ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বে এত অসহিষ্ণুতা কেন?

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯

বিশ্বে এত অসহিষ্ণুতা কেন?

বিগত বছরগুলোতে আমাদের হতাশ করতে করতে পুরো বিশ্বের প্রায় অর্ধেকের মতো দেশে অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া ভিন জাতি ও ধর্মের মানুষের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতার বহির্প্রকাশ অনাকাক্সিক্ষত অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে মানুষ বহু দূরের কৃষ্ণগহ্বর, চাঁদ, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনিতে মহাকাশযান পাঠিয়ে কোটি কোটি মাইল দূরের এসব গ্রহের গঠন, জলবায়ু, পানি বা বরফের উপস্থিতি ইত্যাদির খুঁটিনাটি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে, যা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতিকে প্রায় মূল্যহীন করে দেবে বলে আমাদের মনে হয়েছিল। এমনকি সম্প্রতি সূর্যের করোনার উচ্চ ডিগ্রীর উষ্ণতাকে ভেদ করে নাসার মহাকাশযান (পার্কার) সূর্যের নানা তথ্য সংগ্রহ করে পাঠিয়েছে। সূর্য পৃথিবী থেকে বহু কোটি মাইল দূরে অবস্থিত। মানুষের জ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই মাইলফলক অর্জনের পর পৃথিবীতেই দেখতে হচ্ছে মানুষের মধ্যে ভয়ঙ্কর অবিবেকী উগ্র বৈষম্যমূলক, বিদ্বেষমূলক আচরণ! আজ অবাক হচ্ছি, সাহিত্যিক বাবা ’৭১-এ বাঙালী মুসলমান যে চিরকালের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং আর কখনও সাম্প্রদায়িক আচরণ তার মধ্যে দেখা যাবে নাÑ এমন গভীর বিশ্বাস থেকে লিখেছিলেন, যেটি ’৭৫ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে আবারও রক্তাক্ত সামরিক শাসনের সূচনায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল! তবে তিনি জাতীয় জীবনকে পুনরায় স্বস্থানে ফিরিয়ে আনবার জন্য সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার এবং দ্রুত নির্বাচন দেয়ার শর্তে উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের প্রতি একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিকের কর্তব্য পালন করতে সম্মত হয়ে পরে বিফল মনোরথ হয়ে অন্য উপদেষ্টাদের বেশ আগেই পদত্যাগ করেন। যা হোক, মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের হামলায় আক্রান্ত রোহিঙ্গা গোষ্ঠী দলে দলে বাংলাদেশের উখিয়া, রামু, কক্সবাজার এলাকায় স্বদেশ ত্যাগ করে অনুপ্রবেশ করে এবং ২০১৭ সালে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। এই সময়ে আমরা দেখতে পাই ধর্ম ও দেহবর্ণ, ভাষাভিত্তিক এক চরম বিদ্বেষমূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ প্রধানত ইরাক, সিরিয়া এবং আফ্রিকার লিবিয়া ও খরা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ধনী ইউরোপের দেশগুলোতে যাত্রা করেছে যুদ্ধ ও খরায় আক্রান্ত বাস্তুচ্যুত অগণিত নারী পুরুষ শিশুর দল। এরা স্বেচ্ছায় নয়, যুদ্ধ এবং খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের ফলে দেশত্যাগ করে উদ্বাস্তু হয়েছে। ইউরোপের ধনী দেশগুলোর এখন সময় হয়েছে, স্মরণ করার যে বিগত অষ্টাদশ, ঊনবিংশ, বিংশ ও শতাব্দীজুড়ে তারা এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোকে উপনিবেশ হিসেবে দখল করে সেসব দেশের সব রকম