ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবু আফজাল সালেহ

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ

‘পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’ (তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা) শামসুর রাহমানের কবিতাংশ। কবি শামসুর রাহমানের সাহসী ও দৃপ্ত উচ্চারণ এটি। আমাদের মুক্তি আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনি হয়েছে এখানে। অনেক কবির কবিতাই মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। অনেক কবিতায় নয় মাসের যুদ্ধকালীন করুণ কাহিনী উঠে এসেছে। আবার অনেক কবিতায় মুক্তিকামী মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কথা উঠে এসেছে কবির কণ্ঠে। অনেক কবির কণ্ঠস্বর হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠস্বর; মুক্তিকামীদের কণ্ঠস্বর। আর একটি বিষয় সে সময়ের কবিতায় প্রবলভাবে। সেটি হচ্ছে- অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। এ অসম্প্রদায়িক মনোভাবই শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে। রণাঙ্গনের যুদ্ধকালীনের আগে থেকেই বর্বর পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছিল। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই বাঙলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়ে। ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা-ঊনসত্তরের নির্বাচন-মুজিবের ভাষণ ইত্যাদির সিঁড়ি বেয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ। তাই বলা চলে, বাঙালি সমাজকে মুক্ত করার জন্যই অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা দিয়েছে এসব কবিতা বা সাহিত্যকর্ম। আমি কেবল কবিতা সাহিত্য নিয়েই আজ আলোচনা করব। কিন্তু তা হবে চম্বুক অংশ মাত্র। জসিমউদ্দীনের ‘দগ্ধগ্রাম’, সুফিয়া কামালের ‘আজকের বাংলাদেশ’, আহসান হাবীবের ‘মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে কেমন’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’, শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘যখন উদ্যত সঙ্গীন’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘গেরিলা’, শহীদ কাদরীর ‘নিষিদ্ধ জার্নাল’, রফিক আজাদের ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ’, নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলো শোকের’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘আমরা তামাটে জাতি’, সানাউল হক খানের ‘সাতই মার্চ একাত্তর’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘শহীদ স্মরণে’, অসীম সাহার ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত’, হুমাযুন কবিরের ‘বাংলার কারবালা’, আসাদ চৌধুরীর ‘রিপোর্ট ১৯৭১’, হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্প্রাদকীয়’, মহাদেব সাহার ‘ফারুকের মখু’, আবিদ আজাদের ‘এখন যে কবিতাটি লিখব আমি’, দাউদ হায়দারের ‘বাংলাদেশ’, আবিদ আনোয়ারের ‘আমার মায়ের নামে তোপধ্বনি চাই’, মিনার মনসুরের ‘কী জবাব দেব’ প্রভৃতি সহজেই স্মরণে আসে। এসব কবিতায় পাই বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা, মানবিক আবেগ, স্বদেশপ্রেম, সাম্যচেতনা, ক্ষোভ ও মুক্তির তীব্র বাসনা। উল্লেখিত কবিরা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে একাধিক কবিতা লিখেছেন। এ তালিকার বাইরেও রয়েছে অনেক ভাল কবিতা আছে। বিশ্বসাহিত্যে অনেক দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সেদেশের কবি-সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করেছেন। আমাদের বংলা সাহিত্য কিন্তু অনেক সমৃদ্ধ। বিশেষ করে কবিতা সাহিত্যে মুক্তযুদ্ধ প্রবলভাবে উঠে এসেছে। আধুনিক বাংলা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় রয়েছে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলা কবিতার চিরায়ত ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত কবিতাগুলো দলিল হিসেবে থেকে যাবে। এসব কবিতায় নিখুঁত বর্ণনা অবাক করার মতো। আর অনেক কবিতার মান অনেক উন্নত। বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের কবিতা লিখতে গেলে এসব কালজয়ী কবিতাগুলো অনুসরণ করি আমরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন : ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ/স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।’ মুক্তিযুদ্ধকালীন কবিতাগুলো আমরা ভাগ করতে পারি তিন ভাগে। মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ববর্তী ও পরের। মুক্তিযুদ্ধের আগের কবিতাগুলো বীর বাঙালীর প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করেছে। বিশ্বের মুক্তিকামীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সহায়তা করেছে। বাঙলীর মনে অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাগরিত করে একতাবদ্ধ করেছে। ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ কবিতায় যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেছেন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এভাবেÑ‘তাঁর চোখ বাঁধা হলো।/বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত/করল তার মুখ।/থেঁতলানো ঠোঁটজোড়া লালা/রক্তে একাকার হলো,/জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত/ঝরে পড়ল কংক্রিটে।/মা...মাগো... চেঁচিয়ে উঠল সে।/পাঁচশ’ পঞ্চান্ন মার্কা আধ-/খাওয়া একটা সিগারেট/প্রথমে ¯পর্শ করল তার বুক।/পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ/ছড়িয়ে পড়ল ঘরের বাতাসে।/তার শরীর ঘিরে/থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো/ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত,/ তাজা লাল রক্ত।/তার থেঁতলানো একখানা হাত/পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,/আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের/দুর্বিনীত লাভা’। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আর এক সাহসী উচ্চারণ। ‘আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,/আজও আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,/ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজও আমি তন্দ্রার ভেতরে/এদেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?’-(বাতাসে লাশের গন্ধ) হুমায়ূন আজাদের অমর পঙ্ক্তিমালা-‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?/তেমন যোগ্য সমাধিকই?/মৃত্তিকাবলো, পর্বতবলো/অথবা সুনীল-সাগর-জল-/সবকিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!/তাইতো রাখি না এ লাশ আজ/মাটিতে পাহাড়ে কিংবা সাগরে,/হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।’ (এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?) ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় শামসুর রাহমানের দৃপ্ত উচ্চারণ-‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।/বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে/নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনও/হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্মতায়/বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট/উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন ¯েœহের বিন্যাসে।’ আল মাহমুদের ‘ক্যামোফ্লাজ’ কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরা যেতে পারে-‘জেনো, শত্রুরাও পরে আছে সবুজ কামিজ/শিরস্ত্রাণে লতাপাতা, কামানের ওপরে পল্লব/ঢেকে রাখে/নখ/দাঁত/লিঙ্গ/হিংসা/বন্দুকের নল/হয়ে গেছে নিরাসক্ত বিষকাঁটালির ছোট ঝোপ’। পঁচিশ মার্চের কালরাত সত্ত্বেও ছাব্বিশ মার্চ থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ আন্দোলন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যাতে এগিয়ে যেতে না পারে সেজন্য পথে পথে তৈরি হয়েছিল ব্যারিকেড। রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবা, নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ যুক্ত হয়েছিল সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে। শহীদ কাদরীর কবিতায় তা পেয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনাÑ‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/কাচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,/একফালি টিন,/ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড় করল এক নিপুণ/ঐন্দ্রজালিকের মতো যত/এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই/প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করল কয়েকটা অক্ষর/‘স্বা-ধী-ন-তা’।’ (নিষিদ্ধ জার্নাল) হুমাযূন আজাদের কবিতায়Ñ ‘... সারা বাংলা রক্তে গেছে ভিজে।/ যে-নদীতে ভাসত রাজহাঁস সেখানে ভাসছে শুধু নিরীহ বাঙালীর লাশ।/ সূর্য আর নক্ষত্রের সারাবেলা মানুষের,/সেখানে প্রাগৈতিহাসিক পশুরা সে-মানুষ নিয়ে করে বর্বরতা খেলা/তারপর এলো নতুন বন্যা... সূর্যসংকাশ/ভেসে গেল জন্তুরা, জন্তুদের সকল আভাস।’- (খোকনের সানগ্লাস, অলৌকিক ইস্টিমার) কবি রফিক আজাদের ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ’ কবিতায় বীরোচিত মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে-‘তোমার মুখে হাসি ফোটাতে দামী অলঙ্কারে সাজাতে/ভীরু কাপুরুষ তোমার প্রেমিক এই আমাকে/ধরতে হলো শক্ত হাতে মর্টার, মেশিনগানÑ/শত্রুর বাংকারে, ছাউনিতে ছুড়তে হলো গ্রেনেড/আমার লোভ আমাকে কাপুরুষ হতে দেয়নি।’ সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায় পাওয়া যায় চরম উচ্চারণ, অত্যাচারী পাকিস্তানীদের প্রতি সাহসী প্রতিবাদÑ ‘তুমি আমার বাতাস থেকে নাও তোমার ধুলো/তুমি বাংলা ছাড়’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বেশ কয়েকজন কবিতা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত একটি কবিতা হচ্ছে ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর’। মার্কিন কবি এ্যালান গ্রিন্সবার্গ লেখেন। তাঁর লেখায় বলিষ্ঠভাবে ফুটে ওঠেছে স্বাধীনতাকালীন ভয়াবহতা- (গরষষরড়হং ড়ভ ংড়ঁষং হরহবঃববহ ংবাবহঃু ড়হব/ঐড়সবষবংং ড়হ ঔবংংড়ৎব ৎড়ধফ ঁহফবৎ মৎবু ংঁহ/অ সরষষরড়হ ধৎব ফবধফ, ঃযব সরষষরড়হ যিড় পধহ/ডধষশ ঃড়ধিৎফ ঈধষপঁঃঃধ ভৎড়স ঊধংঃ চধশরংঃধহ.) অর্থাৎ ‘লাখ লাখ আত্মা উনিশ শ’ একাত্তর/যশোর রোডে ঘরহীন উপরে সূর্য ধূসর/দশ লাখ মারা গেছে আর যারা পারছে/পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতার দিকে হাঁটছে।’ আমাদের একজন অকৃত্রিম বন্ধু- স্বাধীনতার বন্ধু জর্জ হ্যারিসন। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর বন্ধু-শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের ‘ও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ’-এর গানে ভয়াবহতায় নিমজ্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মৃত্যুঞ্জয়ী আত্মত্যাগ ও মহিমা ফুটে উঠেছে। ‘হাজার হাজার সহস্রলোক/মরছে ক্ষুধায়/দেখিনি তো এমন নির্মম ক্লেশ/বাড়াবে না হাত বল ভাইসব/কর অনুভব/বাংলাদেশের মানুষগুলোকে/ও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ/এত দুর্দশা/এ যন্ত্রণার নাই কোন শেষ/বুঝিনি তো এত নির্মম ক্লেশ’। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেন অমর কবিতাÑ‘...জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে/হয়েছে উদ্যত কালো হাত।/তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ/কবির বিরুদ্ধে কবি,/মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,/বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,/উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,/মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ।/...জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলাÑ;/কে রোধে তাহার বজ্র কণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনলেন তাঁর/অমর কবিতাখানি:/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।’ (স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো, নির্মলেন্দু গুণ) ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় শামসুর রাহমানের স্বাধীনতার স্বরূপ তুলে ধরলেনÑ‘‘স্বাধীনতা তুমি/গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,/হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।/স্বাধীনতা তুমি/খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,/খুকীর অমন তুলতুলে গালে/রৌদ্রের খেলা।/স্বাধীনতা তুমি/বাগানের ঘর, কোকিলের গান,/বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,/যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’। নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীনতাকে পর্যবেক্ষণ করলেন এভাবে-‘জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মতো/বেরিয়ে এসেছো পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও।...হে আমার দুঃখ, স্বাধীনতা, তুমিও পোশাক পরো;/ক্ষান্ত করো উলঙ্গভ্রমণ, নয়ত আমারও শরীরী থেকে/ছিঁড়ে ফেল স্বাধীনতা নামের পতাকা।/বল উলঙ্গতা স্বাধীনতা নয়,/বল দুঃখ কোন স্বাধীনতা নয়,/বল ক্ষুধা কোন স্বাধীনতা নয়,/বল ঘৃণা কোন স্বাধীনতা নয়।/জননীর নাভিমূল ছিন্ন-করা রক্তজ কিশোর তুমি/স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তুমি বেঁচে থাক/আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে, প্রেমে, বল পেন্সিলের/যথেচ্ছ অক্ষরে,/শব্দে,/যৌবনে,/কবিতায়’’।-(স্বাধীনতা, উলঙ্গ কিশোর) কী লিখলেন কবি আবুল হাসান তাঁর ‘উচ্চারণগুলো শোকের’ কবিতায়। মুক্তিযুদ্ধের স্বজন হারানোদের কষ্ট। ‘...তবে কি বউটি রাজহাঁস/তবে কি শিশুটি আজ সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?/অনেক যুদ্ধ গেল/অনেক রক্ত গেল/শিমুল তুলোর মতো সোনা-রুপা ছড়াল বাতাস।/ছোট ভাইটিকে আমি কোথাও দেখি না,/নরম নোলকপরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখি না।’ কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ‘স্বাধীনতা’ বড় হয়ে গেল। কষ্ট বেদনা ভুলে তাকে নিয়েই উদযাপন। আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলো শোকের’ কবিতার পরের অংশ দিয়েই শেষ করি। যেন সবার ভাবনাই ছিল এমন- ‘কেবল পতাকা দেখি, কেবল পতাকা দেখি, স্বাধীনতা দেখি!’
×