ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বীরেন মুখার্জী

বিনয়ের কবিতায় জীবনানন্দীয় প্রভাব

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

বিনয়ের কবিতায় জীবনানন্দীয় প্রভাব

বিশ্বের সব দেশের সাহিত্যকর্মে অগ্রজদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় সূক্ষ্মতম মাধ্যম কবিতায় প্রভাবের মাত্রা সঘন। বাংলা কবিতায় বিদেশী কবিদের প্রভাবের পাশাপাশি বাংলা ভাষার অগ্রজ কিংবা সমকালীন কবিদেরও সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে তা ব্যাপকতর। হোমার, শেক্সপিয়ারসহ ইউরোপীয় নানা লেখকের প্রভাব যেমন পাওয়া যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনায়; তেমনি অডেন, শেলী, কিটস, প্রমথ চৌধুরী, গগন হরকরা, লালনের প্রভাব রয়েছে রবীন্দ্রনাথে। আল্লামা ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ, জালালউদ্দিন রুমি, হাফিজ, শেখ সাদীর স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে কাজী নজরুল ইসলামের রচনায়। তিরিশের বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায়ও বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এলিয়ট, বোদলেয়র, মালার্মে, পাউন্ড, রিলকে, ভ্যালেরি, র্যাঁবো, হপকিন্সসহ অন্যান্য ইংরেজ কবি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নজরুলের প্রভাব। কবিতার বিষয়াংশ এবং প্রকরণ প্রকৌশলÑউভয় ক্ষেত্রেই তিরিশের কবিগোষ্ঠী প্রবলভাবে আকৃষ্ট ছিলেন পাশ্চাত্যের কবিদের প্রতি। অন্যদিকে প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিমল চন্দ্র ঘোষ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদারের কবিতায় রয়েছে জীবনানন্দ দাশ ও কাজী নজরুল ইসলামের লঘু-গুরু প্রভাব। তবে জীবনানন্দের কবিতার উত্তরসূর পাওয়া যায় বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেক প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতায়। এ তিনজনের মধ্যে জীবনানন্দের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বিনয় মজুমদারের নাম ব্যাপকভাবে উচ্চারিত। শুধু কবিতা নয়, বিনয়ের চিন্তাশীল গদ্যেও জীবনানন্দের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে, বিনয় মজুমদারও তা স্বীকার করেছেন। আলোচ্য নিবন্ধে বিনয় মজুমদারের সাহিত্যকীর্তিতে জীবনানন্দ দাশের প্রভাবের স্তরগুলো পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি; কবি- কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভেতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’ অপরদিকে বিনয় মজুমদার ‘আত্মপরিচয়’-এ বলেছেন, ‘চারিপাশে যে সকল দৃশ্য দেখি, আমরা সকলেই দেখি, তার হুবহু বর্ণনা লিখলে কবিতা হয় না। সেই দৃশ্য আদৌ কেন আছে, কী কারণে বিশ্বে তার থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, বিশ্বের নিয়মাবলী ও গঠন প্রকৃতি ওই দৃশ্যে কতটুকু প্রকাশিত হয়েছে-এইসব বর্ণনার সঙ্গে যুক্ত করে না দিলে আধুনিক কবিতা হয় না। কিন্তু যুক্ত করতে হলে ওই-সব জানা থাকা দরকার!’ জীবনানন্দ দাশ ‘কল্পনা’, ‘অভিজ্ঞতা’, ‘চিন্তার সারবত্তা’ এবং ‘চরাচরের সম্পর্ক’ উল্লেখ করে ‘কবি’ মনস্তত্ত্বের ওপর আলোক প্রক্ষেপণের চেষ্টা করেছেন আর বিনয় মজুমদার ‘কবিতা’র করণকৌশলের ক্ষেত্রে ‘বিশ্বের নিয়মাবলী ও গঠন প্রকৃতি’ কী কারণে রয়েছে তার তল অšে¦ষণের কথা বলেছেন। প্রকৃতির দ্বারস্থ হয়ে নিজ নিজ ব্যাখ্যা দাঁড় করালেও জীবনানন্দ ও বিনয়ের চিন্তা সম্পূরক, যা দু’জনের মানসিক ঐক্যের সাক্ষ্যবহ। তিরিশের পঞ্চকবি অগ্রজ কবিদের ধারা, বিশেষ করে রবীন্দ্রসৃষ্ট ধারা পাশ কাটিয়ে কবিতায় যে নতুনতর ধারার সূচনা করেন, তা কালক্রমে আধুনিক বাংলা কবিতায় ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছে বলে স্বীকৃত। এ পর্বে বাংলা কবিতার শরীরে যেমন ইউরোপীয় কবিতার প্রভাব স্পষ্ট হয়, তেমনি প্রকরণ-প্রবণতায়ও আমূল পরিবর্তন ঘটে। বাংলা কবিতার চলমান ভাব ‘ঈশ্বরবন্দনা’ থেকে কবিতায় সূচিত হয় ‘মানবতার জয়গান’। যদিও এ ধারা মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য এবং নজরুলের বিভিন্ন রচনায় স্পষ্ট। তবে সামগ্রিক অর্থে তিরিশে ‘ঈশ্বরবন্দনা’ নির্বাসিত হয় কবিতার মূলস্রোত থেকে। বিষয়বস্তু, ভাব-বর্ণনা, উপমা-চিত্রকল্প, প্রকরণসহ তিরিশের কবিতা স্বতন্ত্র বিভা নিয়ে আবির্ভূত হয়। এ ধারা বিনির্মাণে অন্যান্য কবিদের তুলনায় জীবনানন্দ দাশ এগিয়ে রয়েছেন। তিরিশের কাব্যধারা এতই প্রভাবসঞ্চারী যে, একবিংশ শতাব্দীতেও এ ধারা ব্যাপকভাবে চর্চিত, বিশেষ করে জীবনানন্দচর্চা ও তার প্রভাবের বিষয়টি জোর দিয়ে বলা যায়। বিনয় মজুমদার প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন জীবনানন্দের প্রভাব কী অমোঘ হয়ে উঠেছিল তার কাব্যচর্চায়। পাশাপাশি এ-ও বুঝেছিলেন, ‘জীবনানন্দের কবিতা নকল করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। জীবনানন্দকে নকল করা এত সহজ ব্যাপার নয়।’ বিনয়ের কবিতায় ‘প্রকৃত প্রস্তাবে’, ‘দৃশ্যত’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার জীবনানন্দের স্বতন্ত্র কাব্যভাষা থেকে আহরিত বলে মনে হওয়াও অসঙ্গত নয়। উভয়ের কবিতা থেকে পাঠ নেয়া যেতে পারে- ‘...ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশে। কোকিল কুকুর জ্যোৎস্না ধুলো হয়ে গেছে কত ভেসে? মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?’ জীবনানন্দের ‘স্থবির যৌবন’ কবিতাটির এ পর্বের ‘মূল চাবি’ স্বপ্ন। বিকেলে নদীর কিনারে ‘ধূসর ঘোড়া’ রূপক প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি সম্ভবত কুয়াশাকে চিত্রিত করেছেন, যেখানে ‘কোকিল কুকুর জ্যোৎস্না’ ধুলো হয়ে ভেসে গেছে। চিত্রকল্পটি গভীর হতাশাদ্ব্যর্থক হলেও জীবনের একটি বিশেষ সময়ের ব্যঞ্জনা ধরে আছে। আবার মরণের কাছাকাছি এসেও মানুষ যে স্বপ্ন সঙ্গী করে বেঁচে থাকার সাহস পায়, তাও ফুটে ওঠে। জীবনানন্দের এই আশাবাদ যাপিত জীবনেরই পরিপূরক। অপরদিকে বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো, চাকা’র ‘২৯ জুন, ১৯৬২’ সংখ্যক কবিতার একটি পর্বে- ‘কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক। এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পরে অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে’ জীবনানন্দের মতো বিনয়ের কবিতাটির গভীরেও রয়েছে প্রবল ‘আশাবাদ’, যা মানুষকে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। এছাড়া অন্ধকারে একটি জোনাকির যৎসামান্য নিরুত্তাপ আলোক এবং ‘অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পরে’, ‘প্রকৃত আকাশ’ বলতে কবি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেন। পরিশেষে ‘আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে’ ভাবগত অর্থে জীবনানন্দের স্বপ্নই পুনর্ব্যক্ত করেন। ফলে দুটি কবিতার বোধগত এবং পাঠগত একই অভিঘাতে স্পন্দিত হন পাঠক। বিনয়ের কবিতা কোন অজানা পাঠকের কাছে জীবনানন্দের কবিতা বলে ভ্রম হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। আবার উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জীবনানন্দের সঙ্গে বিনয়ের সাদৃশ্য রয়েছে। ‘করুণ চিলের মতো’ উপমা প্রয়োগে জীবনানন্দের কথা স্মরণ করতে হয়। অন্যদিকে ‘এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পরে’, ‘তবু তুমি পৃথিবীতে আছো’র মতো পঙ্ক্তিগুলো জীবনানন্দের পঙ্ক্তির সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। এসব পঙ্ক্তি পাঠকালে একই অভিঘাত সৃষ্টি করে অনুভূতিতে। জীবনানন্দের সাদৃশ্যবাচক এরকম বহু উপমা রয়েছে বিনয়ের কবিতায়। “জীবনানন্দের কবিতার সূত্রে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন কবিতার ‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’। সেই সৌন্দর্য হচ্ছে এলিমিনেশনের, আলোকচিত্র ধর্মিতার চ্যুতির, চিত্রকল্প, রূপকল্প এবং উপমার ব্যবহার, উপমার বদলে বিকল্প হিসেবে প্রতীকের ব্যবহার, রসাত্মক বাক্য নির্মাণ, কবিতাকে স্মৃতিস্থ করার ব্যবস্থা, গভীরতা, সংযম আর বহুমাত্রিক ভাবের উপস্থিতির। জীবনানন্দ যে স্বতন্ত্র ভাষার স্রষ্টা, তাও বিনয় মজুমদারের দৃষ্টি এড়ায় নি”Ñ বিনয়ের কবিতায় জীবনানন্দ প্রভাবের স্বরূপ সম্পর্কে কবি-গবেষক মাসুদুজ্জামানের এ মূল্যায়নও আলোচ্য প্রবন্ধের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। কবি-আলোচক ওমর শামসের ভাষ্যমতে, ‘জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতা লিখিত হয়েছে অক্ষরবৃত্তে। আর বিনয় মজুমদার প্রায় সব কবিতা অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন। অক্ষরবৃত্তের মাত্রার বাঁট এবং চলনও জীবনানন্দীয় ঘরানার।’ ফলে ছন্দসাম্যের কারণেও দুজনের কবিতা পাঠে একই ঝোঁক অনুরণন তোলে। আবার জীবনানন্দের কবিতার শান্তরস, অন্তর্মুখীনতা, আঁধার, নির্জনতা, ব্যাপকভাবে প্রবহমান বিনয়ের কবিতায়। কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে ধরলেই এটি স্পষ্ট হতে পারে- জীবনানন্দের পঙ্ক্তি: ‘তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে, পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন, মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।’ [স্বপ্ন] ‘আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে! আমি চ’লে যাবÑতবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধরে সেই দিন পৃথিবীর প’রে; আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!’ [নির্জন স্বাক্ষর] অপরদিকে বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’র পঙ্ক্তি: ‘চিৎকার আহ্বান নয়, গান গেয়ে ঘুম ভাঙালেও অনেকে বিরক্ত হয়; শঙ্খমালা, তুমি কি হয়েছো? আজ তাই মনে হয়; তবু তুমি পৃথিবীতে আছো।’ [২২ জুন, ১৯৬২] ‘করুণ চিলের মতো সারাদিন, সারাদিন ঘুরি। ব্যথিত সময় যায়, শরীরের আর্তনাদে, যায় জ্যোৎস্নার অনুনয়; হায়, এই আহার্যসন্ধান।’ [৩০ মে, ১৯৬২] ‘বাংলা কবিতা প্রকৃতিসম্ভূত’-বলেছেন কাব্যবোদ্ধারা। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানবহৃদয়ের ভাব ও উপলব্ধি উদ্বোধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে প্রকৃতি। প্রকৃতির কাছে এসে মানুষ বুঝতে পারে তার সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতা কিংবা প্রমাণ পায় পরিমিতিবোধের। অর্থাৎ প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসেই জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পায় মানুষ। ফলে কবিতায় প্রকৃতির উঠে আসা স্বাভাবিক ঘটনা। জীবনানন্দও বাংলার প্রকৃতি অবলোকনে মোহিত হয়ে সৃষ্টি করেছেন তার অমর কাব্য ‘রূপসী বাংলা’। জীবনানন্দকে ‘রূপসী বাংলার কবি’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ষড়ঋতুর নানা ব্যঞ্জনা চোখে পড়ে। তবে ‘হেমন্ত ঋতু’র সার্থক উপস্থিতি রয়েছে তার কবিতায়। অন্যদিকে বিনয় মজুমদার লিখেছেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্য। বিনয় মজুমদার এক সাক্ষাতকারে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ সম্পর্কে বলেছেনÑ ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র মূল বিষয় ছিলো অঘ্রাণ মাস, মানে হেমন্ত ঋতু। কবিতাগুলো পড়লে যেন পাঠকের মনে একটা হেমন্তের অনুভব জাগে, এই ছিলো উদ্দেশ্যÑ সে চৈত্র মাসে পড়লেও যেন জাগে, কি বৈশাখ মাসেও।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, জীবনানন্দ দাশ প্রবল প্রতাপে উঠে এসেছেন বিনয় মজুমদারের প্রকৃতিদর্শনে, কবিতায়। সাহিত্যে প্রভাবের বিষয়টি ‘ঋণগ্রহণ প্রবণতা’ বলে আখ্যায়িত করেন কাব্য আলোচকরা। কেউ ঋণস্বীকার না করলে তাকে চৌর্যবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু বিনয় তা করেননি। তিনি অকপট ঋণস্বীকার করেছেন জীবনানন্দের, পাশাপাশি তার আগেও কবিতায় গণিত কিংবা বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ ব্যবহারের কথাও উল্লেখ করেছেন। যা বিনয়ের সাহিত্যিক সততা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সুতরাং ‘সাহিত্যে ঋণ গ্রহণ করবার ক্ষমতাকে গৌরবের সঙ্গে স্বীকার করা যেতে পারে’। ‘সাহিত্যবিচার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সত্য উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমি অনেক সময় খুঁজি সাহিত্যে কার হাতে কর্ণধারের কাজ দেওয়া যেতে পারে, অর্থাৎ কার হাল ডাইনে-বাঁয়ের ঢেউয়ে দোলাদুলি করে না। একজনের নাম খুব বড়ো করে আমার মনে পড়ে, তিনি হচ্ছেন প্রমথ চৌধুরী। প্রমথর নাম আমার বিশেষ করে মনে আসবার কারণ এই যে, আমি তাঁর কাছে ঋণী।’ আবার, অধ্যাপক-গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষের মতে, ‘প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিলনসাধনার অসামান্য শিল্পকুসুম রবীন্দ্রনাথের কবিতা। রোমান্টিক যুগ, ভিক্টোরীয় শিল্পপ্যাটার্ন, ফরাসী রোমান্টিক সাহিত্য ও তার অবক্ষয়, ইতালি-জার্মান সাহিত্য, গ্যেটে ও হাইনের কবিতা, উনিশ শতকের আমেরিকান সাহিত্য, উনিশ-বিশ শতকী ইউরোপীয় সাহিত্য-দর্শন, বিজ্ঞানবিষয়ক নানা তত্ত্ব, ইউরোপ-আমেরিকার বহুবিধ সাহিত্য আন্দোলন-এসব বিষয় ও অনুষঙ্গ রবীন্দ্র-কবিতায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে।’ সুতরাং এ কথা বলাবাহুল্য নয় যে, কবিতায় প্রভাবের এই প্রবণতা শুধু বিনয়েই নয়, বরং এটি একটি ধারাবাহিক প্রবণতারই ফল। আধুনিক বাংলা কবিতায় অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা, সুদূরের আকাক্সক্ষা, অকারণ বিষাদময়তা, প্রেমভাবনা, প্রকৃতিচেতনা, বিরহভাবনাসহ যেসব বৈশিষ্ট্য চিত্রায়িত হয়েছে তা ইংরেজি রোমান্টিক কবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রোমান্টিক কবিতার এসব কুললক্ষণ বাংলাভাষাভাষী কবিদের চেতনায়ও গভীর রোমান্টিক ইন্দ্রজাল নির্মাণ করেছে। জীবনানন্দের চেতনায়ও এই লক্ষণ প্রবল, তেমনি এই গাঢ় বেদনার চিত্রায়ন দেখি বিনয়ের কবিতায়। কবি-আলোচক আমিনুল ইসলামের মতেÑ “বিনয় মজুমদারের ব্যক্তিগত জীবনে বহু অন্তরঙ্গ বেদনা ও অদ্ভুত ব্যর্থতা ছিলো। তার