ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাকিল আহমেদ মিরাজ

গোলাপি ট্রিপলে অনন্য ওয়ার্নার

প্রকাশিত: ১৩:০৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯

গোলাপি ট্রিপলে অনন্য ওয়ার্নার

স্টিভেন স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার, রিকি পন্টিং-মাইকেল ক্লার্কের অবসরের পর অস্ট্রেলিয়ার বড় মুখ। বড় নাম। তাদের ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছিল দেশটির ক্রিকেট। কী এক ভুত চাপল। বল টেম্পারিংয়ের কলঙ্কে জড়িয়ে পড়লেন অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক। কেবল অস্ট্রেলিয়া নয়, কেঁপে উঠল গোটা ক্রিকেটবিশ্ব। অনেকে তো এমনও বলছিলেন ওদের ক্যারিয়ার শেষ। কিন্তু তারা ফিরলেন দুর্দান্ত প্রতাপে। নিষেধাজ্ঞায় নষ্ট হয়ে যাওয়া সময়টা পুষিয়ে নিতে যেন নিজেদের মধ্যেই প্রতিযোগীতায় মেতে উঠলেন সময়ের সেরা দুই উইলোবাজ। বিশ্বকাপে প্রত্যাবর্তনে জ্বলে ওঠেন ওয়ার্নার, করেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৪৭ রান। ঐতিহ্যের এাশেজে পাঁচ টেস্টে রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিয়ে আরেক তারকা স্মিথ করেন ৭৭৪ রান। কিন্তু আচমকা খেই হারানো ওয়ার্নার ৯.৫০ গড়ে করেন ৯৫ রান! ব্যাপক সমালোচনার মাঝেও তাঁকে একাদশ থেকে বাদ দেয়নি অসি-ম্যানেজমেন্ট। ফর্ম ইজ টেম্পারারি বাট ক্লাস ইজ পর্মানেন্ট- অপ্তবাক্য বোঁঝানোর জন্য ওয়ার্নারও খুব বেশি সময় নেননি। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরির (১৫৪) পর দ্বিতীয় টেস্টে হাঁকিয়েছেন ট্রিপল সেঞ্চুরি (৩৩৫*), টেস্ট ইতিহাসের অনেক পরিসংখ্যানই কাঁপিয়ে দিয়েছেন বাঁ-হাতি এ ওপেনার। এ্যাডিলেডে ডে-নাইট টেস্টের প্রথম দিনেই ক্যারিয়ারের ২৩নম্বর সেঞ্চুরি তুলে নেয়া ওয়ার্নার দ্বিতীয় দিনে ব্যাটিংয়ে নামেন ১৬৬ রান নিয়ে। ডাবল সেঞ্চুরিতে পৌঁছান ২৬০ বলে। ট্রিপল সেঞ্চুরি ৩৮৯ বলে। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া যখন ৩ উইকেটে ৫৮৯ রানে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে, ওয়ার্নারের নামের পাশে তখন অপরাজিত ৩৩৫। ৪১৮ বলের ম্যারথান ইনিংসটি তিনি সাজিয়েছেন ৩৯ বাউন্ডারি ও একটি ছক্কা দিয়ে। যেভাবে ব্যাট চালাচ্ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল ব্রায়ন লারার ৪০০ রান টপকে নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন তিনি। ধারাভাষ্যকাররাও বার বার সেটা বলছিলেন। কিন্তু অভিজাত অস্ট্রেলিয়ার কাছে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়! সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করে দিনের বাকি ৩৪ ওভারের মধ্যে ৯১ রানেই পাকিস্তানর ৬ উইকেট তুলে নিয়েছেন বোলাররা। শেষ পর্যন্ত লারার রেকর্ড অক্ষতই থাকল, টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের তালিকায় ওয়ার্নার থাকলেন ঠিক দশ নম্বরে। তবে আরও অনেক ক্ষেত্রে রেকর্ডবই নাড়িয়ে দিয়েছেন সুপার ওয়ার্নার। এ্যাডিলেড ওভালের ইতিহাসে অনেক স্মরনীয় মুহুর্ত রয়েছে। সেই ডন ব্র্যাডম্যানের সময় থেকেই এই মাঠ ঐতিহ্যে ভরপুর। কিন্তু এতদিন এই মাঠ ট্রিপল সেঞ্চুরির সাক্ষী হয়নি। এর আগে ১৯৩২ সালে অ্যাডিলেডে স্যার ব্র্যাডম্যান ২৯৯ রান করেছিলেন। ৮৭ বছর পর সেই রেকর্ড ভেঙেছেন