ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অতনু রায়

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ॥ বাংলাদেশের রেবেকা শবনম

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ॥ বাংলাদেশের রেবেকা শবনম

স্পেনের মাদ্রিদে গত ২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। দুই সপ্তাহব্যাপী এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন বিশ্বের ২০০টি দেশের প্রতিনিধিরা। যেখানে বিশ্ব নেতারা আলোচনা করছেন মানব জাতির সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কট নিয়ে। বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায় বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারসহ উন্নয়নের বর্তমান পরিবেশ বৈরী ধারাপ্রবণতা বজায় রাখলে ভয়ঙ্কর জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ঝুঁঁকির কারণে অনেকেই ছেড়ে আসছেন নিজ এলাকা, ফলে জলবায়ুর কারণে উদ্বাস্তুও সংখ্যা বেড়েই চলছে। এতে শহরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাচারকারীরা শিশু ও নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। চলতি বছর জুলাইয়ের জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের ঘর ছেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এদিকে, বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ যিনি কিনা পৃথিবীর সুরক্ষার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বনেতাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তিনিও ছিলেন এই সম্মেলনে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্ব নেতাদের পদক্ষেপ নেয়ার দাবিতে ২০১৮ সালে প্রতি শুক্রবার সুইডিশ পার্লামেন্টের বাইরে অবস্থান নেয়া শুরু করেন স্কুলছাত্রী গ্রেটা থানবার্গ। তার এই অবস্থানের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে বেগবান হয় জলবায়ু আন্দোলন। তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে দুনিয়াজুড়ে এই আন্দোলনে শামিল হন লাখ লাখ মানুষ। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ আয়োজিত এক সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিশ্ব নেতারা যথাযথ ভূমিকা রাখছেন না অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগও তোলেন এই জলবায়ু কর্মী। এরই ধারাবাহিকতায় তখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় জলবায়ু পরিবর্তনরোধে সোচ্চার সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থানবার্গের ডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে একত্রিত হয়েছিল ২ লাখেরও বেশি মানুষ। আর এই লাখো প্রতিবাদীদের সামনের সারিতে ছিলেন বাংলাদেশী কিশোরী রেবেকা শবনম। আমাদের আজকের গল্প তাকে নিয়েই। সেপ্টেম্বরের জলবায়ু পরিবর্তন রোধের আন্দোলনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন ১৬ বছর বয়সী এই রেবেকা শবনম; যাকে বলা হচ্ছে পৃথিবী রক্ষার আন্দোলনের নতুন মুখ। সেই আন্দোলনে শবনম সবাইকে বোঝাতে চেয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ কতটা ঝুঁঁকির মধ্যে রয়েছে। নিউইয়র্কে হাজার হাজার মানুষের সামনে তিনি বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতির শিকার দেশগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত।’ বক্তৃতায় জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে কেমন করে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাও তুলে ধরেছিলেন রেবেকা। এদিকে এনিয়ে ১৬ বছর বয়সী কিশোরী রেবেকাকে নিয়ে রীতিমতো সাক্ষাতকারসহ এক বিশেষ প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা। নিউইয়র্কের একটি হাই স্কুলের শিক্ষার্থী রেবেকা আলজাজিরাকে বলেছেন, আমি শুধু ভাবতাম এই বিশাল সমাবেশে কিভাবে বাংলাদেশের নাম তুলে ধরব। যেটিকে শুধু ক্রিকেটের জন্যই মানুষ চেনে। তবে আমার বক্তৃতার সময় সবাই চিৎকার ও করতালি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। শবনম বলেন, ‘ভেবেছিলাম যখন বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে তখন সবাই চুপ থাকবেন। তবে সবার সাড়া দেখে আমি নিজেই অবাক। এটা শুধু পরিবেশগত সঙ্কট না। এটা মানবাধিকার সঙ্কটও। বাংলাদেশের নারীরা পাচারের শিকার হন আর এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও বেড়েছে। আমরা বাংলাদেশে থাকা নারী ও রোহিঙ্গাদের জানাতে চাই, তাদের জীবনের জন্য বিশ্বজুড়ে আন্দোলন করছি আমরা।’ সাক্ষাতকারে, গত বছরের চেয়ে এবারের জলবায়ু সম্মেলনে আরও জরুরী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে আশা করেন শবনমের। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এই সম্মেলনে যেন শুধু প্রাপ্ত তথ্যের ওপর নোট নেয়া না হয়। বরং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে যেন পদক্ষেপ নেয়া হয়।’ তার স্বপ্ন, শুধু পুনর্ব্যবহার যোগ্য সম্পদ ব্যবহারে পরিবর্তিত না হয়ে এমন পদক্ষেপ নেয়া হোক, যেন এর ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোর জীবন ধারা পরিবর্তিত হয়। এর আগেও শবনম এক ভাষণে তুলে ধরেছিলেন কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু তৈরি হয় আর বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউনিসেফ বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাপক শাকিল ফয়জুল্লাহ আল-জাজিরার সেই প্রতিবেদনে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি আসলে নীরব ঘাতক। প্রতিদিনই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না।’ ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘এই শিশুরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হওয়ায় তাদের শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যখনই কোন বন্যা হয়, তখন স্বাস্থ্যসেবা বিঘিœত হয়। বিশেষ করে টিউবওয়েল ভেঙ্গে যায়, স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। একজন শিশু যদি স্বাস্থ্যসেবা না পায়, শিক্ষা না পায়, এমনকি খাবার পানি না পায়, তাকে আপনি আর কী দেবেন?’ একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী রেবেকা পরিবারের সঙ্গে নিউইয়র্কে বসবাস করেন। ছয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যান তিনি। তিনি মনে করেন, সামনে হাঁটতে হবে আরও অনেক পথ। ভয়াবহ ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের নারী, শিশু ও রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বেও দরবারে কীভাবে সুবিচার প্রত্যাশা করা যায়, সেটাই এখনকার চিন্তার মূল বিষয়। আল-জাজিরাকে শবনম জানিয়েছেন, জলবায়ু আন্দোলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ কেউ যেন ভুলে না যান, তা নিশ্চিত করতে লড়াই চালিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখবেন তিনি। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমাদের এই রেবেকা শবনম আল-জাজিরাকে এও জানান যে জলবায়ু আন্দোলনের জন্য তিনিও গ্রেটার মতো করেই লড়াইয়ের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বিশ্ববাসী ও আগামীর প্রজন্মকে উপহার দিতে চান নতুন এক স্বপ্নীল পৃথিবী।
×