ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অনুপম আদর্শ প্রিয়নবী (সা.)

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অনুপম আদর্শ প্রিয়নবী (সা.)

(গত শুক্রবারের পর) প্রিয়নবী (সা) আল্লাহর যিকর অধিক পরিমাণে করবার তাকিদ বয়ে আনলেন। আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করলেন : ‘নিশ্চয় আল্লাহর যিক্্র অন্তরে প্রশান্তি আনে।’ একদিন এক ব্যক্তি প্রিয়নবী (সা) এর দরবারে আরয করলেন : ইয়া রসূলাল্লাহ্! ইসলামের বহু হুকুম-আহকাম আছে যা অবশ্যই পালন করতে হবে। তবুও আমাকে এমন একটি বিষয়ে শিক্ষা দিন যা প্রাণপ্রিয় সাক্ষী করে রাখতে পারি। প্রিয়নবী (সা) বললেন : ‘জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার জিহ্বা যেন আল্লাহর যিকরে সিক্ত থাকে।’ প্রিয়নবী (সা) এর জীবনাদর্শে তাবত্ গুণের সমাবেশ ঘটেছে। তিনি যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, তেমনি তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আল্লাহ্ তা’আলা বিশ্বজগত সৃষ্টির পূর্বে তাঁরই নূর অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেন। হযরত আদম (আ.)-এর জন্মেরও বহু পূর্বে আল্লাহ্ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নবুওয়াত দান করেন। যিনি সবার আগে নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর পৃথিবীতে আগমনের খবর পৌঁছে দেবার জন্য সেই আলমে আরওয়াহ্ তে সব নবী-রসূলের কাছ থেকে মীসাক বা অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ‘আর যখন আল্লাহ্ নবীদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দেই অতঃপর তোমাদের যা কিছু থাকে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রসূল আসবেন তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমরা কী স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল : আমরা স্বীকার করলাম। তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী থাকলাম।’ (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ৮১)। তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হলেন সবার পরে, তিনি সাইয়্যেদুল মুরসালীন- সব রসূলের নেতা, খাতামুন্নাবিয়ীন, সর্বশেষ নবী, নবীগণের সমাপ্তি। তিনি ন্যায়পরায়ণতা, দানশীলতা, বদান্যতা, বিন¤্রতা, মমতা, বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা, ধর্মপরায়ণতা, নির্ভীকতা, সাহসিকতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সকল গুণের অনুপম আদর্শ। সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাঁকে অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। মক্কার কাফির-মুশরিকরা তাঁর ওপর চালিয়েছে অকথ্য যুলুম-নির্যাতন। তাঁকে তারা উপহাস করেছে আবার নানা রকম প্রলোভনও দেখিয়েছে সত্য প্রচার থেকে নিবৃত্ত হবার জন্য। কিন্তু তিনি আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করা থেকে একটুও নিবৃত্ত হননি। নির্ভীকচিত্তে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘আল্লাহর কসম, আমার এক হাতে সূর্য আর এক হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালন করা থেকে আমি পশ্চাৎপদ হব না।’ আল্লাহর নির্দেশে তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসেছেন। মদিনা মুনওয়ারায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র। প্রণীত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র মদিনার সনদ। মক্কার কাফির-মুশরিকরা মদিনার ইহুদী ও মুনাফিকরা যৌথভাবে তাঁকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করবার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। তারা মদিনা আক্রমণ করেছে। প্রিয়নবী (সা) সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। যুদ্ধ করেছেন। সব যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক। প্রতিটি যুদ্ধেই তাঁর বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছে। অতঃপর মক্কা জয় হয়েছে। শত্রু তাঁর পদানত হয়েছে। তিনি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সে ক্ষমার নজির বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যায় না। ঘোষিত হয়েছে : ‘সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হবার।’ মহানবী (সা) দয়া, ক্ষমা ও সহমর্মিতা দ্বারা সব ধরনের নিষ্ঠুরতা মোকাবেলা করেছেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁকে ‘রাউফুর রাহীম’ অর্থাৎ দয়াবান দয়ালু খেতাবে ভূষিত করেছেন। তাঁর কাছে কেউ সাহায্য প্রার্থী হলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি বলেছেন : ‘এক খ- শুকনো খেজুর দান করার থাকলেও তাই দান করে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করো।’ যদি অতটুকুও সামর্থ্য না থাকে তাহলে অন্তত মিষ্টভাষী হয়ে সে চেষ্টা অব্যাহত রাখ। তিনি বলেছেন : ‘প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে যে পেটপুরে খায় সে মু’মিন নয়।’ প্রিয়নবী (সা) অতি অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। খেজুর পাতার ছাউনি দেয়া একটি ছোট্ট কুটিরে তিনি থাকতেন। কোনদিন মিহি আটার রুটি খাননি। তাঁর গৃহে খাদ্যাভাব প্রায়ই লেগে থাকত। জীবনে কখনও আরাম বিছানায় শয়ন করেননি। হযরত আবদুল্লাহ্্ ইব্ন মাস‘উদ (রা) বর্ণিত একখানি হাদিস থেকে জানা যায় যে, মহানবী (সা) খেজুর পাতার মাদুরের ওপর শয়ন করতেন। তাঁর জিসাম মুবারকে মাদুরের দাগ বসে যেত। একদিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘উদ (রা) প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলাল্লাহ (সা) কে বললেন; ইয়া রসূলাল্লাহ্্! আপনি যদি ইজাযত দেন তাহলে মাদুরের ওপর কিছু বিছিয়ে দেই। একথা শুনে প্রিয়নবী (সা) বললেন : ‘আমি তো একজন মুসাফিরের মতো, যে ক্ষণিক সময়ের জন্য একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে আবার সব ছেড়ে চলে যায়।’ তিনি কারও অসুখ-বিসুখের কথা শুনলে তাকে দেখতে যেতেন। তিনি বলেছেন : ‘রোগীর সেবাকারী নিজ গৃহে ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের পথে চলতে থাকে।’ প্রিয়নবী (সা) ক্রীতদাস প্রথার শেকড় উৎপাটন করেন, গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের পৃথিবীতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবার অধিকার নিশ্চিত করেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ‘ধনীদের ধন সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের ন্যায্য অধিকার রয়েছে।’ প্রিয়নবী (সা.) শিশুদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ, ইয়াতিমদের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম দরদ। এমনকি জীব-জন্তু, গাছপালার প্রতিও তিনি ছিলেন দারুণ দরদী, তাঁর জীবনাদর্শ উস্্ওয়াতুত্্ হাসানা, তা গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীতে সুখ-শান্তি প্রগতি ও সমৃদ্ধি আসতে পারে। ‘ইসলাম হার মরাল এ্যান্ড স্পিরিচুয়্যাল ভ্যালু’ গ্রন্থে মেজর আর্থার গ্লায়ন লিউনার্ড বলেছেন : ‘নবী হিসেবেই তিনি কেবল শ্রেষ্ঠ নন, বরং একজন দেশ প্রেমিক হিসেবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সুযোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে, দুনিয়াবী ও রূহানী নির্মাতা হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ। তিনি সংস্থাপন করেছেন একটি শ্রেষ্ঠ বসতি ও সা¤্রাজ্য। এই তিন মাহাত্ম্য ছাড়াও তাঁর সংস্থাপিত দীন আজও সর্বশ্রেষ্ঠ। তা ছাড়া তিনি যে সত্য কায়েম করেন তার যথার্থ কারণ হচ্ছে তিনি নিজের কাছে নিজে সত্য ছিলেন, তার জনগণের নিকট বিশ্বস্ত ছিলেন, সর্বোপরি তাঁর রব্্-এর অনুগত ছিলেন।’ জর্জ বার্নার্ড শ’র ভাষায় বলা যায় ‘If all the world was united under one leader Muhammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness. -‘পৃথিবীর নানা ধর্ম-মত, ধর্ম-বিশ্বাস ও চিন্তাধারার লোককে শান্তি ও সুখের পথে পরিচালিত করবার জন্য গোটা পৃথিবীটাকে একত্র করে যদি নেতা খোঁজা হয় তাহলে সর্বোত্তম ও যোগ্যতম ব্যক্তি হবেন হযরত মুহম্মদ (সা)।’ (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×