ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

আরচারির হাত ধরে এলো সেরা সাফল্য

প্রকাশিত: ১২:৩২, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

আরচারির হাত ধরে এলো সেরা সাফল্য

দক্ষিণ এশিয়ার ক্রীড়ার সবচেয়ে বড় আসর এসএ গেমসে নিজেদের ইতিহাস সেরা পারফর্মেন্স প্রদর্শন করেছে বাংলাদেশ। লাল-সবুজের দেশের এই সাফল্য এসেছে মূলত আরচারিতে আকাশছোঁয়া সাফল্যের কারণে। পাশাপাশি ক্রিকেটে ছেলে ও মেয়েরাও দেশের মান রেখেছেন। এই দুই ইভেন্টে তাক লাগানো সাফল্য ও স্বর্ণজয়ের দিক দিয়ে আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেও বাংলাদেশের সার্বিক পারফর্মেন্স সন্তোষজনক নয়। কয়েকটি সম্ভাবনাময় ইভেন্টে হতাশ করেছেন এ্যাথলেটরা। তবে স্বর্ণ জয়ের দিক দিয়ে সাফল্যের নতুন শিখরে পা রেখেছে বাংলাদেশ। এবারের আগে সেরা সাফল্য ছিল ২০১০ সালে। সেবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত আসরে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা জিতেছিল ১৮ স্বর্ণপদক। এবার বাংলাদেশের ভা-ারে জমা হয়েছে ১৯ স্বর্ণপদক। দেশের বাইরের গেমসে আগের সেরা সাফল্যকে পেরিয়ে এবার যোজন যোজন এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ১৯৯৫ ভারতের মাদ্রাজ আসরে পাওয়া ৭ স্বর্ণপদক ছিল আগের সেরা। এবার বাংলাদেশ যা কিছু পেয়েছে তার সবই এসেছে আরচারি ও ক্রিকেট থেকে। বিশেষ করে আরচাররা ১০ ইভেন্টের সবকটিতেই স্বর্ণ জিতে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। বাংলাদেশের কোন ক্রীড়ায় এটাই সর্বোচ্চ সাফল্য। রঙ্গশালা আরচারি রেঞ্জে সব প্রতিপক্ষকে রীতিমতো উড়িয়ে দেন রোমান সানা, ইতি খাতুনরা। কম্পাউন্ড নারী ব্যক্তিগত ইভেন্টে খেলারই কথা ছিল না সোমা বিশ্বাসের। দলে ছিলেন স্ট্যান্ডবাই হিসেবে। অথচ তিনিই কিনা খেলার সুযোগ পেয়ে করেছেন বাজিমাত। সোনালি সাফল্য কুড়িয়ে নিয়ে ফাইনালে ১৪২-১৩৪ পয়েন্টে শ্রীলঙ্কার অনুরাধা করুনারতেœকে হারিয়ে জিতেছেন চুয়াড়াঙ্গার এই মেয়ে। স্বর্ণসাফল্যের পরপরই আবেগে ভেঙ্গে পড়েন মাগুরার তীরন্দাজ সোমা। আকুলভাবে কাঁদতে থাকনে। ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিলেন না। সোমার হৃদয়ের কোনে সযতেœ লালিত একটি স্বপ্ন ছিল। দেশসেরা আরচার রোমান সানার মতো একদিন তিনিও বিজয় মঞ্চে উঠবেন, স্যালুট দেবেন লাল-সবুজ পতাকাকে। সেই স্বপ্ন যে এত শীঘ্রই পূর্ণ হবে, এতটা ভাবতে পারেননি। ‘আমার এই পর্যায়ে আসার পেছনে চপল স্যার, জিয়া স্যার এবং মার্টিন স্যারের অনেক অবদান ছিল। তাদের সাপোর্টের কারণে আজ এত দূর পর্যন্ত এসেছি।’ এক সময় খো খো ও ক্রিকেট খেলা মিরপুর বাংলা কলেজের শিক্ষার্থী সোমার প্রতিক্রিয়া। এবার আসা যাক স্ট্যান্ডবাই থেকে কিভাবে সোমা সোমবার খেলার সুযোগ পেলেন। কম্পাউন্ড নারীদের মধ্যে সেরা তিন আরচার হচ্ছেন বন্যা আক্তার, শ্যামলী রায় ও সুস্মিতা বণিক। সোমা স্ট্যান্ডবাই। তাই খেলার প্রত্যাশাটাও ছিল না সোমার, ‘আমার প্রত্যাশা ছিল না এ ইভেন্টে স্বর্ণ পাব। কেউ আশাও করেনি। আমি ছিলাম টিমের চার নম্বর প্লেয়ার। কারণ এখানে খেলতে আসার আগেরদিনও আমাকে পরীক্ষার হলে বসতে হয়েছিল। তার আগে পাঁচদিন অনুশীলন করতে পারিনি টানা দুটি পরীক্ষা থাকার কারণে। আরচারি এমন একটি খেলা যেখানে একদিন অনুশীলন না করলেই ফিটনেস থাকে না। সবকিছু মিলিয়ে আমার আত্মবিশ্বাস শতভাগ ছিল না। টিম ও কোচেরও আত্মবিশ্বাস কম ছিল। তারপরও তারা আমাকে খেলার সুযোগ দেন। এজন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ ৮ ডিসেম্বর আরচারির দলগত ও মিশ্র ইভেন্ট থেকে এসেছিল ছয় স্বর্ণ। আর ৯ ডিসেম্বর ছিল চারটি ব্যক্তিগত ইভেন্ট। যেগুলো নিয়েই দৃষ্টি থাকে সবার। বাংলাদেশ দলের কোচরা রোমান সানা, ইতি খাতুন ও সোহেলের প্রতি আস্থা রাখলেও সোমাকে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। সেই সোমা তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে পেরে গর্বিত, ‘আমার ইভেন্ট নিয়ে সবার শঙ্কা ছিল। সবাই স্বর্ণ জিতছে, যদি আমার ইভেন্টটাতে হাতছাড়া হয়ে যায়, এটা নিয়ে সত্যিই চাপের মধ্যে ছিলাম।’ এসএ গেমস আরচারিতে খেলার জন্য ১ ডিসেম্বর নেপালে যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ দলের। কিন্তু সোমার ডিগ্রী পরীক্ষার কারণে ফ্লাইট দু’দিন পিছিয়ে দেয় ফেডারেশন। ফলে দ্বিগুণ চাপে পড়ে যান সোমা। এ নিয়ে সোমার আবেগী ভাষ্য, ‘একদম সত্যি কথাÑ আমার নিজের প্রতি কোন আত্মবিশ^াস ছিল না। কারণ আমার পরীক্ষা ছিল। আমার পরীক্ষার কারণে তারা নেপালে আসার ফ্লাইট দুইদিন পিছিয়ে নিয়েছিলেন। এতগুলো টিম আমার জন্য দু’দিন অনুশীলন করতে পারেনি। আসার পরে আমি যাই করি না কেন আমি যেন মানসম্মান রাখতে পারি। সেটা রাখতে পেরেছি বলে আমি খুশি।’ আরচারিতে আসার আগে নিয়মিত ক্রিকেট ও খো খো খেলেছিলেন সোমা। বড় ভাই আনোয়ার হোসেন একসময় আরচারি খেলেছিলেন (এখন তিনি কোচ)। তার মাধ্যমেই ২০০৯ সালে আরচারি খেলা শুরু করেন সোমা। কলেজে পড়ার সময় জাতীয় দলের আরচার কোচ ফারুক ঢালির চোখে পড়েন। শুরু করেন ব্যাম্বো ইভেন্ট দিয়ে। ২০১৪ সাল। যোগ দেন বাংলাদেশ আনসারে। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০১৮ সালে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পান সোমা। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে গত বছর দলীয় ইভেন্টে স্বর্ণপদক থাকলেও এককে জেতেন রৌপ্য। মজার ব্যাপার- ঘরোয়া আসরে স্বর্ণপদক না জিতলেই আন্তর্জাতিক আসরেই প্রথম স্বর্ণ জিতলেন। পোখরায় আরচারির কম্পাউন্ড পুরুষ ব্যক্তিগত ইভেন্টে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে স্বর্ণ জিতেন বাংলাদেশের সোহেল রানা। ভুটানের তানদিন দর্জিকে ১৩৭-১৩৬ পয়েন্টে হারিয়ে স্বর্ণ জয় করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছেলে সোহেল। এবারের আসরে সোহেলই প্রথম আরচার, যিনি স্বর্ণ জয়ের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। সোহেলের পর