ধনসম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য, খনিজ ও কৃষিপণ্য ইউরোপের নিজ দেশে পাচার করেছিল, যে সম্পদ তাদের শিল্প বিপ্লব এবং অর্থনৈতিক উন্নতির মূল ভিত্তি তৈরি করেছিল! আশ্চর্য এই যে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডসসহ পুরো ইউরোপ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আগে ছিল খুবই দরিদ্র দেশ। ওদের শিল্প বিপ্লবের পুঁজি গঠন করে আমাদের দেশের মতো সব উপনিবেশের দরিদ্র কৃষক, তাঁতি, কারিগর শ্রেণী! সেই যুগে শুধু বাংলাদেশে বাণিজ্য করে ইংরেজ লর্ডদের স্বদেশে নিয়ে যাওয়া লাখ লাখ পাউন্ডের হিসাবের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এই ভেবে আশ্চর্য লাগে যে, সে যুগের লাখ পাউন্ড আজকের হিসেবে কতই না বেশি ছিল! কেননা, তখন এক পয়সারও মূল্যমান ছিল উচ্চ! ওরা শুধু উপনিবেশই প্রতিষ্ঠা করেনি, তারা উপনিবেশের দরিদ্র মানুষগুলোকে দাস হিসেবে গরু-ছাগলের মতো বেঁধে জাহাজে করে পাচার করেছিল। বছরের পর বছর যাদের দিয়ে তাদের দেশের, প্রধানত কৃষি কাজ ও বিশাল বিশাল নির্মাণ কাজ করিয়ে নিয়ে দেশগুলোর সার্বিক উন্নয়ন সাধন করেছিল। তাদের অদ্ভুত অসহিষ্ণুতার একটি নিদর্শন প্যালেস্টাইনি আরবদের বাস্তুভূমির একটি অংশকে যে ইহুদীদের ইউরোপীয় খ্রীস্টানরা অপছন্দ করত, তাদের জন্য পৃথক আবাসভূমি, ‘ইসরাইল’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল! অথচ ইহুদীরা ছিল জার্মান, রাশিয়ান, পোলিশ ইত্যাদি জাতির অন্তর্গত। অপরদিকে মুসলিম বিদ্বেষের ফলে প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলো না এখনও পর্যন্ত। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর অন্যায্য স্বীকৃতি দিয়ে প্যালেস্টাইন-ইসরাইলের মধ্যকার চলমান যুদ্ধাবস্থা, অসহিষ্ণুতায় ঘৃতাহুতি দিল! ইতিমধ্যে প্রধানত আরব মুসলিমদের মধ্যে চলমান শিয়া-সুন্নি বিভেদকে পুঁজি করে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদী পথে ভিন ধর্মের, ভিন ধারার ধর্মীয় গোষ্ঠীকে হত্যা করার এক দানবীয় কর্মকা- শুরু করে প্রধানত আইএস-তালেবান-আল কায়েদা তৈরির মাধ্যমে! ভুললে চলবে না, এদের সৃষ্টি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মদদে আফগানিস্তান থেকে সমাজতন্ত্র উচ্ছেদের লক্ষ্যে এবং রাশিয়ান সৈন্যদের বিতাড়িত করতে। এভাবে দ্রুত উন্নয়নের পথে যাত্রা করা সমাজতান্ত্রিক আফগানিস্তান আজকের ধ্বংসপ্রাপ্ত, বোমাবাজ, আত্মঘাতী খুনী আইএস-তালেবানদের অসুহিষ্ণু হামলার লক্ষ্যবস্তু ও ধর্মান্ধ দেশ! আইএস ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার পরিকল্পকও কিন্তু সিআইএ। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার ফল ছিল মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র তৈরি করে শিয়া প্রধান ইরানকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের তেল, গ্যাসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা! রাশিয়ার দ্রুত হস্তক্ষেপের ফলে ঐ পরিকল্পনা বানচাল হয় এবং হত্যা-ধর্ষণের অরাজক কর্মকা- করা আইসিসের হাত থেকে ইরাক-সিরিয়া রক্ষা পায়। যুক্তরাষ্ট্রের বোম্বার প্লেনগুলো তখনও, এখনও কিন্তু আফগানিস্তানে বা ইরাক-সিরিয়ায় নিরীহ নাগরিকের ওপর, বিয়ের আসরে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বোমা হামলা চালাচ্ছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নির মধ্যে যে