ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় ভাবনায় কয়েকজন

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

বিজয় ভাবনায় কয়েকজন

লাখো শহীদের বিনিময়ের নাম বাংলাদেশ। প্রকৃতপক্ষে নারীরা মুক্তিযুদ্ধে অনেক বড় সহায়ক শক্তি ছিল। সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনও বা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে। অনাহারী, অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, কখনও মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনও বা বোনের মতো। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানী হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল স্বাধীনতা। কিন্তু তাদের নীরব এই অবদানের কথা, ঘটনা কখনও কারও তেমন জানা হয়নি। ইতিহাসে নারীকে মূল ধারায় স্থাপন না করার ফলে নারীর প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য এখনও বিদ্যমান। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমতা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, যৌন হয়রানি, নারীর ক্ষমতায়ন, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের গোঁড়ামি এসব প্রতিবন্ধকতা। স্বাধীনতার এত বছর পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দিক থেকে কি ভাবছে নারীরা, কি স্বপ্ন দেখছে দেশকে ঘিরে। এসব নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন। গ্রন্থনা করেছেনÑ রুমান হাফিজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব কানিজ ফাতেমা রোজী সহকারী শিক্ষক কক্সবাজার মডেল হাইস্কুল, কক্সবাজার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এদেশের পদযাত্রা শুরু“হয়েছিল। সেই আলোকে আমাদের কিছু প্রাপ্তি ঘটেছে। তবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত অর্জন সম্ভব হয়নি। যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছিল সে স্বপ্ন নানা কারণেই গত ৪৮ বছর পর ও সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে উন্নীত হয়, যা আমাদের বড় প্রাপ্তি। সমাজজীবনে ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারীমুক্তি আন্দোলন, নারীশিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। সন্ত্রাস, দরিদ্রতা ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য এবং বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য সরকারের গৃহীত পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে হয়ত ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে উন্নত দেশের তালিকায়... জাতি এই প্রত্যাশাই করে। শান্তির বাংলাদেশ প্রত্যাশা ফাইজুন নাহার শিক্ষার্থী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১ থেকে দুই হাজার উনিশÑ খুব বেশি সময় নয় একটা দেশের জন্য। যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল তা পূরণ করার জন্য হয়ত আরও সময় দরকার। মাঝে মধ্যে কিছু উদ্যোগ সত্যিই মনে আশা জাগায়, মনে হয়, আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি। তবে সত্যি বলতে কী, বৈষম্য কিংবা শোষণের ব্যাপারটি থেকেই যাচ্ছে। নিজেদের কথাই বলি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে একজন শিক্ষার্থীকে থাকার একটু জায়গার জন্য এখনও এত সংগ্রাম করতে হচ্ছে, ভয় পেতে হচ্ছেÑ ব্যাপারটি সত্যিই হতাশাজনক। যখন দেখি দেশে এত সহিংসতা ঘটে যাচ্ছে, তার বিচার হবে কি না সেটা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে নাÑ তখনও হতাশ হতে হয়, দেশে কতটা নিরাপদে আছি আমরা? শুধু দুর্নীতি বা শোষণ নিয়েই দেশ চলছে তা নয়। তবে ভাল কাজের অনুপাত আরও বাড়ুক এই আমাদের প্রত্যাশা। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, আমরা নিজেদের কথা ভাবতে যেয়ে অন্যদের সুবিধা-অসুবিধার ব্যাপারটি ভুলে যাচ্ছি। ‘ক্ষমতা’ আর ‘অপব্যবহার এই শব্দ দুটি যেন পাশাপাশি না বসে সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে যে জাতি জিতেছে, একতা টিকিয়ে রাখার যুদ্ধেও তাদের জিততে হবে। নিরাপদ হোক নারীর পথচলা শাহীন চৌধুরী ডলি প্রাবন্ধিক বিজয়ের ৪৮ বছর পেরিয়েও প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে অনেক ফারাক। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্তম্ভ গণতন্ত্র ভেঙ্গে পড়েছে। মুক্তচিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারসমূহ নিশ্চিত হয়নি। বাঙালীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আজ অপসংস্কৃতির করাল গ্রাসে রাহুগ্রস্ত। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের কাক্সিক্ষত অর্জন আজও সম্ভব হয়নি। যে স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা সামনে রাখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণে বিগত ৪৮ বছরেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীন দেশের নারীরা আজও অবহেলিত। নারী-পুরুষের কাক্সিক্ষত সমান অধিকার নিশ্চিত হয়নি। নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, খুন, রাহাজানি নিত্যকার ঘটনা। বেশিরভাগ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভুয়া মুক্তিযুদ্ধের সনদধারীরা নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। গণমাধ্যমের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা নেই। সমাজের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মহৎ লক্ষ্যসমূহ জাগ্রত করতে হবে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, বঙ্গবন্ধুর দেখা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত করতে দেশের প্রতিটি মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করবে এবং বিশ্বের দরবারে স্বাধীন বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে। প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা নাজনীন সুরভী শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের কথা যদি বলি নিঃসন্দেহে ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে উদিত হয়েছিল বিজয়- রবি। রক্তনদীর উজান বেয়ে যে বিজয় আমরা পেয়েছি, সে বিজয় দিবস আমাদের জাতির সামনে খুলে দিয়েছে অমিত সম্ভাবনার স্বর্ণদুয়ার। চরম শোক ও পরম গৌরবে ম-িত মুক্তিযুদ্ধের পর সেই ডিসেম্বরে আমরা এটাই প্রমাণ করেছিলাম যে জাতি হিসেবে আমরা মোটেই ছোট কিংবা দুর্বল নই। আমাদের প্রয়োজন শুধু একাত্মতা পোষণের। আমরা জাতীয় জীবনে বার বার এক হতে চাই সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য যাঁরা ছিনিয়ে এনেছিল, তাঁদের একফোঁটা রক্তেরও যেন অমর্যাদা না হয়। পরাধীনতার শিকল থেকে বের হওয়া সেই বঙ্গবীরদের মতোই যেন লাল সবুজের পতাকা আমরা তরুণ প্রজন্ম মাথা উঁচু করে ধরতে পারি। সত্যিকারের স্বাধীনতা এখনও অধরা রচিতা দেবনাথ শিক্ষার্থী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন ভূখণ্ড, নিজস্ব ভাষা আর মানচিত্রে ঠাঁইই কি আসলে স্বাধীনতা? দেশের জনগণই তার আসল প্রাণ। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতকে পৌঁছে যাওয়ার পরও দরিদ্রতার কবল থেকে মুক্ত করতে পারিনি দেশের অধিকাংশ জনগণকে, পারিনি তাদের মুখে দুবেলার খাবার তুলে দিতে। এই বিজয়ের মাসে যখন আমরা আনন্দে মেতে উঠি তখন আমাদেরই আশপাশের অনেকে শীত নিবারণ না করতে পারায় প্রাণত্যাগ করে। আজও রাস্তায় বেরোলে ‘পথশিশু’ হিসেবে আখ্যায়িত অনেক শিশুদের আবর্জনা ঘাটাতে দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রের সর্বত্রই মেয়েদের অংশগ্রহণ থাকলেও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। আমি মুসলিম আর তুমি হিন্দু বলে ভেদাভেদ এখনও মুছে যাচ্ছে না। বিদ্যালয় আর হাসপাতাল গড়েছি ঠিকই তবে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত অনেকেই। রোদ-বৃষ্টিতে খেটে আমাদের অন্নের যোগানদাতা কৃষক দিন শেষে নিজের খাবারের জন্য যুদ্ধ করে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশ হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতে পেরেছি। তবে যেদিন ১৬ ডিসেম্বরে দেশের সব মানুষ একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিজয় উল্লাস করবে সেদিনই আমরা আসল স্বাধীনতার স্বাদ পাব। আর পূরণ হবে লাখো মুক্তিযোদ্ধার দেখা স্বপ্ন। শান্তিপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে উঠুক মোমেনা আক্তার শিক্ষার্থী : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামের উৎপত্তি। ৪৭ বছর বয়সী বাংলাদেশ এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে, শুধু দাঁড়াতেই শেখেনি, সে এখন বিশ্বের দরবারে দাঁড়িয়ে বড় বড় জয় আনে। সেই বাংলাদেশ আজ খেলাধুলা, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। এসবের অবদানে বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সে সব শহীদকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা আজও সাক্ষী হয়ে আছেন এবং থাকবেন। এখন লক্ষ্য হচ্ছে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। যেখানে নারী-পুরুষ সবাই কাঁধে কঁাঁধ মিলিয়ে সমানতালে এগিয়ে চলবে। কোনরকম বঞ্চনা কিংবা ভেদাভেদ থাকবে না। নিজের যোগ্যতা আর কর্ম দিয়েই দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসবে সফলতা, সম্মান। তাই তো উঁচু-নিচু, জুলুম-শোষণ, দুর্নীতি-দুঃশাসন, দলীয় সংকীর্ণতা প্রভৃতিকে দূরে রেখে শান্তিপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। বিজয়ের মাস জন্মের মাস, জন্মের মতোই নিষ্পাপ হয়ে উঠুক বাংলাদেশের প্রতিটি প্রাণ থেকে ধূলিকণা পর্যন্ত। সবার আগে নিজেকে গড়তে হবে মালিহা ইয়াসমিন শিক্ষার্থী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৯ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নই তিনি বুনেছিলেন। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বাংলাদেশে সর্ব প্রথম মুক্তাঞ্চল হিসেবে যশোরের সর্বত্র উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা পেয়ে যাই আমাদের স্বাধীন মাতৃভূমিকে। আজ স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতকে দাঁড়িয়ে আমরা। সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি আজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গিয়েছে অনেক। বিশ্ব অর্থনীতির আমরা ৪১তম দেশ। মানব উন্নয়ন সূচকে ১৩৬তম। শূন্য থেকে শিখরে যাবার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েও যেন এখনও পথ আরও বেশ বাকি। প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো সেই জানানই দেয় আমাদের। জাতির পিতা বলেছিলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। স্বাধীনতার এতগুলো বছরে দাঁড়িয়েও কি আলোকিত মানুষ হতে পেরেছি আমরা?
×