ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্য ঝুঁকি চরমে

টাঙ্গাইলের বাজারে নেই কসাইখানা

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯

টাঙ্গাইলের বাজারে নেই কসাইখানা

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ১১ ডিসেম্বর ॥ টাঙ্গাইল পৌর এলাকার কোন বাজারেই পশু জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত কসাইখানার ব্যবস্থা নেই। ফলে মাংস বিক্রেতা নিজেদের মতো করে পশু জবাই করে বাজারে মাংস বিক্রি করছে। ফলে শহরের যত্রতত্র ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পশু জবাই করা হচ্ছে। জবাইয়ের আগে এসব পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হচ্ছে না। নেই পশু সম্পদ বিভাগের কোন তদারকি। টাঙ্গাইল পৌরসভার তদারকি করার কথা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে টাঙ্গাইল পৌরবাসী। অনুসন্ধান করে জানা যায়, ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সেনাবাহিনী তাদের পশু জবাইয়ের জন্য টাঙ্গাইল স্টেডিয়ামের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি জবাই খানা তেরি করে। মির্জা বেলায়েত হোসেন নামে এক পৌর কর্মচারী তখন পশু জবাইয়ের দায়িত্বে ছিল। পরে টাঙ্গাইল পৌর কর্তৃপক্ষ এটাকে তাদের কসাইখানা হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। টাঙ্গাইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার জায়গায় জবাই খানাটি হওয়ায় ও স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করাতে ১৯৮৮ সালে জবাই খানাটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ফলে পৌর কর্তৃপক্ষ একটি ছোট আকারের জবাই খানা শহরের পার্ক বাজারের মাংসের বাজারের পাশে স্থাপন করে। ২০১২ সালে জবাই খানাটি ভেঙ্গে উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় পৌর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভূমির মালিকানা নিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা ভূমি অফিসের মধ্যে জটিলতা দেখা দেয়ায় এর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকেই মাংস বিক্রেতারা যে যার মতো করে যত্রতত্র পশু জবাই করছেন। নিয়ম অনুসারে, পশু জবাই কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব পশু সম্পদ অধিদফতর এবং পৌরসভার স্যানেটারি বিভাগের। কিন্তু লোকবলের অভাবে পশু সম্পদ অধিদফতর জবাইয়ের আগে পরীক্ষার জন্য কোন ভেটেরিনারি চিকিৎসক পাঠান না। পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের লোকজন প্রতিদিন পশু জবাইয়ের আগে তা দেখে আসেন। সম্প্রতি কয়েকটি দিন সকালে শহরের পার্ক বাজার, বেবি স্ট্যান্ড বাজার, বটতলা বাজার, সাবালিয়া পৌর বাজারসহ পৌর এলাকার বিভিন্ন বাজার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মাংস বিক্রেতারা যে যার মতো পশু জবাই করছেন। পৌর কর্তৃপক্ষ আবুল বাসার নামে একজনকে নিযুক্ত করছে পশু জবাই করার জন্য। তার পক্ষে পৌর এলাকার সব বাজারে গিয়ে পশু জবাই করা সম্ভব নয়। তাই যার যার সুবিধা মতো পশু জবাই করছে। আর ষাঁড়, গাভী, ছাগল, খাসি এটা দেখে সিল মারছে পৌরসভার মাস্টার রোলের কর্মচারী হাসমত আলী। এছাড়া পার্ক বাজারে গরু ও খাসি জবাইের জায়গার ব্যবধান খুবই অল্প। পশু সম্পদ দফতরের কাউকে উল্লেখিত বাজারগুলোতে এ সময় পাওয়া যায়নি। বটতলা বাজারের মাংস বিক্রেতা গজনবী মিঞা ও কাদের জানান, তারা প্রতিদিন প্যারাডাইসপাড়ায় নদীর পাড়ে পশু জবাই করে ভ্যানে করে সকালে বটতলা বাজারে মাংস নিয়ে আসেন। পৌর কর্তৃপক্ষের কেউ এসব পশু জবাইয়ে তদারকি করে না বলে তারা জানান। পার্ক বাজারের মাংস ব্যবসায়ী খোকা মিঞা বলেন, প্রতিদিন সকালে দোকানের সামনে খালি জায়গায় পশু জবাই করে তারপর মাংস বিক্রি