ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্ক ও একজন নিবেদিতপ্রাণ গেইল

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

স্ক ও একজন নিবেদিতপ্রাণ গেইল

আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী, তুমি থাক সিন্ধু পারে ওগো বিদেশিনী কানাডিয়ান নাগরিক গেইল ম্যারিয়ান হিলস গত কিছুদিন আগে কানাডাভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্লিপিং চিলড্রেন এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (স্ক) এর প্রতিনিধি হয়ে ঢাকা এসেছেন। এ নিয়ে পরপর তিন বছর তিনি ঢাকা আসলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছেন স্ক এর আরেকজন সদস্য তাঁর স্বামী ক্রিস হিলস। স্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মারি ড্রাইডেন এবং মার্গারেট ড্রাইডেনের হাত ধরে ১৯৭০ সালে । সে সময় থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর হতদরিদ্র শিশুদের মাঝে বেডকিট বিতরণ করে আসছে। এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মারি ড্রাইডেন ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সফর করেন। এ সময় তিনি একটি রেলওয়ে স্টেশনে একটি দরিদ্র শিশুকে প্লাটফর্মের খালি মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখেন। তখন কোমল হৃদয়ের মানুষ মারির মনে হলো তিনি যা দেখলেন তা ভুলে যেতে পারেন অথবা এই নিঃসহায় গরিব শিশুদের ভালভাবে ঘুমানোর ব্যবস্থা করার কথা চিন্তা করতে পারেন। সেই মহৎ ভাবনা থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। ভারতের পুনেতে ১৯৭০ সালে অসহায় শিশুদের মাঝে পঞ্চাশটি বেডকিট বিতরণের মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেন । এখন এই সংস্থা প্রতিটি শিশুর জন্য দাতাদের কাছ থেকে ৩৫ মার্কিন ডলার গ্রহণ করে। এ দিয়ে প্রতিটি শিশুকে তোষক, বালিশ, বিছানার চাদর, কম্বল, মশারি, জামা-কাপড় (তিন সেট), রেইনকোট, তোয়ালে, খাতা-কলম, স্কুলব্যাগ ও একজোড়া চপ্পল দেয়া হয়ে থাকে। যে দেশে বেডকিট বিতরণ করা হয়, সে দেশ থেকে বেডকিটের জিনিসপত্র সংগ্রহ করা হয় যাতে পরিবহন খরচ কমে যায় এবং এতে ওই এলাকার হতদরিদ্র শিশুরা উপকৃত হয়। এই সাহায্যের জন্য স্ক কোথাও কোন বিজ্ঞাপন দেয় না এবং তারা সরকারী কোন সাহায্য গ্রহণ করে না। মূলত কানাডার সম্পদশালী লোকজন ও অন্য দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকজনের সাহায্য সহযোগিতায় তাদের ফান্ড গঠিত হয়ে আসছে। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সাহায্য সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তারা সারা বিশ্বে ১৬ লাখ শিশুদের মাঝে বেডকিট বিতরণ করেছে । বাংলাদেশে রোটারি ক্লাব অফ ঢাকার সঙ্গে যৌথভাবে তারা এই বেডকিট বিতরণের কাজটি করে থাকে। ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশে এই কার্যক্রম শুরু হয়। রোটারি ক্লাব অফ ঢাকার ‘স্লিপিং কিটস ডিস্ট্রিবিউশন ‘ নামে একটি টিম বছরের একটি বিরাট অংশ জুড়ে ব্যবস্থাপনার কাজটি করে থাকে। এ ক্লাবের রোটারিয়ানদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গত ৩৫ বছর ধরে এই প্রজেক্টটি সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং এই যৌথ প্রজেক্টটি রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮১-এর সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট । গত ৪৯ বছরে বিশ্বের ৩০টি উন্নয়নশীল দেশের গরিব শিশুরা বেডকিট পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের লোকজনের কাছ থেকে এই কাজে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন যা এই কাজকে সংগঠিত করা ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন। রোটারি ক্লাব অফ ঢাকার সহযোগিতায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ১ লাখ ৮০ হাজার বেডকিট বিতরণ করা হয়েছে এবং ২০১৯ সালে করা হয়েছে সর্বাধিক। রোটারি ক্লাব অফ ঢাকার স্লিপিং কিটস ডিস্ট্রিবিউশন টিমের সদস্যদের এই প্রজেক্টটির জন্য বেশ কয়েক মাস ধরে বেশ খাটাখাটুনি করতে হয়। রোটারি এন, রোটারি লেট, রোটারেক্ট ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবীরা এই বিতরণে যেভাবে কাজ করেছে তাতে তিনি ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এই আত্মনিবিদিতপ্রাণ মানুষদের পক্ষে যে কোন বড় ও কঠিন কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ২০১৭ সালে তিনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের (বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চল) দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে বেডকিট বিতরণে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে তিনি বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও টাঙ্গাইলে এবং এ বছর ২০১৯ সালে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের