ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

সুলতান মেলায় প্রাণের ছোঁয়া...

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯

সুলতান মেলায় প্রাণের ছোঁয়া...

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল, যামিনী রায়, জয়নুল আবেদীন কিংবা কামরুল হাসানের অংকিত পথের যোগ্য সহযাত্রী কিন্তু নিজে নিজের মতো নির্মিত পথে হেঁটে যাবার নিভৃতচারী চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান। নড়াইলের বয়োজ্যেষ্ঠরা স্মৃতি হাতড়ে এখনও দেখে নেন, লম্বা চুলে, ছিপছিপে গড়নে, স্মিত হেসে, কোলে বুকে শাবক ছানা আঁকড়ে নড়াইলের অলি-গলি দিয়ে আপন ভাবনায় বিভোর হয়ে হেঁটে চলেছেন, সাধারণের মাঝ দিয়ে সাধারণ বেশে অসাধারণ বিশ্ব বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান। বিশ্বে বিশেষভাবে মূল্যায়িত হলেন যে চিত্র কর্মের আদলে সেখানেও রুচির নিজস্বতায় কত সাধারণ। লেখকের লিখতে যেমন কাগজ-কলম চিত্রকরের সেখানে তুলি-ক্যানভাস। কিন্তু বিদেশী ক্যানভাসের বিপরীতে বাংলার চটই বাংলা সন্তান এসএম সুলতানের ক্যানভাস। বাগান থেকে গাব পেড়ে, পানিতে মাস তিনেক ভিজিয়ে, কষ বের করে চটে ঘষে তৈরি করতেন ক্যানভাস। ক্যানভাসের রং সাদা করতেন চুন লাগিয়ে, চক পাউডার তেলে মিশিয়ে। বর্ণিল রং তৈরি করতেন জিংক অক্সাইড, পেউরি, ব্লু’র সঙ্গে কোপাল বার্নিস, লিনসিড মিশিয়ে। ক্যানভাসের গায়ে ড্রইং করার জন্য কাঠ কয়লার অবাধ ব্যবহার। অংকনে সকল দেশীয় উপকরণ অথচ এসএম সুলতানের জাদুকরী অংকনে চিত্র কর্মগুলো হয়ে উঠল বিশ্বজনীন। বাঙালীর বাঙালিত্বকে উপজীব্য করে যে এসএম সুলতানের শিল্পসৃজন তাঁকে হৃদয়ে ধারণ-বহন এবং বাস্তবায়নে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে করে চলেছেন কর্ণবীর এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লিয়াকত আলী লাকী। গত ৩০ নবেম্বর এবং ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে, নড়াইল জেলা প্রশাসন, নড়াইল এসএম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা ও শিশুসর্গ এবং নড়াইল শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায়, নড়াইল শিল্পকলা একাডেমির পুরোপ্রাঙ্গণ জুড়ে উদযাপিত হলো ২ দিনব্যাপী ‘এসএম সুলতান উৎসব ২০১৯’। লিয়াকত আলী লাকী পরিকল্পিত এসএম সুলতান উৎসব অবলোকনে দৃশ্যমান, ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারই সুন্দর বর্তমান নির্মাণ। এসএম সুলতান নিজে চিত্রশিল্পী ফলে এই উৎসবে তার নামাংকিত চিত্রশালায় তাঁর অংকিত চিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি মেলায় শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস, শিল্পী ধিমান বিশ্বাস, শিল্পী নিখিল চন্দ্র দাশ, শিল্পী বলদেব অধিকারীর অংকিত শিল্পকর্মের প্রদর্শন এবং শিল্পী কিংকর সূত্রধরের স্কাল্পচার প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শনে উপস্থাপিত চিত্র কর্মে বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের দৃষ্টিতে এসএম সুলতানের ভাব ও আদর্শ দৃশ্যত দৃশ্যমান। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণের প্রথম থেকেই আমি সংকল্পবদ্ধ, প্রয়াত গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আলোকিত দিকগুলোয় প্রজ্বলিত হব এবং সমসাময়িক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আরও অধিক ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করব। এসএম সুলতান উৎসব ২০১৯ তারই ধারাবাহিকতায় এই ধারা আমাদের এগিয়ে নিতেই হবে। এই এগিয়ে নেয়া প্রশ্নে নড়াইল জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা স্থির, ধীর কিন্তু লক্ষ্যাভিমুখী। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ, এই সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় বিশ্ববরেণ্য এসএম সুলতান চর্চাকে বেগবান করতে মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী’কে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করবে নড়াইল জেলা প্রশাসন। আলোচনা পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক আয়োজন। নৃত্য আলেখ্য, সঙ্গীত পরিবেশন, এ্যাক্রোবেটিক, ধামাইল নৃত্য, বাউল গান প্রভৃতি ছিল উৎসবে নান্দনিক মাত্রা। আলোচনা পর্বে উপস্থাপক সৌম সালেক এবং সাংস্কৃতিক পর্বের উপস্থাপক ছিল সুজন মাহাবুব। উৎসব সমাপনীতে শত শত দর্শকদের একাত্ব করে নিয়ে ভূপালি সুরে বাংলাদেশ শিল্পকলা মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী গেয়ে চললেন সেই গান যেখানে উচ্চারিত হলো ‘মঙ্গল হোক এই শতকে মঙ্গল সভার/ ঘরে ঘরে শান্তি আনুক সমৃদ্ধি অপার’। এসএম সুলতান সময় পেলে আঁধার রাতে আপন মনে বাজিয়ে যেতেন বাঁশরীয় বাঁশি। আজ তিনি নেই স্বশরীরে। তবু সুর তো বেজে চলেছে চিত্রা নদীর পাড়ে দিবা-রাত্রি নিরবধি।
×