ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্রশিক্ষণে বেশি জোর দিতে হবে’

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯

‘প্রশিক্ষণে বেশি জোর দিতে হবে’

এবারের এসএ গেমসে বাংলাদেশ তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ (১৯), রৌপ্য (৩৩), তা¤্র (৯০) ও পদক (১৪২) পেয়েছে। এই সাফল্যের জন্য যিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা। বাংলাদেশের সেরা সাফল্যে অনুভূতি জানতে চাইলে শাহেদ বলেন, ‘দেশের জন্য কিছু করতে পেরে অনুভূতি অনেক ভাল।’ কিভাবে এই অর্জন সম্ভব হলো জানালেন সেটাও, ‘আসর শুরুর আগে একটা প্ল্যান করেছিলাম। আগের আসরে আমরা জিতেছিলাম ৪টা গোল্ড। তার আগের আসরে ১৮ গোল্ড। এই ১৮ গোল্ডকে কিভাবে টপকাবো, এটা আমার মনের মধ্যে ছিল। তবে এটা কোনদিন প্রকাশ করিনি। শুধু নীরবে কাজ করে গেছি। বিভিন্ন ফেডারেশন যে যা চেয়েছে, সেই ফ্যাসিলিটিজ দেয়ার চেষ্টা করেছি, বিভিন্ন সেক্টরে খোঁজ নিয়েছি, যখন যেভাবে সুযোগ পেয়েছি সেভাবে বিভিন্ন দলকে বিদেশে প্রস্তুতির জন্য খেলতে পাঠিয়েছি। সবকিছু মিলেই শেষ পর্যন্ত এই সাফল্যটা এসেছে।’ ঢাকায় শাহেদকে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন করা হয়েছিল এবারের এসএ গেমসে বাংলাদেশ কোন্ কোন্ ডিসিপ্লিনে ও কয়টি স্বর্ণপদক জিততে পারে। কিন্তু কোনবারই ডিসিপ্লিন ও স্বর্ণপদকের সংখ্যাটা বলেননি তিনি। কেন বলেননি, সেটার কারণ জানালেন এবার, ‘এটা হচ্ছে আমাদের রিজিওনাল গেমস। এতগুলো ফেডারেশন আছে আমাদের। প্রায় সবাইকেই সুযোগ দিয়েছি খেলার জন্য। যদি বলতাম অমুক ফেডারেশনের বা অমুক খেলা থেকে গোল্ড আশা করছি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অন্য ফেডারেশনের মন ভেঙ্গে যেত। তারা মনে করত বিওএ’র মহাসচিব আগেই জানেন আমরা এসএ গেমস থেকে কোন গোল্ড আনতে পারব না। তাহলে আমাদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছে কেন? তাই এগুলো বলা কখনও উচিত নয়। আমার নীতি হচ্ছে সবাইকেই সুযোগ দেয়া। পারফর্ম করতে পারলে গোল্ড আসবেই।’ গত আসরের চেয়ে এবার বাংলাদেশ ১৫টি সোনা ও ২০১০ আসরের আরও ৪৫টি বেশি পদক জিতেছে। এই সাফল্যের কারণ সম্পর্কে বিওএ মহাসচিব জানান, ‘আমাদের যে টার্গেট ছিল, তাতে করে ৫ থেকে ৬টা গোল্ড মিস হয়েছে! কিন্তু তাতে অত দুঃখ নেই। কারণ আমরা এবার প্রচুর সিলভারও পেয়েছি। গোল্ড থেকে সিলভারের পার্থক্য এমন যে ৫-৬টা মেডেলের ক্ষেত্রে ফ্রিকশন্সের কারণে, নট অনলি ১ বা ২ পয়েন্টের জন্য। সুতরাং তারা খেলেছে, চেষ্টা করেছে। লাক ফেবার করেনি, তাই গোল্ড অল্পের জন্য পায়নি। আমি সবাইকে কংগ্র্যাচুলেট করি, সবাইকেই ধন্যবাদ জানাই।’ এবারের আসরে শাহেদ রেজা ট্রেনিংয়ের বিষয়টা নিজের হাতেই রেখেছিলেন। এ বিষয়ে বাড়তি নজর দিয়েছি। সবাই ট্রেনিং পাচ্ছে কিনা, ঠিকমতো ট্রেনিং করছে কি না, সবাই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে কি না ... এগুলো নিজে দেখেছেন। ‘তাদের আগেই বলে দিয়েছিলাম তোমরা যদি ভাল করতে না পার তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে তোমাদের আর কোন সুযোগ না-ও দেয়া হতে পারে। এই কারণে ফেডারেশনগুলোও খুবই সজাগ ছিল এবং তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করার পাশাপাশি তাদের প্লেয়ারদের বার্তা দিয়েছে তোমাদের অবশ্যই ভাল কিছু করতে হবে।’ শাহেদের ভাষ্য। এক আরচারি থেকেই বাংলাদেশ এবার জিতেছে ১০টি স্বর্ণ, এটাকে মূল্যায়ন করেন এভাবে? ‘এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে অবশ্যই অভিনন্দন জানাই আরচারি ফেডারেশনকে। তাদের এই সফলতার পেছনে যেসব কারণ তা হচ্ছে তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, তারা নিয়মিত অনুশীলন করা, তাদের নিজস্ব ভেন্যু আছে, তাদের ভালমানের জার্মান কোচ আছে যিনি প্রতিটি আরচারকে নিজের ছেলেমেয়েদের মতো যতœ করে ট্রেনিং দিয়েছেন। তাদের কোন ফিনান্সিয়াল প্রবলেমও ছিল না সিটি গ্রুপের ‘তীর’ তাদের স্পন্সর করায়। এ জন্য তাদের টাকার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আরচার ফেডারেশনের সভাপতি মাইনুল ভাই এবং সাধারণ সম্পাদক চপল দুজন অনেক আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন। এসব মিলিয়েই কিন্তু এই রেজাল্টটা এসেছে। ভবিষ্যতে যদি এ রকম আরও দু’চারটা ফেডারেশনকে এ রকম সুযোগ করে দিতে পারি অথবা ফেডারেশনের কর্মকর্তারা যদি এ রকম সুযোগগুলো নিতে পারেন তাহলে ডেফিনিটলি এ রকম রেজাল্ট করতে পারবে ইনশাল্লাহ।’ স্বর্ণজয়ের প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে যাবার আনন্দ যেমন আছে, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে হতাশাও আছে। এবারের আসরে বাংলাদেশের ২৫টি ফেডারেশন অংশ নিলেও তার মধ্যে পাঁচটি ফেডারেশন কোন পদকই জিততে পারেনি। এগুলো হচ্ছে : ভলিবল, বাস্কেটবল, সাইক্লিং, টেনিস এবং স্কোয়াশ ফেডারেশন। ২০১৬ আসর পর্যন্ত বাংলাদেশ যত স্বর্ণ জিতেছে (৬৭), তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২২টি স্বর্ণপদকই এসেছিল শূটিং থেকে। ২০০৬ আসরের পর এই প্রথমএবারের আসরে কোন স্বর্ণ জেতেননি বাংলাদেশী শূটাররা। এ প্রসঙ্গে শাহেদের মন্তব্য, ‘প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির সমন্বয় কতটা হয়েছে, এ নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না। সবাই স্বর্ণ জিততে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। আসলে সব জিনিসই হঠাৎ করে হয় না। এরজন্য প্রয়োজনীয় ও পূর্ব প্রস্ততি লাগে। বিওএ সেটাই করার চেষ্টা করেছে। সেই সঙ্গে এনএসসি ও সরকারও এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে।’ নেপালে অনেক ফেডারেশনের কর্মকর্তাই জানিয়েছেন, এসএ গেমস পর্যন্ত বিওএ তাদের যেভাবে সহযোগিতা করেছে গেমস শেষ হয়ে গেলেই তারা আর কোন খোঁজ-খবর নেবে না। এ ব্যাপারে শাহদের ব্যাখ্যা, ‘এ ব্যাপারটা বিওএ’র হাতে নেই। কারণ ফিনান্সিয়াল ম্যাটার তো অলিম্পিক দেখে না। অলিম্পিকের নিজস্ব কোন অর্থ নেই। এ ব্যাপারে যদি তারা স্বাবলম্বী থাকত তাহলে তো বিওএকে কারও কাছ থেকে অর্থ নিয়ে কাজ করার দরকারই হতো না। সারাবছরই ট্রেনিং করাতে পারত।’ কারাতে ইভেন্টে এবার বেশ ভাল ফল এসেছে। ৩টি স্বর্ণপদক এসেছে। অথচ কারাতেকারা জানিয়েছেন তাদের অনেক সমস্যা, তাদের অনুশীলনের জন্য আলাদা একটি কমপ্লেক্স দরকার। এ ব্যাপারে বিওএ’র করণীয় কী? ‘ভেন্যু বা কমপ্লেক্স দেয়ার ক্ষমতা তো অলিম্পিকের নেই। ভেন্যু বরাদ্দ হচ্ছে সরকারের ব্যাপার। তবে আমি মনে করি প্রতিটি ফেডারেশনেরই আলাদা বা নিজস্ব ভেন্যু থাকা উচিত, যেখানে তারা যেন সারাবছর ধরে প্র্যাকটিস করতে পারে।’ শাহেদ রেজা আরও জানান, ‘দেশে ফিরে এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। সোমবার ছেলেদের ক্রিকেটে বাংলাদেশ স্বর্ণ জেতার পর প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করেছিলেন। তখন মাঠেই ছিলাম। তখন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল, সেটা আমি প্রধানমন্ত্রীকে শোনালাম, তিনি তখন তার বাসায়। জাতীয় সঙ্গীত শুনে ভীষণ খুশি হয়েছেন তিনি। ১৯ স্বর্ণজয়ের খবর শুনে তিনি বললেন, স্বর্ণজয়ী সব ক্রীড়াবিদদের তিনি গণভবনে আমন্ত্রণ জানাবেন। তখনই আমি আলাদাভাবে তার সঙ্গে বসব এবং আমার যেসব প্রোগামস আছে, সেগুলো তাকে অবহিত করব। প্রধানমন্ত্রী এসএ গেমসের আগে আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন বলেই আমি সবকিছু ম্যানেজ করতে পেরেছি। এসব তো সব তারই অবদান। এর ফলেই তো আজকের এই রেজাল্ট। এছাড়া এর আগেও ক্রীড়াঙ্গনের যে কোন সমস্যায় যখনই তার কাছে কোন সাহায্য করেছি, তিনি সেটা আমাকে দিয়েছেন। সরকারের কাছে নিজের চাওয়াটা কি, সেটাও জানান শাহেদ, ‘যেহেতু আমরা এবার সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করেছি, সেহেতু ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে বলব তারা যেন ট্রেনিং বাবদ একটা বাজেট করেন এ্যাথলেটদের দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের জন্য। তিন বা চার মাসের জন্য করে লাভ নেই। শুধু এসএ গেমস নয়, এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসের কথা মাথায় রেখেও বাজেট রাখতে হবে। বাজেট তৈরি করে সেটাকে কার্যকরও করতে হবে। সেই সঙ্গে আরেকটা কাজ করতে হবে। আমাদের ক্রীড়া স্থাপনা তৈরি বা মেরামতের চেয়ে ট্রেনিংয়ের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই আসরে স্বাগতিক নেপাল ঠিক এই কাজটিই করেছে, যার দারুণ সুফলও তারা পেয়েছে অনেক বেশি গোল্ড জিতে।’
×