হতদরিদ্র শিশুদের মাঝে বেডকিট বিতরণ কার্যক্রমে রোটারি ক্লাব অফ ঢাকার সঙ্গে ছিলেন। জানতে চেয়েছিলাম, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কখনও রোদে পুড়ে, কখনও বৃষ্টিতে ভিজে এই কাজ করতে কষ্ট হয় না? গেইল উত্তরে বললেন, কষ্ট হয়ত কিছুটা হয় কিন্তু যখন শিশুদের মুখে প্রাপ্তির আনন্দ আর খুশি দেখি, যখন দেখি শিশুরা বেডকিটের ভারি জিনিসপত্র বহন করছে আর মন খুলে হাসছে, তখন মনে হয় যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এসব শিশুদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাব। কানাডা সরকার গত কয়েক বছর ধরে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণের ব্যাপারে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কিন্তু গেইল ও ক্রিস দম্পতি ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ ভ্রমণ করছেন। শুধুমাত্র মানবতাবোধের খাতিরে তাঁরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের দরিদ্র শিশুদের কাছে গত তিন বছর ধরে আসছেন। এ মহানুভবতার কোন তুলনা হয় না। জগতের হাতেগোনা কিছু মহৎপ্রাণ ব্যক্তি যাঁরা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণ উজার করে দিতে পারেন তাদের পক্ষেই শুধু এ ধরনের কষ্টসাধ্য কাজ করা সম্ভব। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, গত পঁচিশ বছর ধরে তিনি স্ক সঙ্গে জড়িত আছেন। তিনি অন্যান্য দেশেও এই কাজে গিয়েছেন তবে বাংলাদেশে এসেছেন বেশি । তিনি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ও উদ্যোগে কিছু স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে নিয়ে কয়েক বছর আগে গুয়াতেমালায় গিয়েছিলেন গৃহহীনদের মাঝে ঘর তৈরি করার সাজসরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে। আশ্রয়হীন ও অসহায় মানুষের ডাক তিনি সবসময়ই শুনতে পান, তাঁর মন বিচলিত হয়ে উঠে। তিনি ছুটেন তাদের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। এটাই তাঁর বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। মনে হয় এসব দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য কাজ করার মধ্যে রয়েছে জীবনের সার্থকতা। মূলত এই ভাবনা ও অনুভব থেকে গেইল স্ক-এর মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যারা সহায় সম্বলহীন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য কাজ করে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই সংস্থাটি মনে করে, একটি শিশুর ভাল ঘুম হলে তার স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, তার সৃজনশীলতা বাড়বে এবং পড়াশোনায় সে অধিক মনোযোগী হবে। গেইল বলেন, যখন দেখি শিশুরা বেডকিটের অপেক্ষায় দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং বেডকিট পাবার পর তাদের উল্লাস ও চোখেমুখে আনন্দের হাসি তখন ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। এ কথার বলার সময় গেইলের চোখ ছলছল করছিল। স্ক মেয়েশিশু এবং ছেলেশিশুদের সমান আনুপাতিক হারে বেডকিট প্রদান করে থাকে। গেইলের কাছে প্রশ্ন ছিল সারাবিশ্বের শিশু শরণার্থীদের নিয়ে তিনি কী ভাবছেন। তিনি বললেন, তাদের কষ্টের কথা ভাবলে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও তাদের শিশুরা যেভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং হচ্ছে তাতে প্রতিটি বিবেকবান মানুষ নড়েচড়ে বসার কথা। এ সমস্যা সৃষ্টির পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে তা চিহ্নিত করা ভীষণ জরুরী। উন্নত দেশগুলো ইচ্ছে করলে এ সমস্যা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে কিন্তু এজন্য দরকার উদার মনোভাব, স্বার্থ বিসর্জন দেয়া ও সদিচ্ছা। ইয়েমেনের শিশুরা, সিরিয়ার শিশুরা প্রতিদিন মারা যাচ্ছে, সভ্য পৃথিবীতে এত কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। বাস্তুচ্যুত এসব শিশুরা যে দুঃখকষ্ট ও মনোবেদনার মাঝে শরণার্থী শিবিরে বড় হচ্ছে তাতে তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ যেভাবে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য সহযোগিতা করছে তা বর্তমান বিশ্বে বিরল একটি দৃষ্টান্ত। তাঁর দেশ কানাডার লোকজন বিশ্বব্যাপী এসব অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সমাবেশ করে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে গেইল বলেন, তিনি আজীবন অসহায় শিশুদের জন্য কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি তাঁর আশপাশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকজনের কাছ থেকে হতদরিদ্র শিশুদের জন্য আরও অনেক আর্থিক সহায়তা পাবেন বলে বিশ্বাস করেন। এতে স্ক-এর ফান্ড আরও সমৃদ্ধ হবে এবং বিপুল সংখ্যক গরিব শিশুদের তাদের এই কার্যক্রমে যুক্ত করতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
×