করি। কোন কোন দিন পৌরসভার একজন কর্মচারী এসে ষাঁড় না গাভী, সেই সিল মেরে চলে যায়। পার্ক বাজারের মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিয়া সাজু জানান, ২০১১ সালে পৌরসভার পার্ক বাজারের জবাই খানাটি ভাঙ্গার পর থেকে তারা তাদের দোকানের আশপাশে পশু জবাই করছেন। সম্প্রতি পৌরসভার মেয়র জামিলুর রহমান মিরন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) উপমা ফারিসা পার্ক বাজারের জবাই খানার জায়গা পরিদর্শন করে গেছেন। আমরা তাদের কাছে দাবি জানিয়েছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পার্ক বাজারের জবাই খানাটি তৈরি করে দেবার জন্য। পার্ক বাজারে গরুর মাংস কিনতে আসা শহরের আদালত পাড়ার বাসিন্দা করিম খান বলেন, যেহেতু পশু জবাইয়ের আগে পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ওপর মাংস কিনতে হয়। বাজারে নিরাপদ মাংস নিশ্চিত করতে আধুনিক পশু জবাই কেন্দ্র নির্মাণ এবং সেখানে জবাইয়ের আগে প্রতিটি পশু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। একই বাজারে খাসির মাংস কিনতে কৃষ্ণ রায় জানায়, আমি জানি না কিভাবে খাসি জবাই করা হয়েছে। ওটা খাসি না ছাগী সেটাও জানি না। এছাড়া গরুর মাংস আর খাসির মাংস পাশাপাশি বিক্রয় করা হয়। যে কারণে মাংস কিনে তৃপ্তি পাই না। খাসির মাংস একটা আলাদা জায়গায় বিক্রয় করলে মনে হয় ভাল হতো। আশা করি, কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার স্যানেটারি পরিদর্শক খন্দকার আব্দুল কাদের সিরাজুল ইসলাম জানান, পৌরসভার কর্মীরা কোন অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত গরু জবাই করছে কিনা সে বিষয়টি দেখেন। এছাড়াও ভেড়া বা ছাগী, খাসি হিসেবে বিক্রির জন্য জবাই করছে কিনা তাও দেখেন। তবে তাদের পরীক্ষা করে দেখার কোন ব্যবস্থা নেই। খালি চোখে দেখেই রোগাক্রান্ত কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। খোলা জায়গায় পশু জবাইয়ের ক্ষতিকর দিক বিষয়ে টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন শরীফ হোসেন বলেন, খোলা জায়গায় পশু জবাই করা হলে জবাইকৃত পশুর রক্ত থেকে ব্রুসোলেসিস ও এ্যানথ্রাক্সের মতো ছোঁয়াচে রোগ ছড়াতে পারে। এই রোগ ছোঁয়াচে। যে পশু জবাই করে সে ও যারা ওই মাংস খাবে তারা রোগাক্রান্ত হতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের উত্তরবঙ্গে এ্যানথ্রাক্স রোগ দেখা গেছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব টাঙ্গাইল পৌর কর্তৃপক্ষর জবাই খানা তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া উচিত। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. আবু সাঈদ সরকার জানান, পশু জবাই করার আগে তা রোগাক্রান্ত কিনা ভেটেরিনারি চিকিৎসক দিয়ে তা পরীক্ষা করে নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু লোকবলের অভাবে পশু সম্পদ বিভাগ থেকে ভেটেরিনারি চিকিৎসক পাঠানো সম্ভব হয় না। এলডিপি প্রকল্পের আওতায় একটি অত্যাধুনিক হাউস (জবাই খানা) নির্মাণ করার প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জবাই খানা নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণ বিষয়ক চুক্তি খুব শীঘ্রই টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়রের সঙ্গে করা হবে বলে তিনি জানান। এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র জামিলুর রহমান বলেন, গত এক বছর যাবত জেলা প্রশাসনের সঙ্গে জবাই খানার জায়গার বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করছি। ইতোমধ্যে টাঙ্গাইল পৌর এলাকার বাজারগুলোর জন্য একটি অত্যাধুনিক জবাইখানা তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আশা করি, অতি দ্রুতই টাঙ্গাইলবাসীকে একটি জবাই খানা উপহার দিতে পারব।
×