ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন স্বর্ণপদক জিতে বাজিমাত কারাতেকাদের

প্রকাশিত: ১৩:০৩, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯

তিন স্বর্ণপদক জিতে বাজিমাত কারাতেকাদের

সোমবার কারাতে ইভেন্টে ছিল বাংলাদেশের জন্য হতাশার দিন। তবে মঙ্গলবার সেই হতাশা দূর হয়েছে আল-আমিনের মাধ্যমে। নেপালের কাঠমান্ডুর সাতদোবাতো কারাতে হলে অনুষ্ঠেয় কারাতের কুমি ইভেন্টে মাইনাস ৬০ কেজি ওজন শ্রেণীতে তিনি পাকিস্তানের মোহাম্মদ জাফরকে ৭-৩ পয়েন্টে হারিয়ে জিতে নেন কাক্সিক্ষত সোনার পদক। বাংলাদেশও পায় আসরে নিজেদের দ্বিতীয় সোনা। আল-আমিন এর আগে সেমিতে ৭-৪ পয়েন্টে হারান নেপালের প্রতিযোগীকে। স্বর্ণজয়ের পর আল-আমিনের অভিব্যক্তি ছিল এরকম, ‘খুবই ভাল লাগছে। বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি। এসএ গেমসে এটাই আমার প্রথম অংশগ্রহণ এবং প্রথম পদক।’ পাকিস্তানের বিপক্ষে অন্যান্য ম্যাচে অন্য কারাতেকাররা সুবিধা করতে না পারলেও আল-আমিন চমৎকার খেলেছেন। এর রহস্য কী? ‘কোচ বলেছেন প্রতিপক্ষ যেভাবে খেলে সেভাবে খেললে তার কাছ থেকে পয়েন্ট পেতে পারবে। আমি সেভাবেই খেলেছি।’ আমিনের ভাষ্য। বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আল-আমিনকে অভিনন্দন। কালকেও দিনটা শুরু হয়েছিল স্বর্ণ জিতে। আজও শুরু হলো ভাল খবর দিয়ে। এভাবে দিন শুরু হলে সত্যিই ভাল লাগে। আমি আগেই বলেছিলাম গত আসরের চেয়ে এবার আমরা ভাল করব। সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি।’ আল-আমিন ২০১১ সালে রাজশাহী জেলার হয়ে প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন। ২০১৩ সালে তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। ২০১৫ সালে প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেই স্বর্ণ জেতেন। তার বেশকিছু আন্তর্জাতিক পদক আছে। তার মধ্যে ভারতে তিনি একটি স্বর্ণ জিতেছেন। গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সাউথ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ১টি স্বর্ণ ও ১টি রৌপ্য জেতেন। সাফ গেমসেও রয়েছে তার পদক। রাজশাহীর ছেলে আল-আমিনরা দুই ভাই, এক বোন। বাবা ব্যবসায়ী। কারাতেতে আল-আমিনের আসার পেছনে তার ছোট চাচা শরিফুল ইসলামের অনেক অবদান। তিনি কারাতের কোচ ছিলেন। শিশু আল-আমিনকে তিনি নিয়ে যেতেন কারাতে শেখানোর জন্য। শুরুতে এই খেলাতে আল-আমিনের মোটেই আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তার কোচ চাচা ছিলেন নাছোড়বান্দা। এ জন্য আল-আমিনকে মাঝে মধ্যে কিঞ্চিৎ প্যাদানিও দিতেন। এভাবেই কারাতেকা বনে যান আমিন। পরে খেলাটির প্রেমে পড়ে যান। আর তারপরের কাহিনী তো সবারই জানা। চারুকলার ছাত্রী প্রিয়ার উচ্ছ্বাস পড়েন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে। দেখলেই বোঝা যায় মেয়েটি খুবই শান্ত-শিষ্ট। কিন্তু অবাক হবেন তখনই যখন শুনবেন ১৯ বছর বয়সী সুদর্শনা এই মেয়েটি মারামারিতে বেশ পটু। এমনই পটু যে, এসএ গেমসে সোনার পদকই জিতে ফেললেন। মঙ্গলবার মেয়েদের কারাতেতে ব্যক্তগত কুতে মাইনাস ৫৫ কেওজন শ্রেতে সোনা জিতেছেন বাংলাদেশের মারজান আক্তার প্রিয়া। এবারের আসরে প্রথম বাংলাদেশী নারী এ্যাথলেট হিসেবে সোনা জেতেন তিনি। ফাইনালে তিনি হারান পাকিস্তানের কৌসারা সানাকে ৪-৩ পয়েন্টে। স্বর্ণসাফল্য কুড়িয়ে নেয়ার পর প্রিয়া বলেন, ‘গতকালের