ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধার সনদ ছিঁড়েও বহাল ডাক্তার, মানসিক কষ্টে একাত্তরের বীর

প্রকাশিত: ১১:২৫, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯

মুক্তিযোদ্ধার সনদ ছিঁড়েও বহাল ডাক্তার, মানসিক কষ্টে একাত্তরের বীর

মোরসালিন মিজান ॥ একজন মুক্তিযোদ্ধার সনদ ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে! যে বীরদের প্রাণপণ লড়াইয়ে দেশ পাওয়া, সে দেশেরই একজন চিকিৎসক দেখাচ্ছেন এমন ধৃষ্টতা। হ্যাঁ, এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকার। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা ইস্যুতে কিছু দায় তারা বোধ করছেন। কিন্তু একাত্তরে পরাজিতদের যে আদর্শ, তাও তো একেবারে মাঠে মারা যায়নি। সুযোগ পেলেই ফুঁসে উঠছে অপশক্তি। আরেকটি অংশ ইতিহাসের গভীরে যেতে নারাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে উদাসীন। তৃণমূলের মুক্তিযোদ্ধারা তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃত সম্মান পান না। বরং নানাভাবে হেন্তার শিকার হন। তবে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার চোখের সামনে তাঁর সনদ ছিঁড়ে ফেলার মতো ঔদ্ধত্য এর আগে কেউ দেখিয়েছেন বলে জানা যায় না। ঘটনাটি টাঙ্গাইলের। মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার অবদান কত তা ইতিহাস সচেতনদের অজানা নয়। অথচ এখানেই ঘটানো হলো ন্যক্কারজনক ঘটনা। অভিযুক্ত চিকিৎসকের নাম মোঃ শহীদুল্লাহ। শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক। একইসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পদক। ক্ষমতাধর চিকিসক নেতার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে এ ঘটনায় সারাদেশে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। চলছে প্রতিবাদ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার মহেলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শাজাহান ভূঁইয়া। কোমড়ের হাড়ে চিড় ধরায় গত ১৭ নবেম্বর শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। হাসপাতালে নিয়ম মেনে নিজের মুক্তিযোদ্ধা সনদের একটি ফটোকপি কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেন তিনি। এর ফলে বিরাট কোন সুবিধা তাঁকে দেয়া হচ্ছিল, এমন নয়। কিন্তু সীমিত সাধ্যের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারী হাসপাতালের কাছেই কিছু আশা করতে হয়। তাই করেছিলেন শাজাহান ভূঁইয়া। তাঁর সে আশায় গুঁড়েবালি! গত ২১ নবেম্বর ওয়ার্ড পরিদর্শনে এসে রোগীর ফাইলে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখে বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মোঃ শহীদুল্লাহ। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সনদ ছিঁড়ে শূন্যে উড়িয়ে দেন তিনি। সেদিনের ঘটনা জানতে সোমবার ঢাকা থেকে ফোনে যোগাযোগ করা হয় একাত্তরের বীরের সঙ্গে। এখনও হাসপাতালে তিনি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই কথা বলছিলেন। গলার আওয়াজ শুনে অনুমান করা যাচ্ছিল, শরীর ভাল নেই। মনও ভেঙ্গে গেছে। জনকণ্ঠকে শাজাহান ভূঁইয়া বলেন, ঘটনার দিন চিকিৎসক শহীদুল্লাহ এসে নার্সদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, এই কাগজ দিয়ে কী হবে? এটা এখানে কেন? কাগজ কি চিকিসা করবে? নাকি ডাক্তার? কথা বলতে বলতেই একটি কাগজ ফাইল থেকে বের করে ছিঁড়ে ফেলে দেন তিনি। বেদনায় ডুবে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ডাক্তারের কাছে যেটা কাগজ সেটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। আর তো কিছু নেই। এটা নিয়েই গর্ব করি আমি। ঘটনার সময় একটু দূরে ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে তাই বুঝতেই পারিনি যে, আমার যেটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি গর্ব, সেই সনদ ছিঁড়ে ফেললেছেন ডাক্তার! এত বড় অন্যায় কেউ করতে পারে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানতে চান তিনি। ঘটনাটি যে চিকিৎসক হঠাৎ রাগের মাথায় ঘটিয়ে ফেলেছেনÑ এমন নয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তার যে অশ্রদ্ধা তা আগের দিনও প্রকাশিত হয়েছে। শাজাহান ভূঁইয়া জানান, আগের দিন মুক্তিযোদ্ধা জেনেও তাঁর প্রতি