তিনটি স্বর্ণ জেতেন রোমান সানা ও ইতি খাতুন। তবে তার আগে ১৯৮৫ সাফ গেমসে সাঁতার ডিসিপ্লিনে ঢাকায় পাঁচ স্বর্ণ জিতেছিলেন মোশাররফ হোসেন। আরচারির প্রথম হ্যাটট্রিকম্যান সোহেল বলেন, ‘মূলত এ দিকে আমার কোন খেয়ালই ছিল না। ভেবেছিলাম প্রথম ম্যাচ হবে রিকার্ভ বিভাগে। হঠাৎ নাম ঘোষণা করায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। জিয়াউর স্যার সাহস দেন। তারপরও প্রথম দুই সেটে একটু পিছিয়ে যাই। কিন্তু সাহস হারাইনি। যখন আমাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় তখন বিশ্বাসই হয়নি। কত আনন্দ পেয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’ শৈশবে খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন। একটু বয়স বাড়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় লীগ ক্লাবের হয়ে দারুণ খেলতেন। একদিন অনুশীলনের সময় দেখেন তাদেরই শহরে আরচারির উদ্বোধন হচ্ছে। খেলাটি দেখে আকর্ষিত হন। রাজশাহীর একটি ক্লাবে ভর্তিও হন। এরপর খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। এরপর তরতর করে সামনের পানে এগিয়ে চলা। ফুটবলে নয়, আন্তর্জাতিক সাফল্য কুড়িয়ে নিলেন আরচারিতে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এক বন্ধু যখন বলল সাঁওতালের তীর-ধনুক দিয়ে কি উপজাতীয় হয়ে যাবি, তখন তাকে বলেছিলাম দেখিস আমাকে টিভিতে দেখাবে। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে টিভিতে দেখানোর কৃষক বাবা আফসার আলি বলেছিলেন আমার ছেলে অনেক ওপরে উঠবে। তার কথাটিই সত্যি হলো। আমি এই উন্নতির ধারা ধরে রাখতে চাই। কোচদের প্রতি কৃতজ্ঞ যারা আমাকে এই পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছেন।’ রিকার্ভ পুরুষ একক ইভেন্টের ফাাইনালে বাংলাদেশের রোমান সানা ৭-১ সেট পয়েন্টে ভুটানের টি-শারিং কিনলেকে এবং রিকার্ভ মহিলা একক ইভেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশের ইতি খাতুন ৭-৩ সেট পয়েন্টে ভুটানের সোম দিমাকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। এছাড়া কম্পাউন্ড পুরুষ একক ইভেন্টে বাংলাদেশের অসীম কুমার দাস ১৪৫-১৩৫ স্কোরে শ্রীলঙ্কার কুমারাকে হারিয়ে তা¤্রপদক জেতেন। রোমান সানা ও ইতি খাতুনের কথায়, ‘বারবার ভারতের কথা বলে আমাদের লেভেলকে খাটো করে দেখা হয়। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই আমরা এসেছি। ভুটান, শ্রীলঙ্কাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। ভারত এলে হয়তো পদক ভাগাভাগি হতো। একচেটিয়া আমরাও দশটি পদক পেতাম না, তারাও পেত না। ডমিনেট করার দিন শেষ। আমরা এখন বিশ্বমানের। তবে পদকের কথা যদি বলেন তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা কয়টা খেলা খেলি। যত বেশি খেলা যাবে কনফিডেন্ট লেভেল তত বেশি হবে। যদিও আমরা এখন কোন দলের বিপক্ষে খেলতে ভয় পাই না। তিনটি পদক পেয়েছি এটি অবশ্যই গর্বের এবং সৌভাগ্যের। ভবিষ্যতে এটি প্রেরণা হয়ে থাকবে।’
×