রেজাল্টে আমরা সবাই হতাশ ছিলাম। তাই আজ সোনা জিততে পারব কিনা তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। প্রথম যখন বাংলাদেশ সোনা পায়, তখন মনে হয়েছে আমিও পারব। আমারও সুযোগ আছে। তখন আমার মধ্যে একটা বিশ্বাস জন্মেছিল একটু চেষ্টা করলে পারব। এরপর সবার সমর্থনে বিশেষ করে আমার বাবা-মায়ের দোয়ায় আজ পর্যন্ত আমি এখানে আসতে পেরেছি। স্বর্ণজয়ের ব্যাপারে শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাস ছিলেন সাড়ে তিন বছর ধরে কারাতে খেলা প্রিয়া। ২০১৬ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছিলেন প্রথমবারের মতো। এরপর ২০১৮ আসরে টিম কাতায় স্বর্ণ জেতেন। মজার ব্যাপারÑ গত ৪ নবেম্বর ঢাকায় সাউথ এশিয়ান কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের মানিশ চৌধুরীর কাছে হেরে রুপা জিতেছিলেন প্রিয়া। এবার সেমিতে তাকে ২-১ পয়েন্টে হারিয়েই ফাইনালে ওঠেন প্রিয়া। বাবা মোহাম্মদ নূরুজ্জামান পুলিশের এসআই আর গৃহিণী মা নূরজাহানের সমর্থনে এগিয়ে চলা প্রিয়া ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা করতেন। এ্যাথলেটিক্স, লং জাম্প আর হাইজ্যাম্প খেলতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথমে জাতীয় স্পোর্টস কমপ্লেক্সে যাই। ওখানে ছোটখাটো ক্লাব গেম হয়, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন গেমে অংশগ্রহণ করার পর কোচদের নজরে আসি। এরপর আনসার টিমের হয়ে খেলি। ওখান থেকে আমার ন্যাশনালে ঢোকা। ছোটবেলা টিভিতে মুভি দেখতাম জ্যাকি চ্যানের। আমি তার বিশাল ফ্যান। আর ব্রুসলির নাম নিতেই হবে। ওদের মার্শাল আর্টগুলো দেখে ভাবতাম বাংলাদেশে এসব খেলাধুলা কোথাও আছে কিনা তা খুঁজতাম। জানতাম কোথাও না কোথায়ও আছে। ওই যে কথায় বলে না যে চাইলে আল্লাহ সবকিছু মিলিয়ে দেয়। ঠিক এইভাবেই একটু একটু করে এই পর্যায়ে এসেছি।’ রূপালি পর্দার মারামারি আর বাস্তবের মারামারির মধ্যে অনেক তফাত আছে বলে মনে করেন প্রিয়া, ‘রুপালি পর্দার মারামারি তো শুধু একটা শো। ওখানে কোন ইনজুরি, প্র্যাকটিস, ঘাম ও দিনের পর দিন সাধনা থাকে না। কিন্তু এখানে অনেক শ্রম, অনেক সাধনা। অনেক আত্মবিশ্বাস থাকতে হয়, সবার সাপোর্ট থাকতে হয়।’ যদিও প্রথমদিকে কারাতেতে আসার আগে নিজ পরিবারেরই কোন সমর্থন পাননি প্রিয়া। ‘অনেক বকা শুনেছি। বকা শুনে ওটাকে জেদ হিসেবে নিয়েছি।’ ফেনীর দাগনভুইয়ার মেয়ে প্রিয়া তার জেতা স্বর্ণপদক তার বাবাকে উৎসর্গ করেছেন। হেসে বলেন, ‘আশাকরি দেশের জন্য সোনা জেতার পর থেকে আমার পরিবার আমাকে আর কারাতে খেলতে বাধা দেবে না।’ মঙ্গলবার ফাইনালে খেলার সময় প্রথম রাউন্ডে অনেক কেঁদেছিলেন প্রিয়া, ‘পারব কি না, এটা নিয়ে কেবল ভাবছি। কারণ তখন পর্যন্ত কোন মেয়ের স্বর্ণ আসেনি। স্বর্ণ যখন আসল একমাত্র আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করি। তখন অনেক কেঁদেছিলাম।’ অন্তরার অন্তরে এখন অনেক সুখ তাম্রপদক দিয়ে এসএ গেমসে পদকের হালখাতা খুলেছিল বাংলাদেশ। সোমবার লাল-সবুজদের হয়ে প্রথম পদক জেতেন হুমায়রা আক্তার অন্তরা। কারাতেতে ব্যক্তিগত কাতায় ব্রোঞ্জপদক জেতেন তিনি। এই ইভেন্টে স্বর্ণও জিততে পারতেন তিনি। কিন্তু আয়োজকদের কৌশলের কারণে ব্রোঞ্জ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল তাকে। প্রতিযোগিতায় নামার আগে বাংলাদেশ অনুশীলন করে পুরনো ম্যাটে। কিন্তু খেলা হয় নতুন ম্যাটে। এ জন্য নেকোওয়াশি মুভে গিয়ে পা পিছলে যায় অন্তরার। তাতেই সোনার পদক জয়ের আশা অনেকখানি কমে যায় তার। প্রতিপক্ষের পয়েন্ট বেশি থাকায় ব্রোঞ্জ পান অন্তরা। এ জন্য অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন তিনি। রাতে ঘুমাতে পারেননি ঠিকমতো। তবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, পরের দিন মঙ্গলবারটা অবশ্যই তার জন্য মঙ্গলময় হবে এবং সেটা হয়েছেও। মেয়েদের কারাতের কুমিতে অনুর্ধ-৬১ কেজির ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের আনু গুরংকে ৫-২ পয়েন্টে হারিয়ে সোনার পদক জেতেন অন্তরা। এর আগে সেমিফাইনালে তিনি ৪-০ পয়েন্টে পাকিস্তানের গুল নাজকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে আসেন। পাঁচ বছর ধরে কারাতে খেলা অন্তরা সবসময়ই পরিবারের সমর্থন-সহযোগিতা পেয়েছেন। এটাই তার এসএ গেমসে প্রথম অংশ নেয়া। বাবা ব্যবসায়ী মা গৃ। ঢাকা নিবাসী। জেলা রাজবাড়ী। অন্তরার চার বোন। ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস সুমিও কারাতে খেলেন, সঙ্গে আছেন। এ বছরেই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা ছিল। কিন্তু এসএ গেমসের ক্যাম্প থাকায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু তাতে কোন দুঃখ নেই অন্তরার। বরং দেশের জন্য পদক জেতায় অনেক বেশি খুশি তিনি। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে পড়ার সময়ই এনএসসিতে কারাতে দেখতে আসতেন হুমায়রা। দেখতে দেখতেই খেলার আগ্রহ জন্মে। মঙ্গলবার স্বর্ণজয়ের পর অন্তরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি নিজে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, এটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দেশের পতাকা সবার উঁচুতে উঠেছে, এরচেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে।’ অন্তরা আরও যোগ করেন, ‘কাল আমি কথা দিয়েছিলাম আজ আমি দেশের মান রাখব। সেটা আমি রাখতে পেরেছি। এ জন্য আমি ভীষণ খুশি। তবে গত দুই রাত একদমই ঘুমাতে পারিনি। সারাক্ষণই গেমস নিয়ে ভেবেছি। ক’দিন আগে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সাউথ এশিয়ান কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে এই ইভেন্টে আমি রৌপ্যপদক পেয়েছিলাম। তখন মনোবল একদমই হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই মনোবল ফেরাতে আমার কোচ, সতীর্থ খেলোয়াড়, ফেডারেশন- সবাই অনেক সাহায্য করেছেন। তারা আমাকে বিশ্বাস জুগিয়েছেন। আমি তাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পেরেছি। আমার এই সাফল্যের নেপথ্য রূপকার তারাই।’ সোমবার গ্যালারিতে তেমন দর্শক সমর্থন না পেলেও মঙ্গলবার অনেক সমর্থন পেয়েছেন অন্তরা। এটা তাকে অনেক উজ্জীবিত করেছে। অন্তরার চাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে যেন কারাতেকাদের জন্য নিজস্ব বা আলাদা একটি কারাতে কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়, যাতে ওখানে তারা ভালমতো অনুশীলন করে নিজেদের শাণিত করে আরও আন্তর্জাতিক স্বর্ণ দেশের জন্য নিয়ে আসতে পারেন। সবশেষে অন্তরা বলেন, ‘আজ খেলতে নামার আগে মনে জিদ এবং স্নায়ুচাপ- দুই অনুভূতিই কাজ করছিল। সবসময়ই মনে হচ্ছিল আমার জন্য দেশের পতাকা যেন নিচু না হয়, সবসময়ই যেন সবার চেয়ে উঁচুতে থাকে।’
×