ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্র রাজনীতি থাকার পক্ষে সাবেক নেতারা

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯

 ছাত্র রাজনীতি থাকার পক্ষে সাবেক নেতারা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা সমাধান নয় বরং জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্র রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে আনতে হবে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না। সেই সঙ্গে দলের সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখতে পারলে দেশের ছাত্র রাজনীতি অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বক্তারা। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য দেশে ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে বলে জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ সাবেক ছাত্র নেতারা। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদাদের সভাপতিত্বে সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় এ সময় বক্তব্য রাখেন জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, ডাকসুর বর্তমান ভিপি নুরুল হক নূরসহ অন্যরা। ‘বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন সুজনের সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার শর্মা। মূল প্রবন্ধে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপকভাবে প্রচারের কাজটি করেছে ছাত্ররা। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগেই। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অতীত ইতিহাস অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ হলেও সেই ঐতিহ্য ছাত্রসমাজ হারাতে বসেছে। দুর্ভাগ্যবশত তারুণ্যে সেই আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীনতা, সাহসিকতা, লড়াকু ঐতিহ্য ইত্যাদি আজ যেন শুধু অতীতের সুখ স্মৃতির বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই এদেশের ছাত্র-তরুণদের একটি বড় অংশ নৈতিক অবক্ষয়ের গ্রাসে পরিণত হচ্ছে। অনেকাংশে ছাত্র রাজনীতি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, কমিটি বাণিজ্য ইত্যাদির সমার্থক। তিনি বলেন, মূলত বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতির প্রভাবে আমাদের ছাত্র রাজনীতি আজ আর ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে পরিচালিত হয় না। এটি পরিচালিত হয় রাজনৈতিক দলের স্বার্থে। ছাত্র রাজনীতি নষ্টের জন্য শিক্ষক রাজনীতিও কম দায়ী নয় জানান তিনি। তিনি বলেন, আমরা চাই, ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের কল্যাণে ব্যবহার হোক, কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য যেন ব্যবহার না হয়। ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক প্রধান কিভাবে রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পারে সে নিয়ে প্রশ্ন রাখেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, একটি ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক প্রধান কিভাবে রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পারে? এটা আমার মাথায় আসে না। দলের সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে পারলে এ দেশের ছাত্র রাজনীতি এগিয়ে যাবে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য দেশে ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে উল্লেখ করে আ স ম আবদুর রব বলেন, বর্তমান সরকার নিজেদের পাপ আড়াল করতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছে। যাতে ছাত্ররা কথা বলতে না পারে। কিন্তু তাদের কথা বলতে হবে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য দেশে ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই এ দেশে স্বাধীনতা এসেছিল। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ছাত্র রাজনীতিতে এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে। কিন্তু সব কিছু অন্ধকারে হারিয়ে যায়নি। তাহলে গণজাগরণ মঞ্চ, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের আন্দোলন থেকে শুরু করে হালের আবরার হত্যার বিচারের আন্দোলন হতো না। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি সব সময়ই নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সেখানে কিভাবে আবরার হত্যাকা- হলো? এটা ছাত্র রাজনীতি না থাকার কারণে হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না। অবারিত করে দেয়া দরকার। ডাকসুর সাবেক ভিপি-জিএসদের আহ্বান জানিয়ে সেলিম বলেন, আমি একটি আহ্বান জানাতে চাই। ডাকসুর সাবেক ভিপি-জিএসদের এক প্লাটফর্মে আনতে চাই। কাউন্সিল অব এক্স ভিপি-জিএস অব ডাকসু নামে। এই আমরাই নতুনদের সামনের দিকে পথ দেখাতে পারব সেখান থেকে। ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ছাত্র রাজনীতি মানে জাতীয় রাজনীতির বড় জায়গা। সত্যের পক্ষে তারুণ্যকে সব সময় থাকতে হবে। সঠিক কথা বলতে হবে। খালেদা জিয়াকে যেভাবে জেলে রাখা হয়েছে, তা অন্যায়। দেশে একটা অনাচার চলছে। দেশ আজ গভীর সঙ্কটে। এর বিরুদ্ধে কি কথা বলা যাবে না? কথা বলতে হবে। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, ছাত্র রাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করতে হবে। বর্তমানে জাতীয় রাজনীতি লুটেরাদের হাতে চলে গেছে। এ অবস্থা থেকে দূর করতে ঐক্য প্রয়োজন রয়েছে। আমানউল্লাহ আমান বলেন, দেশে বর্তমানে ঐতিহাসিক পরিবর্তন প্রয়োজন। ডাকসুর বর্তমান ভিপি নুরুল হক নূরকে বলব, তুমি নেতৃত্ব দাও। এ দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাবেক ছাত্র নেতারা তোমাদের পাশে আছে। দেশ, মানুষ, গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ফিরিয়ে এনে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। ডাকসুর বর্তমান ভিপি নুরুল হক নূর বলেন, নব্বইয়ের পর এ দেশে ছাত্র রাজনীতিতে কিচ্ছু হয়নি, শুধু দলীয় লেজুড়বৃত্তি ছাড়া। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে ছাত্রলীগ লাগামহীন হয়ে পড়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে হয়ত ছাত্রদলও এমন লাগামহীন হয়ে পড়ত। রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ছাত্র রাজনীতির দুটি ধারা আছে একটি নীতিহীন ধারা আর একটি হচ্ছে আদর্শিক ধারা। আর বাইরে আরেকটি সাধারণ ছাত্রদের বড় অংশ রাজনীতি বিমুখ। তবে তারা বিভিন্ন সমিতি, পাঠচক্র এসবের মাধ্যমে সংগঠিত হচ্ছে যেটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। নীতিহীন ধারাকে আমাদের না বলতে হবে আর নীতিনিষ্ঠ শক্তিকে সামনে আনতে হবে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা লাঠিয়াল রাজনীতি চাই না। বিদ্যমান আইন অনুযায়ীই লেজুড়বৃত্তির ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক রাজনীতি বেআইনী। এই লাঠিয়াল বাহিনী ছাত্র রাজনীতির নামে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপকর্মের যে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে, তা ফৌজদারি অপরাধ। তবে সব নাগরিকের রাজনীতি করার অধিকার আছে। আমরা কারও এই অধিকার খর্ব হোক সেটা চাই না। সভাপতির বক্তব্যে সুজনের নির্বাহী সদস্য ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেলে, ছাত্র রাজনীতি এই কলুষতা থেকে মুক্তি পাবে। ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে, দুর্বৃত্তায়নের অপরাজনীতি ঠেকাতে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান সাবেক ছাত্র নেতারা। বক্তারা আরও বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নামের অযোগ্যরাই শিক্ষকতা করছে বলেও মন্তব্য করেন। গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন- ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত ও আবু সাঈদ খান, এ এন রাশেদা প্রমুখ।
×