ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় রায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শ

প্রকাশিত: ০৯:১১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

অজয় রায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শ

পদার্থবিজ্ঞানী ও স্বনামধন্য শিক্ষক অধ্যাপক ড. অজয় রায় আর আমাদের মাঝে নেই। প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা বিভাগে চিকিৎসাধীন থেকে গত রবিবার তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি থাকল সমবেদনা। অধ্যাপক অজয় রায় শুধু পদার্থবিজ্ঞানী এবং প্রথিতযশা শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিজ্ঞান শিক্ষার একজন নিবেদিতপ্রাণ গবেষক। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে আজীবন অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ কারণেই তিনি সকলের কাছে এক আদর্শ হয়ে থাকবেন। তিনি আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। পদার্থ বিদ্যায় উল্লেখ করার মতো তার কিছু গবেষণাও আছে। তার থেকেও বড় কথা যে, তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শ। এই আদর্শকে ধারণ করেই তিনি ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল স্বাধিকার ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। সর্বোপরি স্বাধীনতা যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করে বিশেষ অবদান রেখেছেন। অধ্যাপক অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যা বিভাগের একজন জনপ্রিয় প-িত শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নয় বিধায় অজয় স্যারের সরাসরি ছাত্র হবার সুযোগ পাইনি। আমাদের গ্রামের এক অগ্রজ ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যা বিভাগে অধ্যয়ন করত এবং শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। তার হাত ধরেই আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা এবং শুরুর দিকে কিছুদিন তার সঙ্গে আমাকেও শহীদুল্লাহ হলে থাকতে হয়েছিল। আমি তার কাছ থেকেই স্যারের ব্যাপারে জেনেছি। তারা কয়েক বন্ধু মিলিত হয়ে প্রতিদিন শ্রেণীকক্ষের পঠিত বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত এবং সেই আলচনায় মুহুর্মুহু উচ্চারিত হতো অজয় স্যারের নাম। সকলেই একবাক্যে বলত ‘অজয় স্যারের মতো দ্বিতীয় আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যা বিভাগে হবে না।’ পরবর্তীতে আবাসিক ছাত্র হিসেবে জগন্নাথ হলে চলে যাবার পর পদার্থ বিদ্যা বিভাগের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তারা অজয় স্যারের খুব প্রিয় ছাত্র ছিলেন। তাদের কাছ থেকেও স্যারের ব্যাপারে একই রকম মন্তব্য শুনেছি। তাদের সঙ্গে কয়েকবার স্যারের সান্নিধ্যে আসারও সুযোগ হয়েছিল। স্যারকে দেখে মনে হতো অঘাধ জ্ঞানের অধিকারী ধিরস্থির একজন মানুষ, যিনি খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন এবং অল্পের মধ্যেই মূল বক্তব্যটি বুঝিয়ে দিতেন। আমি ফাইন্যান্স বিভাগে পড়ছি শুনে বলেছিলেন ‘খুবই ভাল বিষয় এবং এটি নতুন খুলেছে। এখান থেকে পাস করে অনেক ভাল করতে পারবে।’ ভাল করেছি না খারাপ করেছি, তা নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও স্যারের সেই ছোট্ট মন্তব্য আমার জীবনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। সেইসঙ্গে স্যার আরও একটি কথা বলেছিলেন, ‘শুধু বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা করে খুব একটা লাভ হয় না। ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়েও যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হবে।’ অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্যারের সেই উপদেশটি মেনে চলার চেষ্টা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে দেশে নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠা পাবার ব্যস্ততা এবং পরবর্তীতে বিদেশে চলে আসার কারণে আর কখনই স্যারের সঙ্গে সাক্ষাত করার সুযোগ হয়নি। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু লেখা পড়ে স্যারের সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা করেছি। আজ স্যারের কথাগুলো খুব বেশি করে মনে পড়ছে। অধ্যাপক অজয় রায় ছিলেন মনেপ্রাণে একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিজে ধারণ করেছেন, প্রতি মুহূর্তে তা নিজে মেনে চলেছেন এবং সমাজে এই চেতনা এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নস্যাৎ করার যে অপচেষ্টা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নানান প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে হাতেগোনা যে ক’জন ব্যাক্তি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অজয় রায়। অনেক উত্থান পতনের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ফিরে এসেছে এবং সকল ধর্মের মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে, তার পিছনে যে কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে অজয় রায় একজন। অধ্যাপক অজয় রায়ের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনে প্রাপ্তি ও অর্জন আছে যথেষ্ট। তার অগণিত ছাত্রছাত্রী দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাদের মুখে মুখে অজয় স্যারের যে প্রশংসা এবং স্যারের প্রতি যে সকলের বিনম্র শ্রদ্ধা, সেটাই একজন সফল শিক্ষকের জীবনে বড় পাওয়া। তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা রয়েছে, যেগুলো দেশে-বিদেশে বেশ আলোচিত। ভবিষ্যতে কোন না কোন মেধাবী ছাত্রছাত্রী তার গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে ভাল কিছু করতে সক্ষম হবেন। তার কর্ম ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদকও পেয়েছেন নিজের জীবদ্দশাতেই। এত প্রাপ্তি ও সফলতার পরও শেষ জীবনে এসে বড় এক ব্যথা ও দুঃখ নিয়েই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। তিনি তার বড় ছেলে অভিজিৎ রায়কে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। অজয় রায় নিজে কখনও বিদেশে পাড়ি জমানোর চিন্তা না করলেও, ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন মুক্তচিন্তার দেশ আমেরিকায়। এখানে থেকেই অভিজিৎ অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে যান। ২০১৫ সালের একুশে বই মেলায় অংশ নিলে তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তির নির্মম আক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ছেলের এমন করুণ মৃত্যু অজয় রায় বাবা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। নানান প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা সফলভাবে মোকাবেলা করে জীবন সায়াহ্নে এসে এভাবে ছেলের লাশ কাঁধে নেয়ার মতো ঘটনা তার মতো মানুষের জীবনে ঘটবে, এটি কল্পনা করাও কঠিন। পরবর্তীতে সরকারের কিছু কঠিন পদক্ষেপের কারণে উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ হয়েছে। অনেক হামলাকারী নিহতও হয়েছে এবং যারা আটক হয়েছে তাদের বিচারও শুরু হয়েছে। এমনকি অভিজিৎ হত্যার বিচারও শুরু হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে তিনি সেই মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে সাক্ষী দিয়ে এসেছেন। তথাপি তিনি তার জীবদ্দশায় ছেলের হত্যার বিচার দেখে যেতে পারলেন না। নিশ্চয়ই খুব দ্রুত এই বিচার সম্পন্ন হবে এবং অভিযুক্তরা উপযুক্ত শাস্তি পাবে। আর তখনই তার আত্মা শান্তি পাবে। দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ফিরে এলেও এটিকে এগিয়ে নিতে হবে আরও অনেক দূর। আর এ কাজে যখন অজয় রায়ের মতো মানুষের বেশি প্রয়োজন, ঠিক তখনই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার এভাবে চলে যাওয়ায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার অগ্রযাত্রা সামান্য হোঁচট খেলেও থেমে থাকবে না। বরং আরও বেগবান হাবে এবং এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত থাকবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। কেননা তার আদর্শে উদ্ভাসিত অসংখ্য ব্যক্তি তার এই গুরুদায়িত্ব মাথায় নেবেন। আর এ কারণেই অধ্যাপক অজয় রায় তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শ হিসেবে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। লেখক : ব্যাংকার টরনটো, কানাডা [email protected]
×