ওয়ার্নার। স্যার ব্র্যাডম্যান (৩৩৪) ও মার্ক টেইলর (৩৩৪*) এই জায়গাটা দখল করেছিলেন। ১ রান নিয়েই তাদের পেছনে ফেলেন তিনি। ৩৮০ রান করে অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে তালিকায় সবার ওপরে ম্যাথু হেইডেন। আর মাত্র পাঁচ রান করলেই পাকিস্তানের হানিফ মোহাম্মদ (৩৩৭) ও শ্রীলঙ্কার জয়সুরিয়াকে (৩৪০) ছাড়িয়ে যেতেন তিনি। ঠিক ৪০০ রান নিয়ে যেখানে সবার ওপরে ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তী ব্রায়ান লারা। সপ্তম অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করলেন ওয়ার্নার। এর মধ্যে একমাত্র ডন ব্যাডম্যানেরই আছে দুটি ট্রিপল। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সবশেষ ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিলেন মাইকেল ক্লার্ক, ২০১২ সালে সিডনিতে, ভারতের বিপক্ষে।টেস্টে ৩৩ বছর বযসি ওয়ার্নারের আগের সর্বোচ্চ ছিল ২৫৩, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ২০১৫ সালে। সর্বোপরি পাকিস্তানের বিপক্ষে ট্রিপল সেঞ্চুরি করা চতুর্থ ব্যাটসম্যান হলেন ওয়ার্নার। আগের তিনজন হলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যার গ্যারি সোবার্স (৩৬৫*), অস্ট্রেলিয়ার মার্ক টেলর (৩৩৪*) ও ভারতের বীরেন্দর শেবাগ (৩০৯)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে ওয়ার্নারের সামনে শুধু ম্যাথু হেইডেন। ২০০৩ সালে পার্থে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিনি করেছিলেন ৩৮০। দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ডে-নাইট টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করলেন ওয়ার্নার। এই টেস্টেই খেলা প্রতিপক্ষ পাকিস্তান অধিনায়ক আজহার আলি এর আগে করেছিলেন অপরাজিত ৩০২, ২০১৬ সালে দুবাইয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান হিসেবে একাধিক ২৫০-প্লাস ইনিংস খেললেন ওয়ার্নার। যে কীর্তি ব্র্যাডম্যানের আছে পাঁচটি, ক্লার্ক ও ওয়ার্নারের দুটি করে। ওপেনারদের মধ্যে এমন ইনিংস চারটি আছে শুধু বিরেন্দর শেবাগের। সনাৎ জয়সুরিয়া, গ্রায়েম স্মিথ, ক্রিস গেইল, এ্যালিস্টার কুক ও ওয়ার্নারের দুটি করে। শচীন টেন্ডুলকর। ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তী। এক শ’টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিসহ রেকর্ড বইয়ের অনেক কিছুই তার নামের পাশে। অনেকের মতে শচীনের কিছু রেকর্ড হয়ত কোনদিনই ভাঙবে না। কিন্তু অবাঁক ব্যাপার টেস্টে একটি ট্রিপল সেঞ্চুরি নেই তার! এখন যে রানের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন বিরাট কোহলি। টি২০তে সেঞ্চুরি নেই সেই তারও! ক্রিকেট এমনই। রেকর্ডের সুযোগ বারবার আসে না। আসলে সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন সবাই। যেভাবে এগোচ্ছিলেন মনে হচ্ছিল ব্রায়ান লারার ৪০০ রানের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য। ওয়ার্নার অপরাজিত থাকা সত্বেও ইনিংস ঘোষণা করে দেন অধিনায়ক টিম পেইন। এ নিয়ে আফসোস নেই তার,‘আবহাওয়ার কথা ভেবে আমরা নিজেদের পর্যাপ্ত সময় দিতে চেয়েছি। ভাবনা ছিল, যদি বেশি ওভার বোলিংয়ের জন্য পাই; তাহলে আমরা কয়েকটি উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করব। ব্যক্তিগত ৪০০ রান কিংবা রেকর্ড এ ধরনের কিছু আমাদের মাথাতেই ছিল না।’ তবে স্বদেশী ব্র্যাডম্যানের রেকর্ডেটা মাথায় ছিল, ‘অবশ্যই ছিল। ছোটবেলা থেকেই এই কীর্তির কথা শুনে এসেছি। আমার মনে আছে, সিডনিতে মাইকেল ক্লার্ক অপরাজিত ৩২৯ রানে ইনিংস করেছিল। আমরা এসব ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় দেখেছি। তখন মনে হতো, এই রান ওরা কীভাবে করল, কতটা সময় ব্যাট করতে হয়েছে! আজ আমিও সেই কাজটা করলাম। তবে আমাকে অসম্ভব ধৈর্য দেখাতে হয়েছে। সত্যি বলতে আমি নিজেই অবাক হয়েছি।’ ৪০০ রানের মাইলফলক পেরিয়ে যাওয়া কি কারও পক্ষে সম্ভব? জবাবে বাঁ-হাতি ওপেনার বলেন, ‘কোনো একজন ক্রিকেটারের নাম যদি বলতেই হয়, তাহলে আমি রোহিত শর্মার কথাই বলব। লারার রেকর্ড ভাঙতে পারে একমাত্র রোহিতই।’ টিম পেইন যদি আরেকটু পরে ইনিংসটা ঘোষণা করতেন, তাহলে হয়তো ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ব্রায়ান লারার ব্যক্তিগত ৪০০ রানের রেকর্ড ভেঙে দিতেন ডেভিড ওয়ার্নার। পেইনের এই সিদ্ধান্তে বিস্মিত খোদ রেকর্ডেল মালিক,‘ও যখন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে পেছনে ফেলল, আমি ধরে নিয়েছিলাম সে আমার রেকর্ড ভাঙছে। ভালো লাগছিল তখন। তার ইনিংস শেষে মাঠে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম আমি। আমি ধারাভাষ্যকারদের বলতে শুনছিলাম, সে ম্যাথু হেইডেনের ৩৮০ রান ছাড়াতে পারবে কি না। তবে আমার মনে হচ্ছিল সে যদি একবার হেইডেনেরটা পেরোতে পারে, তাহলে আমার রেকর্ডটাও ভাঙতে পারবে। আমি এখনো মনে করি ওয়ার্নার তার ক্যারিয়ারে এই রেকর্ড ভাঙার আরও সুযোগ পাবে। ও অনেক আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়।’ বলেন লারা। এ্যাডিলেডে ওয়ার্নার যখন পাকিস্তানি বোলারদের দুরমুশ করছিলেন, তখন ব্যাবসায়িক কাজে ওই শহরেই ছিলেন লারা। হঠাৎ জানতে পারেন যে, ওয়ার্নার তার রেকর্ড ভেঙে দিতে যাচ্ছেন। এ নিয়ে মোটেও হীনমন্যতায় ভোগেননি ক্যারিবিয়ান রাজপুত্র। বরং বেশ খুশি হয়েছিলেন। রেকর্ড যার পায়ের নিচে গড়াগড়ি খেত, তিনি কেন হীনমন্যতায় ভূগবেন? খবর শুনেই তিনি এ্যাডিলেড ওভালের উদ্দেশ্য রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু তখনই টিম পেইন ইনিংস ঘোষণা দিয়ে দেন! ক্যারিবীয় কিংবদন্তি বলেন, ‘আমি আশা করেছিলাম তারা আমাকে খুঁজে বের করে মাঠে নিয়ে যাবে। আমি আশা করেছিলাম ওয়ার্নার এই রেকর্ড করার সুযোগ পাবে। সোবার্সের মতো ওয়ার্নারকে অভিনন্দন জানাতে পারলে ব্যাপারটা বেশ হতো। রেকর্ড হয়ই ভাঙার জন্য। ওয়ার্নারের মতো আক্রমণাত্মক মানসিকতার খেলোয়াড়রা যদি সেটা ভাঙে, তাহলে আরও চমৎকার লাগে। বিনোদন দেয়। এ্যাডিলেডে থাকায় আমি ওকে শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগ পেয়েছিলাম, অন্তত মাঠে না গেলেও এই সুযোগে তার সঙ্গে দেখা হতে পারত।’ উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৭৫ রান করে তখনকার রেকর্ডধারী কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান স্যার গ্যারি সোবার্সের অপরাজিত ৩৬৫ রানের রেকর্ডকে পেছনে ফেলেন লারা। তখন গ্যারি সোবার্স বার্বাডোজের মাঠে নেমে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন উত্তরসূরিকে। সেই লারাও হয়তো ভেবেছিলেন, একইভাবে ডেভিড ওয়ার্নারকে অভিনন্দন জানাবেন। কিন্তু টিম পেইন লারাকে এভাবে ‘পেইন’ দেবেন, সেটা কে জানত!
×