ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর...

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর...

মোরসালিন মিজান ॥ অস্ত্র হাতে লড়াই। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। জীবনের জন্য মায়া নেই। ঘর বাড়ি ঠিকানা নেই। শুধুই দেশ। দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রাণপণ যুদ্ধ। একাত্তরের সে যুদ্ধে একেবারেই গ্রামের, একেবারেই তৃণমূলের অতি সাধারণ যুবকেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তারা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরে এসেছিল বিজয়। সঙ্গত কারণেই এ বিজয় অনেক বেশি আবেগের। প্রতি বছর ডিসেম্বরে বড় করে উদ্যাপন করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর সামনে রেখে শুরু হয়ে গেছে এবারের উৎসব অনুষ্ঠান। তবে আলাদা করে বলতে হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনটির কথা। আগারগাঁয়ে অবস্থিত জাদুঘরে এখন চলছে বিজয় উৎসব ২০১৯। এ উপলক্ষে ভবনের বহিরাঙ্গন সাজানো হয়েছে নতুন করে। না, খুব আড়ম্বরপূর্ণ নয়। তবে বাঙালীর যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসটি নানা ভাব ও ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, লাল-সবুজ রঙের দোলা। জাদুঘর ভবনের সামনের দেয়ালে পতাকার রং। একাত্তরের বিজয়ের মুহূর্তটি দেশী-বিদেশী আলোকচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে কবিতার ভাষায়। একটি ছবিতে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাস। নিচে সুফিয়া কামালের কবিতার পঙ্ক্তি : উদ্বেলিত সিন্ধুর সমান/গরজিয়া সাত কোটি বাংলার সন্তান...। অন্য ছবিতে যন্ত্রণার অতীত। ক্রন্দনরত কিশোর। ছবির নিচে শামসুর রাহমানের কবিতা। অন্যান্য ছবির ক্যাপশন করা হয়েছে নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইনদের কবিতা দিয়ে। এগুলো দেখতে দেখতে ভেতরে প্রবেশ করতেই ভরপুর মিলনায়তন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতি। কেউ কেউ শুধুই দর্শক। কেউ কেউ এসেছেন নাচ করতে। গান করতে। বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেই এসেছিলেন বড়রাও। প্রথম পর্বটি বড়দের জন্যই ছিল, বলা যায়। এ পর্বের শুরুতে ছিল সেমিনার। ‘বঙ্গবন্ধু ও মানবাধিকার’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ড. রহমত উল্লাহ। নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের মানবিকতার দর্শন তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি। বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট, মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা উত্তর দেশ গড়ার কঠিন লড়াই বিশ্লেষণ করে তার আলোকে শেখ মুজিবকে ব্যাখ্যা করেন। প্রাবন্ধিক বলেন, ছয় দফা না হলে ঊনসত্তর আন্দোলন হতো না। ঊনসত্তর আন্দোলন না হলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি মিলতো না। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি না মিললে সত্তরের নির্বাচনে বাঙালীর বিপুল বিজয় আসত না। বিপুল বিজয় না আসলে আসত না মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধ না হলে স্বাধীন বাংলাদেশ হতো না। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ। তাঁর লড়াইটা মোটেও সহজ ছিল না। এরপরও শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে তিনি এগিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার পর প্রথম ভাষণে মহান নেতা বলেছিলেন, শোষণ মুক্ত সোনার বাংলা গড়তে হবে। একইভাবে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীর সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।’ এই বোধ এই ভাবনা নিয়ে তিনি মানুষের পক্ষে, মানবাধিকারের পক্ষে লড়ে গেছেন। সেমিনার শেষ হতেই দলীয় নৃত্য। ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ গানের সঙ্গে চমৎকার নৃত্য পরিবেশ করে স্পন্ধন। মুহূর্তেই যেন ছড়িয়ে পড়ে বিজয়ের আনন্দ। আবেগটাও টের পাওয়া যায়। পরের পরিবেশনায় ছিল কয়েকটি গানের কম্পোজিশন। আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, তোরা সব জয়ধ্বনি কর ইত্যাদি গানের সঙ্গে নাচেন শিল্পীরা। পরে মঞ্চে আসেন ইউ ল্যাবের শিক্ষার্থীরা। তাদের পরিবেশনায়ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান। একই আহ্বান জানিয়ে যায় ইস্পাহানী গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। এভাবে দারুণ রঙিন হয়ে ওঠে উৎসবটি। অনুষ্ঠানের ফাঁকে কথা হয় অন্যতম আয়োজক জিয়া উদ্দীন তারিক আলীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত গৌরবের যে, আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। এ চেতনা শত শত বছর ধরে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। আগামী পাঁচ সাত বছরে আমরা যদি নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে পারি, কেন আসলে মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছিল তাহলে স্বপ্নের দেশ গড়া অনেক সহজ হবে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের কাছে আমাদের যেসব প্রত্যাশা ছিল, তার থেকে এখনও বেশ খানিকটা দূরে আছি আমরা। তবে প্রত্যাশা পূরণের দিকে এগুচ্ছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। সব যে তারা ভাল করছে এমন নয়। তবে দলটি সরকারে থাকলে আশা থাকে। এ আশা নিয়েই এবারের বিজয় উৎসব উদ্যাপন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বিজয় উৎসব চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
×