বিভেদ, অসহিষ্ণুতা প্রচলিত আছে, সেটি কিন্তু অন্য মুসলিম প্রধান দেশের মতোই স্ব স্ব গোষ্ঠীর দ্বারাই তৈরি ও পরিচালিত। এদের হামলার লক্ষ্য হলো- ভিন্ন মতের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান এবং বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক মানুষ- কবি, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী! এদের মতে অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও ভিন্ন ধর্মমতে বিশ্বাসী হওয়া হত্যাযোগ্য অপরাধ! এই কালোমনের দানবগুলো হিটলারের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, যারা বিজ্ঞানের বাস্তব আবিষ্কারগুলো দেখেও হত্যা করে বেহেশতে যাবার সহজ পথে এই বিজ্ঞানের যুগেও বিশ্বাস করে! তাছাড়া, বিজ্ঞানে বিশ্বাস না করে কেন তারা ইউটিউব ও অন্য প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরীহ ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ জ্বালাময়ী সংবিধানবিরোধী বক্তব্য প্রচার করে নিজেদের কালো দানব হিসেবে সবার কাছে উপস্থাপন করে, সেটিও কম আশ্চর্যজনক নয়। এদেরকে তো এক্ষুণি সাইবার অপরাধ আইনে গ্রেফতার করে এবং রাষ্ট্র বিরোধিতার জন্য চরম দ-ে দ-িত হবার কথা। একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ইউরোপে, বলকান যুদ্ধে, খ্রীস্টান সার্বরা হাজার হাজার মুসলিম সার্ব নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করেছিল! অথচ ওরা সবাই ছিল সার্ব জাতি। সম্প্রতি ভারতে মোদি সরকার ‘এনআরসি’ প্রণয়ন করে সংখ্যালঘু বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব থেকে বাদ দিয়ে ভারত থেকে বহিষ্কার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চলেছে। এর চাইতে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক পদক্ষেপ আর কি হতে পারে? ভারতের মূল বৈশিষ্ট্য ধর্মনিরপেক্ষতা। যে কারণে ’৪৭ সালে ভারত ভাগ হলেও ভারতে কয়েক কোটি মুসলিম ও অন্যান্য গোষ্ঠী ভারতীয় হিসেবে ভারতে থেকে গেছে। তাছাড়াও মানুষের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য- মানুষ যখন যেখানে তার অভিরুচি হয়েছে সেখানে সে বসতি স্থাপন করেছে। আদিম যুগ থেকেই মানুষ চিরকাল পরিব্রাজক, যাযাবর ও দেশান্তরী। পৃথিবীর যে কোন স্থানে বসতি স্থাপনের সে অধিকারী। যে রাজনৈতিক সীমারেখা কৃত্রিমভাবে ক্ষমতাবান কিছু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা সৃষ্টি করেছে, তারা বোঝে না, মানুষ তাদের তৈরি ঐ সীমা বার বার লঙ্ঘন করে, করছে, করবে। সীমান্তরক্ষীর গুলিতে প্রাণ যাবার শঙ্কার মধ্যেও মানুষ বারবার বর্ডার পার হয়! মানুষের এ পারাপার, এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবার অব্যাহত গতি আসলে কোন সরকার ক্ষমতা বা পুলিশ দিয়ে বন্ধ করতে পারে না। এই স্থানান্তর চলতেই থাকবে। তবে মিয়ানমার সরকার বা ভারত সরকারের দ্বারা মানুষকে তার বসতি থেকে উচ্ছেদ করা অমানবিক ও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। উল্লেখ্য, আফ্রিকার দেশগুলোতে ছিল প্রকৃতি ও মানুষের শান্তিপূর্ণ বাসস্থান। বর্তমানে সেই আইএস, সেই সুন্নি মুসলিম গোষ্ঠী আফ্রিকাকে করে তুলেছে বোমা, ধর্ষণ, হত্যা এবং ধর্মান্ধতার স্থান। এক সময় আমরা দেয়ালে প্রচার দেখতাম- ‘ভিসামুক্ত বিশ্ব চাই’। মনে হয় সময় এসেছে আবারও ভিসামুক্ত বিশ্বের দাবি তোলার। লেখক : শিক্ষাবিদ
×