কবিতা অনেকটা ‘শিল্পিত প্রলাপ’ এর মতো। আমাদের অনেকের জীবনেই গোপন ব্যর্থতা বা ব্যর্থতাবোধ আছে। যে কারণে বিনয়ের কবিতা আমাদের নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে যায়।” জীবনানন্দ দাশ আর বিনয়ের মানসিক যন্ত্রণার সাযুজ্য থেকেও এ ধারণা জন্মানো অমূলক নয় যে, বিনয় তার অপ্রাপ্তির যন্ত্রণাকে জীবনানন্দের ধাঁচে ফেলেই কবিতায় রূপ দেয়ার অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বিনয়ের কবিতা পাঠে স্পষ্ট যে, তার কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয় প্রেমের অচরিতার্থ রূপ ও বিরহের ব্যাপ্তি। যা তার ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অপরদিকে জীবনানন্দের কবিতায়ও নানাভাবে প্রতিভাত হয়েছে বিরহযন্ত্রণা। বিনয়ের ভালোবাসা পুঞ্জীভূত গায়ত্রীর জন্য, যাকে তিনি ‘চাকা’ সংকেতে আহ্বান করেছেন আর জীবনানন্দের মানসপটে ‘বনলতা’, ‘আকাশলীনা’, ‘সুরঞ্জনা’ নামে দূরতমার রহস্য ঘনীভূত। জীবনানন্দ বলেন, ‘নারী, শুধু তোমাকে ভালোবেসে/বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।’ আর বিনয়ের উচ্চারণ, ‘আমি এতদিনে চিনেছি কেবল/অপর ক্ষমতাময়ী হাত দুটি ক্ষিপ্র হাত দুটি/ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত’। এভাবে কবিতা পরম্পরায় উভয়ের উপলব্ধি আর চেতনার যোগসূত্র স্থাপিত হতে দেখা যায়। তবে পরবর্তীতে বিনয় তার কবিতায় স্বকীয় দর্শন, নৈঃসঙ্গ, হতাশা ও ব্যর্থতার রূপায়ণে ভিন্নমাত্রা সংযোজন করতে সমর্থ হন। একজন কবি মূলত সমাজের অগ্রসর চিন্তার মানুষ এবং অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। সমাজের যে কোন পরিবর্তন, অভিঘাত সবার আগে স্পর্শ করে কবিকে। একজন কবি তার চিন্তা-দর্শন, অভিজ্ঞতা পাঠকের মননে সঞ্চালন করতে চান, তেমনি পাঠকও মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেন কবির সঙ্গে তার চিন্তার যোগসূত্র। বলা যায় কবিতার মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে কবির সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটে। সমাজ-রাষ্ট্র, প্রকৃতি-পরিবেশের নানা বিবর্তন-পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তার পরিকাঠামোতে যে পরিবর্তন ঘটে তা কবি পরম্পরায় সঞ্চারিত হতেই পারে। আবার তা চেতন-অবচেতন উভয় প্রক্রিয়ায়ই ঘটতে পারে। ফলে অগ্রজ কবির প্রভাবে অনুজ কবিরা প্রভাবিত হলেও তা সর্বক্ষেত্রে দোষের বিবেচনা করা হয় না। কবিতা ভূঁইফোঁড় বা অতিপ্রাকৃত কোন বস্তু নয়। একজন প্রকৃত কবি জীবন ও প্রকৃতি সেঁচেই এই রস আহরণ করেন, আর তাতে মেশান প্রাচ্য-প্রতীচ্যের ভাবনা। জীবনানন্দ পাঠেও একই চিত্রের প্রতিফলন ঘটে। ফলে যাপিত জীবনের নানামাত্রিক ছায়া কবিতায় চিত্রিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কবিতার ধারাবাহিক পাঠে একজন কবির চিন্তাক্ষেত্র উর্বর হয়, ফলে একজন প্রকৃত কবিই পারেন নিজের কবিতায় এর সফল রূপায়ণে, যা পেরেছিলেন বিনয় মজুমদার। পাশাপাশি কবিতায় গাণিতিক সূত্র প্রয়োগ করে তিনি জীবনানন্দের কবিতার সম্প্রসারিত আধুনিক রূপের সৃষ্টি করেছেন বলেও মনে করা যেতে পারে। বিনয় উত্তরপর্বে তার কবিতার গবেষণা, চর্চা ও বহুল পঠনপাঠনের ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ায়, জীবনানন্দের ব্যাপক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বিনয় মজুমদার যে স্বতন্ত্র এক কবিসত্তা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এখানেই বিনয়ের সার্থকতা প্রতিফলিত।
×