ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকিয়া তিশা

পেশা নয়, ক্রিকেট তো আমার জীবন

প্রকাশিত: ১৩:১০, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯

পেশা নয়, ক্রিকেট তো আমার জীবন

টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে তুলতে গেলে পয়েন্ট সিস্টেমের চেয়েও জরুরী বোলার সহায়ক বাইশ গজ। ব্যাটসম্যানদেরও একটু-আধটু পরীক্ষা নেয়া হোক না! টেনিসের মতোই হোক ক্রিকেট! আচরেকর স্যারের শিক্ষা। দাদা অজিতের ক্লাস। ২০০৭ বিশ্বকাপের পরে কেন খেলা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন? নিঃশব্দে কীভাবে চলেছিল ২০১১ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি? তার প্রজন্মের ক্রিকেট এবং এখনকার ক্রিকেট। তার কাছে ক্রিকেটের অর্থ কী? কীভাবে আছেন প্রিয় খেলা থেকে দূরে? আরব সাগরের পাড়ে প্রিয় ওপেনিং পার্টনার সৌরভ গাঙ্গুলীর বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাত্রা শুরুর মহাযজ্ঞ। তা নিয়েও উচ্ছ্বসিত। অবসরের পরে এই প্রথম এত অন্তরঙ্গ, খোলামেলা ভঙ্গিতে শচীন টেন্ডুলকর। সোমবার বান্দ্রায় নিজের বাড়িতে বসে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে মুখ খুললেন না-বলা অনেক বিষয় নিয়ে। যেন এক অনাবিষ্কৃত শচীন। প্রশ্ন ॥ আইসিসি টেস্টের যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করেছে, তা কি টেস্ট ক্রিকেটের আকর্ষণ ফেরাতে পারবে বলে মনে হয়? শচীন ॥ আমার মনে হয়, পয়েন্ট সিস্টেমটা নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকবে। আর যত চ্যাম্পিয়ন চূড়ান্ত হওয়ার দিকে এগোবে, ততই লোকের কৌতূহল বাড়বে। ধরুণ, টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ঠিক হওয়ার মাস দুয়েক আগে থেকে একটা আকর্ষণ থাকবেই যে, কাদের মাথায় মুকুট উঠছে। কারণ, এই প্রথম টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়নের হাতে সেরার ট্রফিও তুলে দেয়া হবে। এখন আমার মনে হয়, লোকে টেস্ট ম্যাচ দেখার জন্যই শুধু দেখছে। লোকে ভাল ক্রিকেট দেখতে মাঠে আসে আর আমি মনে করি, ভাল টেস্ট ক্রিকেটের জন্য ভাল, স্পোর্টিং পিচ দরকার। প্রশ্ন ॥ ঠিক কী করা উচিত পিচ নিয়ে? শচীন ॥ বোলারেরা যথেষ্ট সাহায্য পায়, এমন পিচ যদি করা না-যায়, টেস্ট ক্রিকেটকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে তোলা যাবে না। শুধু পয়েন্ট প্রথা চালু করে টেস্ট ক্রিকেটকে আকর্ষক করে তোলা যাবে না। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দেখুন কী হচ্ছে। টি২০ দেখুন। ব্যাটসম্যানেরা প্রত্যেক বলেই আক্রমণ করতে যাচ্ছে। এতটাই ব্যাটসম্যানের পক্ষে ঢলে পড়েছে সীমিত ওভারের ক্রিকেট। দর্শকেরা কিন্তু মাঠে খেলা দেখতে আসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতে ব্যাট ও বলের লড়াই। অসম লড়াই নয়। ওয়ান ডে ক্রিকেটে কী সব স্কোর হচ্ছে, দেখুন! বোলারদের উপরে নানা বিধিনিষেধ চাপানো হচ্ছে। ফিল্ডিং নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সবকিছুই বোলারদের উপরে চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বোলারেরা এর ফলে নেতিবাচক