরীহ বাঙ্গালীকে হত্যা করার পর বীর বাঙ্গালী নওজোয়ান ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর তীব্র প্রতিআক্রমণের মুখে ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া আত্মসমর্পণ করিলে বাংলাদেশে ১৫দিন স্থায়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে। গত বৃহস্পতিবার ৫টা ১ মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে নরহন্তারক ইয়াহিয়া খানের পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর কমান্ডার লেঃ জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার চুক্তিতে স্বাক্ষরদানের পর পাক দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ফলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটে। এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলা দেশ স্থায়ী আসন লাভ করে। বিজয়ের দিনে অবিসংবাদিত নেতা ও তার ঘোষণার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংবাদটিতে লেখা হয়, ‘বাংলাদেশের নয়নমণি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গ বন্ধু শেখ মজিবর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানেই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন।’ বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো সে দেশের মানুষের আবেগ ভালবাসাকে ধারণ করেছিল। ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দ বাজার বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি প্রধান শিরোনাম করে। বিখ্যাত দৈনিকের মূল শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তান হার মানল, নিয়াজির বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ’ শিরোনামে পত্রিকাটি লেখে- ‘বাংলাদেশে দখলদার পাক ফৌজ বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণ করেছে। এবং আত্মসমর্পণ করেছে বিনাশর্তে। ঐ ফৌজের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেঃ নিয়াজী আত্মসমর্পণের শর্তাদি নিয়ে আলোচনার জন্য ইস্টারন কমানডের অধ্যক্ষ মেঃ জেঃ জ্যাকবকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। জেনারেল জেকব তদনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকালেই হেলিকপ্টারে ঢাকা রওনা হয়ে যান। এই সম্পর্কে নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত এক সরকারী ঘোষণায় বলা হয়েছে : জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আজ সকালে লেঃ জেঃ নিয়াজি তাতে সাড়া দেন।’ এই সংবাদে আরও জানানো হয়, জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের সময় সীমা বেঁধে দিয়েছিল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা।’ একই দিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘নিয়াজির নিঃসর্ত আত্মসমর্পণ’। রিপোর্টে লেখা হয়, ‘পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী আজ বিনাসর্তে মুক্তিবাহিনীর সহযোগি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করায় গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পূর্ণ মুক্তি লাভ করলো।’ সংবাদে তথ্য দিয়ে বলা হয়, ‘পাক দখলদার বাহিনীর বিনাসর্তে আত্মসমর্পণের কথা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় ঘোষণা করেন এবং রাজ্যসভায় এই কথা ঘোষণা করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম। বিকাল সাড়ে পাঁচটার সময় উভয় কক্ষে একই সঙ্গে এই ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই উভয় কক্ষ উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং নির্দিষ্ট সময়সূচীর বাইরেও তারা অধিবেশন চালিয়ে যান।’ ভারতের চ-িগড় থেকে প্রকাশিত ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকায় লিড ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের খবর। শিরোনাম ‘BANGLADESH FREED, UNCONDITIONAL SURRENDER BY PAK TROOPS.’ বিশ্বের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি মূল সংবাদ করে। হেডলাইন ছিল, ‘ওঘউওঅ ঙজউঊজঝ ঈঊঅঝঊ-ঋওজঊ ঙঘ ইঙঞঐ ঋজঙঘঞঝ অঋঞঊজ চঅকওঝঞঅঘওঝ ঝটজজঊঘউঊজ ওঘ ঞঐঊ ঊঅঝঞ.’ সংবাদের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষররত নিয়াজী ও অরোরার ঐতিহাসিক ছবিটি সংযুক্ত করা হয়। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকেও বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের খবর দেয়া হয়। দৈনিক নেভানডা স্ট্যাট জার্নালের ১৭ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রধান সংবাদ হয়ে আসে বাংলাদেশ। পত্রিকাটি প্রথম পাতায় বেশ কয়েকটি স্টোরি করে। বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি দেয় ‘Bangladesh Proclaimed As Nation’ শিরোনামে। উল্লেখযোগ্য দৈনিক ‘দি সল্টলেক ট্রিবিউন’র প্রধান সংবাদ ছিল ‘Indians Enter Dacca, ExtendTruce to West’. কোন কোন পত্রিকায় ১৬ ডিসেম্বরই চলে আসে খবরটি। তেমন একটি পত্রিকার নাম ‘দি ইভিনিং স্টার।’ এর প্রথম পাতায় বাংলাদেশের বিজয়ের খবর চমৎকার একটি ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ছবিতে দেখা যায়, যুদ্ধ জয়ী এক তরুণ অস্ত্র উঁচিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পত্রিকাটি বলছে, ‘এ ভিক্টোরিয়াস ফ্রিডম ফাইটার।’ ছবির নিচে বড় করে লেখা রয়েছেÑ জয় বাংলা। পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোও বাংলাদেশের বিজয়ের খবর এড়াতে পারে না। যতটা সম্ভব ঘুরিয়ে তারা এই খবর প্রকাশ করে। নাকে খত দিয়ে পাকিস্তানী আর্মি যখন প্রাণ বাঁচানোর আকুতি করছে তখন ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক ডন পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ‘ডধৎ ঃরষষ ঠরপঃড়ৎু.’ মূল সংবাদের নিচে ছোট করে মাত্র দুই কলামে দেয়া হয় বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি। পরাজয় মেনে নিতে নারাজ পাকিরা তাদের নিজেদের মতো করেই হেডলাইন করে- 'Fighting ends in East Wing. PAK Hits in West.’ এভাবে বিজয়ের শুভ ক্ষণে সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমের নজর কাড়ে বাংলাদেশ। অন্য সব খবর পেছনে পড়ে যায়। স্থানীয়-আন্তর্জাতিক খবর পেছনে ফেলে সর্বাধিক গুরুত্বের হয়ে ওঠে বাংলাদেশ নামটি। কেন বিশ্ব গণমাধ্যম বাংলাদেশ নামটিকে এভাবে হেডলাইনে এনেছিল? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় দেশী-বিদেশী সংবাদপত্রের বড় সংগ্রাহক ও ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তান যে অন্যায় করছে তা এতদিনে জেনে গিয়েছিল পৃথিবীর মানুষ। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরি হয়েছিল। তাদের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছে সংবাদপত্রগুলো। পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোর মাথা ব্যথার অন্ত ছিল না। কেউ পক্ষে, কেউবা বিপক্ষে নানা তৎপরতা চালিয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ফল নিয়ে ভাবিত ছিল পরাশক্তিগুলোও। সংবাদপত্রে এর প্রভাব পড়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×