ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম রোকেয়া ॥ সমাজ নির্মাণে নারী জাতির দিশারী

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

বেগম রোকেয়া ॥ সমাজ নির্মাণে নারী জাতির দিশারী

নাজনীন বেগম ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে জন্ম নেয়া বেগম রোকেয়া গতানুগতিক সমাজ সংস্কারের মূল শেকড়ে যে মাত্রায় আঘাত করেছিলেন তা সমকালে শুধু অসম্ভবই ছিল না তার চেয়ে বেশি দুঃসাহসিক মানস চেতনায় পারিপার্শ্বিক রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করারও এক অনমনীয় দীপ্তি। ঊনবিংশ শতাব্দীর সুবর্ণ সময় হলেও তখন অবধি সব ধরনের সামাজিক আবর্জনাকে সাফ করা একেবারে দুরূহ ব্যাপার ছিল। ইউরোপীয় সভ্যতায় অবিভক্ত বাংলায় নবজাগৃতির যে আলোকিত জগত উন্মোচিত হয় তা ছিল শুধু অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বৃহত্তর গোষ্ঠী সেই নতুন সময়ের আধুনিক যুগ থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল। পশ্চাৎপদ সমাজের সিংহ ভাগ শ্রেণীই গতানুগতিক সমাজ সংস্কারের আবদ্ধ শৃঙ্খলে এমনভাবে আটকা ছিল সেই রুদ্ধদ্বার খুলতে সাধারণ মানুষকে আরও অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সমাজের এক বিরাট অংশ ছিল অসহায়, নির্বিত্ত, সংস্কারের অভিশাপে জর্জরিত। সেখানে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া নারী জাতির অবস্থান যে কোথায় ছিল তা সমকালের ইতিহাস, তথ্য-উপাত্ত, নথিপত্রে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করার যুগসন্ধিক্ষণে জ্ঞান-বিজ্ঞানে নতুন সময়কে অবারিত করলেও অনেক অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগের শিকড়ও তার যাত্রা পথ শুরু করে দেয়। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অবিভক্ত ভারতে মানুষে মানুষে সহজ মেলামেশা ছিল না সেটা যেমন ঠিক পাশাপাশি অপ্রত্যাশিত কোন সাংঘর্ষিক দুর্ঘটনাও সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। সম্প্রীতির এই দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ অঞ্চল ঘটিত ব্রিটিশ রাজশক্তি যে, বিভাজনের ভিত্তি গাড়ে তার সমূহ সঙ্কটে আবর্তিত হয় হিন্দু-মুসলমান দুই বৃহৎ সম্প্রদায়। সুতরাং বিভক্তির কূটকৌশলে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রথম ধারক বাহক হয় অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়। ইতিহাসবিদরা বলেন, মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা দখল করার কারণে ব্রিটিশরা যেমন তাদের কখনও ভাল চোখে দেখেনি একইভাবে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী ও বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ থেকে অপেক্ষাকৃত দূরেও থাকে। ফলে ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতে মুসলমানরা নতুন শিক্ষা গ্রহণে অনেকটাই পিছিয়ে থাকে। আর মুসলিম নারীদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয় সঙ্কটাপন্ন। তৎকালীন সামাজিক বলয়ের যথাযথ চিত্র অনুধাবন করতে না পারলে মহীয়সী বেগম রোকেয়ার দুঃসাহসিক পথযাত্রাকে মূল্যায়ন করা সহজ হবে না। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া এই কৃতী ব্যক্তিত্ব অতি বাল্যকাল থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন নারী জাতির অপমান, অসম্মান, ছোট পরিবারের সীমাবদ্ধ আলয়ে অবরুদ্ধ থাকা থেকে শুরু করে তাদের মূঢ়তা, মূর্খতা এবং অসহায়ত্বকে গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে অনুধাবন করার কষ্টকর আর বিদগ্ধ অভিজ্ঞতা। তখনকার দিনে উর্দুই ছিল অভিজাত মুসলিম পরিবারের মুখের ভাষা। তেমনই এক দুর্ভেদ্য অন্ধকারময় জগতের সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ম দ্রষ্টার ভূমিকায় কত যে অপরিণামদর্শী ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন সেটাও লেখনী সত্তা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ হতে সময় লাগেনি। নিজেকে নারী নয় মানুষ ভাবার অনমনীয় বোধ ছিল আশৈশব। সেই তাড়নায় নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার এক সচেতন অভিব্যক্তি। বেগম রোকেয়ার নিজের স্মৃতিতেই আছে কিভাবে বড় ভাই ও বোনের জ্ঞান চর্চা দেখে তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মে। বাংলা ভাষার প্রতি বড় বোন করিমুন্নেসার আগ্রহ আর উৎসাহে ছোট রোকেয়ার যে মনোনিবেশ তেমন স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাও তার স্মরণ চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। মেয়েদের দৌর্বল্য, অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া, অবরোধের আড়ালে আটকে পড়া কোনটাই মানতে পারতেন না সেই ছোট্ট বেলা থেকে। সেখান থেকে উত্তরণের পথও খুঁজেছেন নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ। তাই যেদিন তাঁর আত্মশক্তিতে লেখনী প্রতিভা জেগে ওঠে সেদিন সবার আগে সামনে এসে দাঁড়ায় এদেশের নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত, স্বাধীনতাহীন নারী জাতি। যারা শুধুমাত্র নিজেকে আড়াল-আবডাল করতেই সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে। এ ছাড়াও পারিবারিকভাবে তাদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখার যে অপকৌশল তাও তাকে সব সময় পীড়িত আর তাড়িত করত। পর্দার আড়ালে মেয়েদের অবরুদ্ধ করে রাখার কত মর্মান্তিক ঘটনা তার মনন চেতনাকে আঘাত করেছে তার সাক্ষ্য নিজের অভিজ্ঞতা সংবলিত করুণ কাহিনীর বর্ণনা। ‘অবরোধ বাসিনী’ থেকে তেমনই একটি দুঃসহ ঘটনা উদ্ধৃত করা গেলÑ ‘ঢাকা জিলায় কোন জমিদারের প্রকা- পাকা বাড়িতে দিনে-দুপুরে আগুন লাগিয়েছিল। জিনিসপত্র পুড়িয়া ছারখার হইলÑ তবু চেষ্টা করিয়া যথাসম্ভব আসবাব সরঞ্জাম বাহির করার সঙ্গে বাড়ির বিবিদেরও বাহির করা প্রয়োজন বোধ করা গেল। হঠাৎ তখন পাল্কি, বিশেষত পাড়া গাঁয়ে এক সঙ্গে দুই চারিটা পাল্কি কোথায় পাওয়া যাইবে? অবশেষে স্থির হইল যে, একটা বড় রঙিন মশারির ভিতর বিবিরা থাকিবেন, তাহার চারিকোণ বাহির হইতে চারিজনে ধরিয়া লইয়া যাইবে। তাহাই হইলÑ আগুনের তাড়নায় মশারি ধরিয়া চারিজন লোক দৌড়াইতে থাকিল, ভিতরে বিবিরা সমভাবে দৌড়াতেই না পারিয়া হোঁচট খাইয়া পড়িয়া দাঁত, নাক ভাঙিলেন, কাপড় ছিঁড়িলেন। শেষে ধানক্ষেত দিয়া, কাঁটাবন দিয়া দৌড়াইতে, দৌড়াইতে মশারিও ছিঁড়িয়া খ- খ- হইয়া গেল। অগত্যা আর কি করা যায়? বিবিগণ একটা ধানের ক্ষেতে বসিয়া থাকিলেন। সন্ধ্যায় আগুন নিবিয়া গেলে পরে পাল্কি করিয়া একে একে তাঁহাদের বাড়ি লইয়া যাওয়া হইল।’ এমন অনেক অসহনীয়, বিপন্ন অবস্থায় পড়া অবরুদ্ধ নারীদের বাস্তব চিত্র রোকেয়া তাঁর ক্ষুরধার লেখনীকে নিয়তই শাণিত করতেন। নারীদের তেমন অসূর্যাস্পর্শার পরিবেশে রোকেয়া কেমন দুর্দমনীয় অভিগমনে নিজের রচনাকে শুধু সমৃদ্ধই করেননি পাশাপাশি এমন দুর্বিপাক থেকে বের হওয়ার পরামর্শও দিয়ে যান আজীবন। বাল্য বিয়ে আজও সামাজিক অভিশাপ। সে যুগে যে কত কঠোর আর ভয়াবহ ছিল যা কল্পনায়ও আসে না। তেমন কট্টর সামাজিক দুর্গম পরিবেশ তিনি বলতে কুণ্ঠিত হননিÑ যে অর্থ দিয়ে একটি অবোধ বালিকাকে পরের বাড়িতে সংসার করতে পাঠানো হয় তার থেকে অর্ধেক টাকায় পরিবার মেয়েটিকে শিক্ষার আলো দিতে পারত। এই দ্যুতিই কোন বালিকার জীবনের মোড় ঘোরানোর নিয়ামক শক্তি হতে পারত যা তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও দিতে পারে। অর্ধাংশ নারী জাতির যথার্থ অংশগ্রহণ ছাড়া কোন সমাজ সুষ্ঠু আর স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যাবে না। সমাজের একটা চাকা যদি পেছনে পড়ে থাকে তাহলে অন্য চাকাটি পদে পদে হোঁচট খাবেই। তার সমানভাবে চলার গতি কখনও দৃশ্যমান হবে না। তেমন বৈষম্যপীড়িত সামাজিক বলয়ে পুরুষ শাসিত প্রতিবেশীর রক্তচক্ষুকে পাশ কাটিয়ে যেমনভাবে নারী জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে বিস্ময়েরও তৈরি করে। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় শুধু নারী নয় অসহায়, হতদরিদ্র সাধারণ কৃষকদের প্রতিও বেগম রোকেয়ার তীক্ষœ নজরদারি তাঁর ‘চাষার দুঃখ’ প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ আছে। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরুর প্রবাদ বাক্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারতেন না। অবিভক্ত ভারতের বহু প্রত্যন্ত অঞ্চল নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতায় এমন দৃশ্য কোথাও দেখেননি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। সব সময় হতদরিদ্র কৃষকরা প্রতিদিনের যাপিত জীবন সমস্যা আর হরেক রকম বিপত্তিতে অতিবাহিত করত বলে এই মহীয়সী নারী দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। শুধু স্মরণ করলেই তার প্রতি যথাযর্থ শ্রদ্ধা নিবেদন হয় না। তাঁর আদর্শিক চেতনা এবং প্রতিদিনের যাপিত জীবনের নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করাই তার প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন।
×