মানসিকতায় আক্রান্ত হচ্ছে। ওরা ভাবছে, কী দরকার ঝুঁকি নিয়ে আক্রমণাত্মক হওয়ার। তার চেয়ে অফস্টাম্প লাইন ধরে বল করে যাই, বাবা। উইকেট নেয়ার দরকার নেই, রানটা আটকানোর চেষ্টা করি। আমার তাই মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্পোর্টিং উইকেট লাগবেই। আর শুধু স্পোর্টিং কেন, আমি তো বলব, বোলার সহায়ক পিচ বানাও। বোলার সহায়ক বলতে আমি বলছি না যে, পেসার সহায়কই হোক। স্পিনারদের সাহায্য করে, এমন পিচও হতে পারে। নির্ভর করবে কোথায় খেলা হচ্ছে। সেই জায়গার চরিত্র বুঝে উইকেট তৈরি করা হোক। কিন্তু বোলারদের জন্যও যেন জীবন থাকে সেই বাইশ গজে। প্রশ্ন ॥ মাঝখানে কথা উঠছিল, পিচের চরিত্র নিয়েও সমতা গড়ে তোলা হোক পৃথিবীর সর্বত্র। সে রকম কিছু কি হওয়া উচিত? শচীন ॥ না, না, আমি চাই না, সব দেশে একই রকম পিচ হোক। আমি ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন অব পিচেজ’-এর খুব একটা পক্ষে নই। নিউজিল্যান্ডের পিচ আর ভারত, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের পিচের চরিত্র তো কখনওই এক হবে না। আর সেটাই তো ব্যাটসম্যানদের কাছে চ্যালেঞ্জ। টেনিসে দেখুন। চারটি গ্র্যান্ডস্লামে চার ধরনের কোর্ট। উইম্বলডনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বা ফরাসী ওপেনের মিল নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, পিচ নিয়ে রেটিংয়ের ক্ষেত্রে আম্পায়ারদের বক্তব্যও নেয়া উচিত। খেলাটাকে সব চেয়ে কাছ থেকে তো তারাই দেখেন। যদি পিচ নিয়ে তারাও রেটিং করেন, তা হলে উপকার হবে। আর আম্পায়ারদের রেটিংয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি নম্বর দিতে বলা হোক নির্দিষ্ট বিষয়ের উপরে যে, পিচ বোলারদের সাহায্য করেছিল কি না? প্রশ্ন ॥ এটা সম্পূর্ণ নতুন পরামর্শ। তার মানে আপনি সরাসরি বোলার সহায়ক পিচ তৈরি করতে বলছেন? শচীন ॥ টেস্ট ক্রিকেটের জন্য, হ্যাঁ, তা-ই বলছি। হোক না, ক্ষতি কী? ওয়ান ডে বা টি২০ তো বোলারদের সারাক্ষণ পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা কোথায় নেয়া হয়? টেস্ট ক্রিকেটের উইকেট যদি ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষায় ফেলে, তা হলে টেস্ট আকর্ষক হয়ে উঠবে। প্রশ্ন ॥ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট প্রথা নিয়েও কথা উঠেছে। যেমন ধরুণ, নিজেদের দেশে দুর্বল কোন দলকে দুই টেস্টের সিরিজে হারালে ১২০ পয়েন্ট। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে পাঁচ টেস্টের সিরিজে ২-০ হারালে ৭২ পয়েন্ট। আপনি এই পয়েন্ট প্রথার সঙ্গে একমত? শচীন ॥ আমার মনে হয়, প্রতিটি ম্যাচের জন্য পয়েন্ট না-করে পুরো সিরিজ ধরে পয়েন্ট সিস্টেম করেছে আইসিসি। ওদের হয়তো মনে হয়েছে, প্রত্যেক দেশের সঙ্গে পাঁচ টেস্টের মতো লম্বা সিরিজ করা কঠিন হবে। সব দেশের দীর্ঘ সিরিজ দেখতে লোকে মাঠে আসবে না। সেটাও মাথায় রাখতে হবে। টিকেট বিক্রি করা কঠিন। তবু আইসিসি একটা প্রক্রিয়া চালু করেছে। পরে গিয়ে অনেক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ হবে। তখন অদলবদল করতে তো ক্ষতি নেই। কারও প্রতি অশ্রদ্ধা না- দেখিয়েই বলছি, সব দেশকে লম্বা টেস্ট সিরিজ দেয়ার কথাও ভাবা কঠিন। তাদের সেই জায়গাটা তৈরি করতে হবে। এখন যারা দুটো টেস্টের সিরিজ খেলছে, তাদের ভাল করে দেখাতে হবে। তখন দুই টেস্টের সিরিজ চার টেস্টে পরিণত হতেই পারে। প্রশ্ন ॥ আপনারা যখন খেলেছেন, টেস্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল না। আপনাদের লক্ষ্যটা কী রকম থাকত? শচীন ॥ যে ম্যাচটা জিতে উঠলে, সেটা নিয়ে ভাবা ছাড়ো আর পরের ম্যাচটা জেতার প্রস্তুতি শুরু কর। এটাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। তখনকার দিনে সরকারীভাবে টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ছিল না হয়তো, কিন্তু লক্ষ্যটা সব সময়েই ছিল সর্বসেরা হওয়ার। আর ট্রফি জেতার পরেও চল, পরের ম্যাচটা জিতব এটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। কতগুলো টেস্ট ম্যাচ জিতেছি, সেটা কখনোই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই লক্ষ্যটা রাখা যে, আগে যতই ম্যাচ জিতে থাকি না কেন, সামনে যে- ম্যাচটা আছে, সেটা আমাকে জিততে হবে। প্রশ্ন ॥ মানে আগের সব মুহূর্ত অতীত, সামনে তাকাও। এই ছিল শচীন তেন্ডুলকরের বরাবরের মন্ত্র? শচীন ॥ একদমই তাই। তিনটে ম্যাচ টানা জিতে উঠেও কখনও মনে হয়নি, ও আচ্ছা, আমি তিনটে ম্যাচ জিতে গিয়েছি। এবার একটু রিল্যাক্স করা যায়। নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সম্মান যখন পেয়েছ, সেই দায়িত্ববোধটাও সম্পূর্ণভাবে দেখাতে হবে। আর দায়িত্ববোধ মানে প্রতিটি ম্যাচে জেতার চেষ্টা করতে হবে। এটাই ছিল আমার শিক্ষা। আমাকে এভাবেই গড়ে তোলা হয়েছিল। আচরেকর স্যার, আমার পরিবারের বড়রা, আমার দাদা অজিত প্রত্যেকের কাছ থেকে ছোটবেলা থেকে একটাই শিক্ষা পেয়েছি: ক্রিকেট খেলাটাকে সম্মান করতে হবে। কার সঙ্গে খেলছি, কোথায় খেলছি, সে-সব নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না। আমার সব শিক্ষক, আমার বড়রা আশা করতেন, আমি সব সময় সেরাটা উজাড় করে দেব। ফল হয়তো সব সময় আমার পক্ষে যাবে না। কিন্তু প্রস্তুতি এবং মানসিকতায় কোন তফাত জীবনে কখনও ঘটেনি। বিশ্বের সব চেয়ে দুর্বল দলের বিরুদ্ধেই খেলি বা সেরা টিমের বিরুদ্ধে, আমার দিক থেকে চেষ্টাটা বরাবর এক শ’ শতাংশ ছিল। প্রশ্ন ॥ এই দায়বদ্ধতা আর নিষ্ঠা এখনকার ছেলেদের মধ্যে খুঁজে পান? শচীন ॥ আমি বিশ্বাস করি না এমন কোন খেলোয়াড় এই দুনিয়ায় থাকতে পারে, যে মাঠে নামে ব্যর্থ হওয়ার জন্য। নিশ্চয়ই সকলে তৈরি হয় সফল হওয়ার তাগিদ নিয়েই। প্রস্তুতির ধরন আলাদা হতে পারে, কিন্তু এই লক্ষ্যটা মনে হয় একই। আমার বেড়ে ওঠাটা অন্য ধরনের ছিল। এখনও বিশ্বাস করি, জীবনে যা কিছু আমি পেয়েছি, তা এই বেড়ে ওঠার ধরনের জন্য। তাই আমার প্রস্তুতি হয়তো অন্যদের সঙ্গে মিলবে না। ধরনটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। লক্ষ্যটা থাকা জরুরী যে, আমি সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ওঠার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকব। চলার পথে যতই ঝড়ঝঞ্জা আসুক, আমি হার মানব না। প্রশ্ন ॥ প্রায় ছ’বছর বছর হতে চলল আপনি ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন। এত দিনে সয়ে যাওয়াই উচিত। তবু জিজ্ঞেস করছি, যার জীবন জুড়ে ছিল ক্রিকেট, তার পক্ষে সেই ক্রিকেটের রুটিনের বাইরে থাকা কতটা কঠিন? শচীন ॥ আমি এখন আর একটা খেলায় পড়ে নেই, বহুমুখী হয়ে উঠেছি (হাসি)। খেলার দিনগুলোতে যা যা করতাম, এখনও সেসব করি। এই যেমন জিমে যাওয়া, মাঝেমধ্যে দৌড়ানো এবং নানা ধরনের খেলায় ব্যস্ত থাকা। তবে হ্যাঁ, এখনকার এই রুটিনের সঙ্গে তো আর সিরিয়াস ক্রিকেটের দিনগুলোকে মেশানো যায় না। ক্রিকেট আমার কাছে পেশা নয়। একটা আবেগ। সেই আবেগকে আঁকড়ে ধরে আমি নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছি সব সময়। ক্রিকেট আমার জীবন। সেই জীবনে বুঁদ হয়ে আমি বাঁচতে চেয়েছি। ফিরে তাকিয়ে সবচেয়ে যেটা ভাল লাগে, তা হচ্ছে, ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার রাস্তায় আমি মানুষকে আনন্দ দিতে পেরেছি। তাই মাঠে ভাল করার জন্য যে- পরিশ্রমটা করতে হতো, সেটাকে কখনও কষ্টকর রুটিন মনেই হয়নি। খুব আনন্দের সঙ্গেই আমি সেটা করে যেতে পেরেছি। কারণ, মুখ তুললেই দেখতাম, শ’ শ’ মানুষ আমার খেলা দেখে আনন্দ পেতে চাইছেন। তাদের সেই চাওয়াটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ক্রিকেটজীবনের সেই অনুভূতির সঙ্গে এখন টুকরোটাকরা খেলার তুলনা হতে পারে না। এখন বেশিটাই মজা আর নিজেকে ফিট রাখার জন্য খেলা। কিন্তু একটা জিনিস বলতে পারি। এখনকার এই খেলাগুলোও আমি হৃদয়ের মাঝখান থেকে উপভোগ করি। আমি একজন খেলোয়াড় ছিলাম। এখনও খেলোয়াড়ই আছি। প্রশ্ন ॥ এখনকার ভারতীয় দল সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? শচীন ॥ আমাদের দলটায় ভারসাম্য খুব ভাল। যেমন উচ্চমানের পেসার রয়েছে, তেমনই দুর্দান্ত স্পিনার। তেমনই ভাল সব ব্যাটসম্যান। অলরাউন্ড দক্ষতা বেশ ভাল। যে কোন দেশে গিয়ে ভাল খেলার মতো টিম রয়েছে আমাদের। আমার মনে হয়, খুব ধারাবাহিকতাও দেখিয়েছে ওরা। ক্রিকেট বিশ্বের সব জায়গায় গিয়েই আমরা লড়াই করেছি এবং ভবিষ্যতেও এই দলটার কাছ থেকে একই রকম লড়াই দেখতে পাব বলে আশা করা যায়। প্রশ্ন ॥ বলা হচ্ছে, ভারতীয় ক্রিকেটকে পাল্টে দিয়েছে নতুন প্রজন্মের পেস বোলিং। এটাই দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা পেস বোলিং আক্রমণ, এমন মন্তব্যও আসছে। শচিন ॥ তুলনা করায় আমি বিশ্বাসী নই। আমাদের সময়েও ভাল পেস বোলারেরা ছিল। কিন্তু আগের চেয়ে বর্তমানের বড় তফাত হচ্ছে, ব্যাটসম্যানদের গুণগত মানের তারতম্য। কারও প্রতি অসম্মান না-দেখিয়েই একটা কথা বলছি। যদি আমাদের সময়কার যে- কোন টিমের ব্যাটিং বিভাগকে ধরেন আর এখনকার টিমগুলোর ব্যাটিং বিভাগকে দেখেন, দুটো কি সত্যিই গুণগত দিক থেকে সমান? আবার বলছি, কাউকে অশ্রদ্ধা করার কোন ইচ্ছা নেই। কিন্তু না- বলেই বা উপায় কোথায় যে, ক্রিকেটের মান পড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা দেখুন। একই দিনে নব্বই ওভারের মধ্যে প্রায় দু’বার অলআউট হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে টিমগুলোর শক্তিও যদি যাচাই করেন, অনেক তফাত চোখে পড়বে। আমাদের সময়কার অস্ট্রেলিয়া আর এখনকার অস্ট্রেলিয়া কি সমান শক্তির? আমি