ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকল্প শেষ হলে বোয়িং ৭৭৭ ওঠানামায় সমস্যা থাকবে না

ওসমানী বিমানবন্দর পূর্ণ আন্তর্জাতিক করতে বিশাল কর্মযজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৯:১১, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

ওসমানী বিমানবন্দর পূর্ণ আন্তর্জাতিক করতে বিশাল কর্মযজ্ঞ

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরকে পরিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। প্রায় ৩৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এই উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন হলে ওসমানী বিমানবন্দরের চেহারা পাল্টে যাবে। বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির এই প্রকল্পের মেয়াদ এক দফা পেরিয়ে যাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ সৃষ্টি হলে তারা মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করে। বর্তমানে বিমানবন্দরের বিদ্যমান রানওয়ে ও টেক্সিওয়ে শক্তি বৃদ্ধিকরণ কাজ চলছে। জানা গেছে, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ৪৫২ কোটি ৯৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। পরে ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটি প্রকল্প সংশোধন করে ৩৮৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাল্লা গ্রুপ ‘সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিদ্যমান রানওয়ে ও টেক্সিওয়ে শক্তি বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে। পরিসংখানে দেখা যায় ২০০৪ সালে ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় আড়াই লাখ যাত্রী এবং প্রায় ১৬২ টন কার্গো পরিবহন করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা বাড়তে থাকে এ বিমানবন্দরের। ২০১৭ সালে এ বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ ২০ হাজার যাত্রী এবং প্রায় সাড়ে সাত হাজার টন কার্গো পরিবহন করা হয়। ক্রমেই গুরুত্ব বাড়ায় এ বিমানবন্দরের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয় সরকার। এছাড়া এ বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরাসরি ফ্লাইট চালুর বিষয়ে সিলেটের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি রয়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতেই নেয়া হয় চারশ’ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। জানা গেছে, বৃহৎ এই প্রকল্পের আওতায় ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারিত হবে, শক্তি বাড়বে টেক্সিওয়ের। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ওসমানী বিমানবন্দরে বোয়িং ৭৭৭ অবতরণ ও উড্ডয়নে কোন সমস্যা থাকবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তখন সিলেট থেকে যুক্তরাজ্য বা ইউরোপের অন্য কোন দেশে নিয়মিত সরাসরি ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনাও বাড়বে। তাছাড়া কাজ শেষ হলে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতোই সক্ষমতা লাভ করবে ওসমানীর রানওয়ে ও টেক্সিওয়ে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজের অগ্রগতি ছিল একেবারেই কম। পরে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর আবেদন করে। সিলেট বিভাগের প্রায় অর্ধ কোটি প্রবাসীর যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম এই বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন না হওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দু-একটি দেশ ছাড়া অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটেই সীমাবদ্ধ এ বিমানবন্দরের কার্যক্রম। প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরও বোয়িং ৭৭৭ উড়ার মতো সক্ষমতা না থাকায় এ বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্যে নিয়মিত সরাসরি ফ্লাইট চালু করা যাচ্ছে না। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করার দাবি দীর্ঘদিনের। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি একাত্মতা পোষণ করে ১৯৯৬ সালে ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সে সঙ্গে শুরু হয় রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ। ১৯৯৮ সালের ২০ ডিসেম্বর ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে উন্নীত করা হয়। প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন লন্ডন থেকে সরাসরি সিলেটে ফ্লাইট পরিচালনা করা হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০০১ সালে ওসমানীকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত করতে পর্যায়ক্রমে দুটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। উন্নয়ন কাজ শেষে ২০০৬ সালের ১২ মার্চ দুবাই থেকে আসা একটি এয়ারবাস (বিজি ০২০) অবতরণের মাধ্যমে ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ২০০৭ সালের ৯ নবেম্বর লন্ডন থেকে দুবাই হয়ে ওসমানীতে অবতরণ করে বাংলাদেশ বিমানের একটি সুপরিসর এয়ারবাস (ডিসি-১০)। ৩০১ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এয়ারবাসটি ২৭৫ জন যাত্রী নিয়ে ওসমানীতে অবতরণ ও যাত্রী নিয়ে পুনরায় উড্ডয়ন করে। এর মাধ্যমে সুপরিসর বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সব সম্ভাবনা দেখা দিলেও কেবল রিফুয়েলিং ব্যবস্থা বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিমানে জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকার কারণে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হয়নি দীর্ঘ সময়। রিফুয়েলিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে বিদেশী কোন এয়ারলাইন্সও এখান থেকে ফ্লাইট পরিচালনায় আগ্রহী হয়নি। তবে ওসমানী বিমানবন্দরকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছিল। ২০১০ সালে বর্তমান সরকার ওসমানী বিমানবন্দরে রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০১২ সালে বিমানের ‘কনস্ট্রাকশন এভিয়েশন রিফুয়েলিং ফেসিলিটিজ’ (স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উড়োজাহাজে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা) নামে সিলেটে রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনকন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রায় ৫১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় পদ্মা অয়েল কোম্পানি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১৫ সালে কাজ শেষ হলে একই বছর ২৪ মার্চ থেকে শুরু হয় পরীক্ষামূলক রিফুয়েলিং সিস্টেম। আশান্বিত হন সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীরা। ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট চালু করতে আগ্রহী হয় বিদেশী বিমানসংস্থা ১ এপ্রিল ২০১৫ বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেসরকারী একটি বিমান অবতরণ করে ওসমানী বিমানবন্দরে। অবসান হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষার। কিন্তু ৬টা ৪০ মিনিটে যাত্রী নিয়ে দুবাই ফিরে য়াওয়ার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সেটি আর যাত্রী নিয়ে ফিরে যে পারেনি। এর পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিদেশী ফ্লাইট ওঠানামা। সিলেট ওভারসিজ সেন্টার সূত্র জানায়, সিলেট অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক লোক জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রবাসে রয়েছেন। যুক্তরাজ্য প্রবাসী ৫ লাখ বাংলাদেশীর ৯৫ ভাগই সিলেটের। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ৬ লাখ বাংলাদেশীর অর্ধেকই এ অঞ্চলের। দেড় লাখ ইতালি প্রবাসী ও দেড় লাখ কানাডা প্রবাসীর অর্ধেকেরও বেশির মূল ঠিকানা সিলেট। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের উল্লেখযোগ্য অংশ সিলেটের বাসিন্দা। সারা বছর তারা দেশে আসা যাওয়া করেন। বর্তমান সরকার প্রবাসীদের সুবিধা বিবেচনায় ওসমানী বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক মানোন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় প্রবাসী মহলে আশার সঞ্চার হয়েছে।
×