ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হিল্লা বিয়ের ফতোয়া মেনে নেননি এক সাহসী নারী

প্রকাশিত: ১১:৩০, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯

হিল্লা বিয়ের ফতোয়া মেনে নেননি এক সাহসী নারী

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ গ্রামের সমাজপতি ও ফতোয়াবাজদের ‘কথিত হিল্লা বিয়ের’ বিরুদ্ধে একদিন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন গৃহবধূ পারভীন বানু। সে সময় সমাজের চাপে তার স্বামীও নিরব ছিলেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারপর এক বছর বয়সী মেয়ে শিশু মিনা আক্তার মিতুকে নিয়ে পারভীন বাবার বাড়ি চলে যান। এদিকে এ ঘটনার বিশ বছর পর চলতি বছর-মেয়ে কথিত ফতোয়ার বিষয় উড়িয়ে দিয়ে পিতৃত্বের অধিকার আদায় করে নিল। এই ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়া সদর উপজেলার এরুলিয়া গ্রামে। সম্প্রতি তখন ১৯৯৮ সাল। এই গ্রামের মিন্টু সোনারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল একই গ্রামের পারভীন বানুর। এক বছর পর তাদের ঘরে জন্ম নেয় মেয়ে শিশু। নাম রাখা হয় মিনা আক্তার মিতু। একদিন দাম্পত্য কলহে স্ত্রীকে ‘তালাক’ উচ্চারণ করেন মিন্টু। পাশের বাড়ির লোকজন তা শুনে গ্রাম্য মাতবরদের জানায়। দাম্পত্য কলহ ছিল ক্ষণিকের। মান অভিমান দূর হয়ে যায় দ্রুত। তারপরও মাতবর ও মুন্সি মৌলবিদের ফতোয়ার হুঙ্কার-পারভিন বানুর হিল্লা বিয়ে না হলে সংসার করা হবে না। সমাজচ্যুত করা হবে। দরকার হলে গ্রাম ছাড়া করা হবে। মিন্টু সোনার সমাজপতিদের ভয়ে নিরব থাকেন। তার নিরবতাকে কাপুরুষচিত মনে করে পারভীন বানু ফতোয়াবাজদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়-কিসের ফতোয়া! রাগের মাথায় স্বামী তালাক উচ্চারণ করলেই তা কার্যকর হয়ে যায় না। তালাকের আইনগত প্রক্রিয়া আছে। আর হিল্লা বিয়ে অপরাধ। পারভীন বানুর এই প্রতিবাদ কোন কাজে আসে না। গ্রামের লোকজনও তার পাশে দাঁড়ায় না। পারভীন বানু ওইদিনই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে চলে যায়। পিতার স্নেœহ বঞ্চিত হয়ে মিতু বেড়ে ওঠে মায়ের মমতা এবং নানা আশরাফ ম-ল ও নানী রাহেলা বেগমের আদরে। পারভীন বানু হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে মেয়েকে লেখাপড়া শেখায়। মিতু এরুলিয়া হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও জাহেদুর রহমান মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়। সেবার ব্রত নিয়ে সে এ বছর বগুড়া টিএমএসএস মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব রিসার্স এ্যান্ড টেকনোলজিতে নার্সিং ডিপ্লোমা ১ম বর্ষে ভর্তি হয়। তারপর লেখাপড়ার খরচ নিয়ে ভাবনায় পড়ে মেয়ে ও মা। ওদিকে স্বামী মন্টু সোনার খোঁজখবর রাখেনি স্ত্রী ও মেয়ের। উল্টো সে আরেকটি বিয়ে করে। মিতু একদিন টিএমএসএসের বিভিন্ন কার্যক্রম অবগত হয়। সহযোগিতা চেয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানায়। টিএমএসএসের মানবাধিকার বিভাগ এগিয়ে আসে। বৈঠকের আয়োজন করে। সালিশের মধ্যস্থতায় পিতা মিন্টু সোনার তার মেয়ে মিনা আক্তার মিতুর শিক্ষার ব্যয়বহনের অঙ্গীকার এবং মেয়ের অধিকার ফিরিয়ে দেন। বললেন বুকের ভেতরের জমে থাকা বেদনা দূর হলো। বাবা ও মেয়ের মিলনের সাক্ষী হলেন মিতুর চাচা, নিকট আত্মীয়, টিএমএসএস’র পরামর্শক ও সাবেক যুগ্ম-সচিব নাজমুল হক, পরিচালক আব্দুস সালাম, জনসংযোগ কর্মকর্তা রায়হান আহমেদ রানা, সহকারী জোনাল ম্যানেজার শাহানা আফরোজ। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ড. হোসনে আরা বেগম বললেন, সমাজের সকল কুসংস্কার দূর করে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম লক্ষ্য। মিনা আক্তার মিতুর প্রতি সকল সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে এবং শিক্ষা শেষে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।
×