তুলনায় ঢুকতে চাই না, কিন্তু সকলের চোখের সামনেই তো সবকিছু রয়েছে। তবে এক নিঃশ্বাসে এটাও বলতে চাই যে, আমাদের টিম দারুণভাবে এগিয়ে চলেছে। আমরা উন্নতি করেছি, এগিয়েছি। অন্যদের মান পড়েছে। দারুণ ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে আমাদের এখনকার টিম। তার জন্য ওদের সর্বোচ্চ প্রশংসা প্রাপ্য। কিন্তু সব মিলিয়ে যদি দেখেন, এখন ক্রিকেটবিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি দলই আছে, যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টেস্ট ম্যাচকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত গিয়ে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মধ্যে ফয়সালা হওয়াটা প্রায় হারিয়েই গিয়েছে। তার কারণ, বেশির ভাগ টিম টেস্ট ম্যাচকে সম্পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত নিয়ে যেতেই পারছে না! দলগুলোর গুণগত মান বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মান পাল্টেছে। প্রশ্ন ॥ অনেকে টেস্ট থেকে আগেভাগে অবসর নিয়ে ফেলছে সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলবে বলে। দেখে ধাক্কা লাগে না? শচীন ॥ যুগের হাওয়া। পরিবর্তনকে তো মেনে নিতেই হবে। অনেক ক্রিকেটার এখন সারাবছর বিভিন্ন টি২০ লীগ খেলে বেড়ায়। তাদের হয়তো মনে হয়, এ ভাবেই ক্রিকেট খেলবে। ঠিকই আছে। এটা তাদের ব্যাপার। টেস্ট ক্রিকেটকে ভাল লাগতেই হবে, এমন কোন দাবি তো জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না। তা-ই না? প্রশ্ন ॥ বিশ্ব পর্যায়ে ভারতের ট্রফি না- জেতা নিয়ে কথা উঠছে। শেষ বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে হেরেছে টিম। অবশ্যই দেশের মানুষের কাছে একটা ধাক্কা। আপনার কী মনে হয়? কেন আমরা বিশ্বকাপ বা বিশ্ব মানের প্রতিযোগিতা জিতছি না? শচীন ॥ আমি বলব, মোক্ষম সময়ে ব্যাটিং ঠিক না-হওয়াটা আমাদের ট্রফি না- জেতার প্রধান কারণ। টেস্ট ক্রিকেটে ম্যাচ জেতায় বোলারেরা। কারণ, কুড়িটা উইকেট নিতে না পারলে ম্যাচ জেতা যাবে না। তেমনই ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতায় ব্যাটসম্যানেরা। ওই জায়গাটাতেই আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী তা করতে পারিনি। আমরা ব্যাটিংয়ে ভাল করেছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু মোক্ষম সময়ে, নকআউট পরিস্থিতিতে যখন সবাই তাকিয়ে ছিলাম ব্যাটিংয়ের দিকে, তখন যে- কোন কারণেই হোক, ব্যাটিং জেতাতে পারেনি। আমি এমনিতে বিশ্বাস করি না যে, খেলায় ব্যর্থতার জন্য কোন একটা কারণকে আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব। একাধিক কারণ থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, মাহেন্দ্রক্ষণে ব্যাটিং সফল না হওয়াটাই কারণ। প্রশ্ন ॥ বিশ্বকাপ! আপনার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলুন, একজন খেলোয়াড়ের জীবনে কত বড় প্রাপ্তি হতে পারে বিশ্বকাপ জয়? শচীন ॥ যে কোন খেলোয়াড়ের জীবনে বিশ্বকাপ সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। এই বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই আমার মনে। এই কারণে আমি বলি, আমার ক্রিকেটজীবনে দুটো অধ্যায়। একটা ২০০৭ পর্যন্ত। অন্যটা শুরু হয়েছিল, ঠিক ২০০৭ বিশ্বকাপে হারের পর থেকে। চার বছর ধরে আমি পরিশ্রম করেছিলাম ২০১১ বিশ্বকাপ জেতার লক্ষ্য নিয়ে। এপ্রিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দেশে ফিরেই আমি ট্রেনিং শুরু করে দিয়েছিলাম। কারণ, মাথায় ঘুরত একটাই জিনিস। এক বার বিশ্বকাপ জিততেই হবে। প্রশ্ন ॥ তার মানে ২০১১ বিশ্বকাপ জেতার নেপথ্যে কোন এক বা দু’বছরের পরিশ্রম বা প্রস্তুতির গল্প নেই। আছে দীর্ঘ চার বছরের প্রস্তুতির কাহিনী? শচীন ॥ অথবা বলতে পারেন, দীর্ঘ বাইশ বছরের প্রস্তুতি (হাসি)। কারণ, সত্যিই তো আমার বাইশ বছর লেগে গিয়েছিল বিশ্বকাপ জিততে। ক্রিকেট থেকে বিদায় নেয়ার আগে ওই একটা ট্রফি আমি দু’হাতে ধরতে চেয়েছিলাম। সেই কারণেই আমি বলি, আমার ক্রিকেটজীবনের দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। তার আগে ২০০৫, ২০০৬ ভাল যায়নি আমাদের। ওই সময়টা ভারতীয় ক্রিকেট নানা ঘটনাকে ঘিরে উত্তাল হয়েছে। সেই পরিস্থিতিটা আমাদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রশ্ন ॥ ২০০৭ বিশ্বকাপে নক আউটের আগেই বিদায় নেয়া ছিল বিরাট ধাক্কা। আপনি খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলেন বলে শুনেছিলাম। শচীন ॥ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি ক্রিকেট খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। অবসরই নিয়ে নিচ্ছিলাম ২০০৭ বিশ্বকাপ হারার পরে। মনে হয়েছিল, আর আমি প্রিয় খেলাটাই উপভোগ করতে পারব না। সেই সময় একদিন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস ফোন করে চল্লিশ মিনিট ধরে আমাকে বোঝালেন। উনি বললেন, তোমার মধ্যে অনেক ক্রিকেট বাকি আছে এখনও। ছাড়বে কেন? দাদা অজিত বোঝাল। এসব মানুষ আমাকে ফের শক্তি জোগাতে থাকল। তাতেই আমার মনে পরিবর্তন হলো। আমি নতুন করে শপথ নিই, ২০১১ বিশ্বকাপ জিততেই হবে। তার জন্য যা যা করার দরকার, করব। ভোর সাড়ে ৫টায় উঠে আমি মাঠে যেতাম ট্রেনিং করতে। যাতে কেউ আসার আগেই আমার কাজটা নিঃশব্দে সেরে ফেলা যায়। কতদিন হয়েছে, আমি বেরিয়ে আসার সময় গ্রাউন্ডসম্যানদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারা তখন মাঠে ঢুকছেন। কিছু দিন পর থেকেই আমি আবার সমস্ত কিছু উপভোগ করা শুরু করলাম। জীবনে কোন কিছু করতে গেলে একটা কারণ দরকার হয়। আমার ক্রিকেট খেলার কারণটা হারিয়ে যেতে বসেছিল ২০০৭ বিশ্বকাপে হেরে গিয়ে। সেটা আবার ফিরতে শুরু করল। ক্রমশ আমার মধ্যে গেঁথে যেতে থাকল একটা মন্ত্র: ২০১১ বিশ্বকাপ জিততেই হবে। প্রশ্ন ॥ এ যেন ক্রিকেটের মাধ্যমে জীবনের শিক্ষা! কোন কিছু যদি অন্তর থেকে তীব্রভাবে চাও আর সাধনায় ডুবে থাকতে পার, তা হলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে...। শচীন ॥ ২০০৭ ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়। ২০১১ আমার জীবনের সবচেয়ে আলোকিত মাহেন্দ্রক্ষণ। চার বছরে ক্রিকেট আমাকে মুদ্রার দু’টো পিঠই দেখিয়ে দিয়েছিল। ওই চার বছর জীবনের শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছিল। সূত্র : ওয়েবসাইট
×