একইরকম অশ্রদ্ধা দেখান ওই চিকিৎসক। শাজাহান ভূঁইয়া বলেন, আমার এখন বয়স ৭০ ছাড়িয়েছে। ডাক্তার আমার ছেলের বয়সী হবেন। অথচ প্রথম দিন দেখতে এসে আমাকে তিনি অবলিলায় ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেন। আমি তখন কিছু মনে করিনি। কিন্তু সনদ ছিঁড়ে ফেরার পর মনে হয়েছে, তিনি ভাল মানুষ নন। দেশকে ভালবাসেন না। আমাকে এমন অমর্যাদা আগে কেউ করেননি...। কথা শেষ করতে পারেন না মুক্তিযোদ্ধা। কান্নায় তার কণ্ঠ বন্ধ হয়ে আসে আসে। ঘটনার সময় সামনেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার ছোট ছেলে কবির ভূঁইয়া। তিনি বলেন, আমি সনদের ছেঁড়া টুকরো মেঝে থেকে কুড়িয়ে এনেছিলাম সেদিন। বাবার এই অপমান সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই কারও পায়ের নিচে পড়ার আগে টুকরোগুলো কুড়িয়ে এনেছিলাম। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখলে কেউ সম্মান দেখায়। কেউ দেখায় না। কিন্তু কেউ এভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে, সনদ ছিঁড়ে ফেলতে পারে তা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। মোঃ শাজাহান ভূঁইয়া জানান, বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তিনি। একাত্তরে যুদ্ধে যাওয়া তাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অগত্যা বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে যুদ্ধে যান তিনি। ১১ নম্বর সেক্টরে ড. আব্দুর রাজ্জাকের (বর্তমানে মন্ত্রী) অধীনে যুদ্ধ করেন। ভাবেননি আর জীবিত ফিরবেন। কিন্তু ফিরেছিলেন। গাজীর বেশে ফিরলেও, এখন অপমানিত হতে হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে মানসিক পীড়া যোগ হওয়ায় তার সার্বিক অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। জানা যায়, ঘটনার পর তীব্র প্রতিবাদের মুখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। নির্ধারিত সময় পার হলেও, চিকিৎসক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে কোন প্রতিবেদন দিতে পারেনি কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধার একটি স্বাক্ষর নিয়ে গেছে। এর পর আর তারা কিছু জানায়নি বলে জানা যায়। ফলে অভিযুক্ত চিকিৎসক আছেন বহাল তবিয়তেই। তবে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি ডাঃ শহীদুল্লাহকে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে হেনস্তা করার ঘটনায় প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। টাঙ্গাইল থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, মঙ্গলবারও শহরের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রতিবাদী মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। টাঙ্গাইল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সন্তান কমান্ড আয়োজিত মানববন্ধন থেকে অভিযুক্ত চিকিৎসকে রাজাকারের প্রজন্ম আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানান আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি বিপ্লব। এদিকে ঘটনার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাকে হাসপাতালে দেখতে যান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। এ সময় চিকিৎসক শহীদুল্লাহর চিকিৎসা সনদ বাতিল করে তাকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান তিনি। রাজধানী ঢাকায়ও চলছে প্রতিবাদ। বিবৃতি দিয়ে চিকিৎসকের সনদ বাতিলের দাবি জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সংগঠন আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। একই দাবিতে আন্দোলন করছে ঠাকুরগাঁসহ কয়েকটি জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ঢাকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এ ঘটনাকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। যে চিকিৎসক এমন অন্যায় অসভ্যতা দেখাতে পারেন তাকে, আমি তো মনে করি, প্রহার করা উচিত। এখনও ঘটনার বিচার হয়নি জেনে তিনি বলেন, এমনটি হলে তো অন্যরাও সাহস পাবে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেবে। আর সরকারের চাকরি করা কোন লোক মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করবেন, এটা হতে পারে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×