ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেমিক সৈকতকে জিজ্ঞাসাবাদ

রুম্পার মৃত্যুরহস্যের জট ৩ দিনেও খোলেনি

প্রকাশিত: ১১:০৭, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

রুম্পার মৃত্যুরহস্যের জট ৩ দিনেও খোলেনি

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর সড়কে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার (২১) মৃত্যুরহস্যের জট এখনও খোলেনি। পুলিশ এখনও কূলকিনারা করতে পারেনি। ঘটনার পর একাধিক টিম মাঠে নামলেও তিনদিনেও রহস্য উদঘাটন হয়নি। রুম্পার মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দুই একদিনের মধ্যেই পেশ করা হবে। এদিকে রুম্পার কথিত প্রেমিক সৈকতকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শনিবার রাতে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি দক্ষিণ বিভাগ) উপ-কমিশনার (ডিসি) রাজিব আল মাসুদ বিষয়টি নিশ্চিত করে জনকন্ঠকে জানান, তাকে আটক করা হয়নি। রুম্পার মৃত্যুর ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। এদিকে রুম্পা হত্যার প্রতিবাদ বিক্ষোভে দ্বিতীয় দিনের মতো সকাল থেকে সিদ্ধেশ্বরী ও ধানম-ির স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে ওঠে। শিক্ষক শিক্ষার্থীরা এ সময় বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে। তাদের ধারণা রুম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, রুম্পার মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের জন্য অকুস্থল সিদ্ধেশ্বরীর ৬৪/৪ নম্বর ভবন ও এর আশপাশের তিনটি ভবন ও মূল সড়কের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ এক বখাটেসহ কয়েক যুবককে খুঁজছে। যারা এলাকায় রুম্পাদের শান্তিবাগের বাসার সামনে অবাধে যাতায়াত করত, আড্ডা দিত। ঘটনার দিন রুম্পা ক্যাম্পাসে আড্ডা দিয়ে ফিরে টিউশনির কথা বলে বের হয়ে যায়। এর ঘণ্টাখানেক পরে ক্যাম্পাস থেকে প্রায় আধা কিমি দূরে সার্কুলার রোডে আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনের গলির মুখ থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ এসব বিবেচনায় নিয়ে তদন্তে নেমেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অকুস্থলের ডান দিকে একটি চারতলা ভবন। বাঁয়ে আরেকটি পাঁচতলা। দুই ভবনের পেছনে ১১ তলা ভবনটি আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ১১ তলা ভবনের ছাদ থেকেই রুম্পাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। নয়তো সে নিজেই লাফ দিয়েছে। এলাকার কয়েক বাসিন্দা জানান, চারতলা ও পাঁচতলা ভবনের ছাদ টিনশেডের। ওই ছাদে উঠতে গেলেও কেউ না কেউ টের পেত। অন্যদিকে ১১ তলা শপিং কমপ্লেক্স ভবনে উঠতে কারও বাধা নেই। ভবনটির চার তলায় বিভিন্ন কোম্পানির কর্পোরেট অফিস। পাঁচতলায় মালিক পক্ষ থাকে, ষষ্ঠতলা থেকে ১১ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন। লিফট দিয়ে উঠলে ১০ তলা পর্যন্ত উঠে সিঁড়ি বেয়ে ১১ তলার ছাদে যেতে হয়। ভবনটির ছাদে কবুতর পোষা হয়। পাশের চারতলা ভবনের নিচতলা ও চতুর্থতলায় ব্যাচেলরদের মেস। পাঁচতলা ভবনের চতুর্থতলায়ও একটি মেয়েদের মেস। নিচতলায়ও রয়েছে মেস। রুম্পার লাশ পড়ে থাকা রাস্তা সংলগ্ন ৬৪/৪ ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটে মেস রয়েছে। সেখানে সাত ব্যাচেলর ভাড়া থাকে। ঘটনার দিন রাতে ওই মেসে ছিল সাতজন। মেসের বাসিন্দা পলাশ দেবনাথ জানান, বুধবার আনুমানিক রাত দশটা ৪২ থেকে ৪৩ মিনিটে ওপর থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ হয়। বস্তা পড়েছে ভেবে আমরা রুম থেকে বেরিয়ে দেখি একটি মেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চিৎকারে আশপাশের অনেকেই ছুটে আসে। মেয়েটিকে উপুড় হওয়া থেকে সোজা করা হয়। এর মধ্যেই স্থানীয় এক চিকিৎসক বাসিন্দা ছুটে আসেন। তিনি পরীক্ষা করে প্রথমেই বলেন ‘মারা গেছে’। তখন পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম জানান, রুম্পাকে হত্যা করা হয়েছে কি না- সে সম্ভাবনা মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। কিন্তু তার স্যান্ডেল, মোবাইল ফোন, কানের দুল, আংটি বাসায় ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, রুম্পা সেদিন কেন তার ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র বাসায় রেখে বের হলেন। কেন অন্য একটি ভবনে গিয়ে লাফ দিলেন তা ভাবনায় ফেলেছে পুলিশকে। মোবাইল ফোনটাও সঙ্গে রাখেনি রুম্পা। বিষয়টি রহস্যজনক। ওই ভবনে কী এর আগেও গিয়েছিল রুম্পা তাও জানা যাচ্ছে না। রুম্পা কেন ওই ভবন বেছে নিয়েছে, তিনি কি আত্মহত্যার জন্য ওই ছাদে গেছে, নাকি তাকে কেউ সেখান থেকে ফেলে হত্যা করেছে। সবকিছু ভাবনায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। আশা করছি, খুব শীঘ্রই একটা কিছু বের হবে। রুম্পার মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে এক বখাটেকে খোঁজা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ১১ তলা ভবনের ছাদে কিনার (কবুতরের খাঁচার পেছনে ও মরদেহ পাওয়ার স্থানের ঠিক ওপরে) থেকে দুটি পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। ধুলো জমে থাকলেও ওখানে কেউ না যাওয়ায় একজনের পায়ের দাগ স্পষ্ট। ধারণা করা হচ্ছে, পায়ের ছাপ দুটি রুম্পার। নির্জন ওই ছাদে রুম্পা কেন গেল। তা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। বিক্ষোভে উত্তাল স্টামফোর্ড ক্যাম্পাস স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজী বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রুম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শনিবার ইউনিভার্সিটির ধানম-ি ও সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে আয়োজিত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, রুম্পা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এ ঘটনার তিনদিন পেরিয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের রহস্যের কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ছাইফুল ইসলাম মাছুম বলেন, শুরু থেকেই এই হত্যাকাণ্ড অন্যদিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফেনীর নুসরাত হত্যার ঘটনাও ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হয়েছিল। অন্য কোনো ইস্যুতে যেন রুম্পা হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। মানববন্ধন শেষে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ধানম-ি ১৯ থেকে ১৫ নম্বর রোড পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় ইউনিভার্সিটিটির সাতটি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কর্মসূচীতে অংশ নেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ শেষে তারা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা বক্তব্য দেন। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আরিফুর রহমান জানান, রুম্পা আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে নয়। তাকে যতটুকু জানি, সে সংস্কৃতিমনা, সারাক্ষণ সবার সঙ্গে কথা বলে মাতিয়ে রাখত। তার মৃত্যুরহস্য বের করা দরকার। অধ্যাপক আরিফুর রহমানের মতো শিক্ষার্থীদেরও একই দাবি, রুম্পা আত্মহত্যা করতে পারে না।
×