ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্তে রেল চলাচল শুরু আগামী জুলাইয়ে

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯

 চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্তে রেল  চলাচল শুরু আগামী জুলাইয়ে

তাহমিন হক ববী, চিলাহাটি থেকে ফিরে ॥ দুই পড়শির দেশ। এপার বাংলা, ওপার বাংলা। দুই বাংলারই উত্তরবঙ্গের সীমান্ত ভারতের কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ি এবং বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার চিলাহাটি। দুই দেশের সীমান্তপথের মধ্যে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্রডগেজ রেল সংযোগের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এই রেলপথ চালু হলে এখন যেমন খুলনা-কলকাতা বা কলকাতা-ঢাকা রেল যোগাযোগ রয়েছে, এটিও তেমনি একটি রেল যোগাযোগ হবে। ভারত-বাংলাদেশের পাশাপাশি মংলাবন্দর হতে নেপাল ও ভুটানসহ চারটি দেশ এই রেলপথ দিয়ে মালামাল পরিবহনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হলে জুলাই মাসে এই পথে দুই বাংলার উত্তরবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে সরাসরি ট্রেন চালু হবে। উত্তরবঙ্গের চিলাহাটি সীমান্ত (হলদিবাড়ি) থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় চার শ’ ৫৪ কিলোমিটার। ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ রেলওয়ে চিলাহাটি থেকে সীমান্ত পর্যন্ত ৬ দশমিক ৭২৪ কিলোমিটার ও ২ দশমিক ৬৩৬ কিলোমিটার লুপ লাইনসহ ৯ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। অন্যদিকে, ডাঙ্গাপাড়া সীমান্ত হতে হলদিবাড়ি রেলস্টেশন পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার সীমান্ত রেলপথ ও লুপ লাইন ৩ কিলোমিটারসহ ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপন করছে ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। হলদিবাড়ি অংশের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। অপরদিকে চিলাহাটি অংশের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে । সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশের দিকেও কাজ অনেক এগিয়েছে ... এবং ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যেই এই রুটে রেল চলাচলের স্বপ্ন পূরণ হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় মাসের প্রথম দিন সরেজমিনে গেলে দেখা যায় হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রেলপথ পুনরায় স্থাপনে কাজ শুরু হবার পর হতে চিলাহাটি ও হলদিবাড়ি এলাকা এখন গমগম করছে। মানুষজনের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। যাত্রীবাহী ও মালগাড়ি ট্রেন চালু হলে এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হবার আলো ফুটে উঠেছে তা একনজর তাকালেই বোঝা যায়। সেখানে ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলছে ব্যবসার স্থান। রেলসূত্র মতে, চিলাহাটি হতে হলদিবাড়ি সীমান্ত পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের পথটির মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। চিলাহাটি রেলস্টেশনের পূর্বপাশে যে লুপ লাইন স্থাপন করা হবে সেখানে মাটি ভরাটের কাজ শেষের পথে। বাংলাদেশ অংশের সীমান্ত পর্যন্ত ৬ দশমিক ৭২৪ কিলোমিটার রেলপথে ৭টি ছোট ছোট ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। ব্রিজগুলো নির্মাণে সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই ব্রিজ সাতটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাবে। এর পর বসানো হবে ব্রডগেজ লাইন। এই পথে দুটি লেভের ক্রসিং গেট করা হয়েছে। দেখা গেল যে লাইন স্থাপন করা হবে সেই রেললাইনগুলো ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করে চিলাহাটিতে নিয়ে আসা হয়েছে। লাইন স্থাপনে বিশেষ ধরনের স্লিপার তৈরি করা হচ্ছে দেশের পঞ্চগড়ে। সেই স্লিপারগুলো জানুয়ারি মাসেই চিলাহাটি পৌঁছে যাবে। প্রকল্প এলাকায় কর্মরত রেলওয়ের পূর্ত বিভাগের উর্ধতন উপসহকারী প্রকৌশলী তহিদুল ইসলাম বলেন, এই কাজে আমদানিকৃত সকল মাল চিলাহাটি চলে এসেছে। আমরা এখন চিন্তামুক্ত। সেই কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারব। তিনি বলেন, এই কাজের সঙ্গে আরও সংযুক্ত রয়েছে কালার লাইট সিগন্যালিংসহ টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম প্রবর্তন। এ ছাড়া এ্যাপ্রোচ রোড এক হাজার এক শ’ বর্গমিটার, দ্বিতল ভবন রেস্ট হাউজ। অন্যান্য স্থাপনের মধ্যে রয়েছে ইমিগ্রেশন ও কাস্টম হাউজ বিল্ডিং,এ্যাটেনডেন্ট ব্যারাক, মেশিন রুম ও টি এক্স আর অফিস। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ কোটি ১৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। যা প্যাকেজ মূল্যে প্রকল্পটির কাজ চলছে ৬৮ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ করছে ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল। তিনি জানান, এলাকার মানুষজনের সহযোগিতায় এই কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এতে আমরা ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি। এলাকাবাসীর মধ্যে নাজমুল হাসান জোনা, তোফাজ্জল হক মঞ্জু জানায়, এক সময় কলকাতা থেকে দার্জিলিংগামী অনেক ট্রেন এই রুটে চলত। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এই রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পুরনো সেই দিনের কথা মনে রাখতে এবং দ্বিপাক্ষিক স¤পর্ক আরও উন্নত করতে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে বদ্ধপরিকর হয়ে এই রুটে রেল যোগাযোগ চালু করছে, এটি আমাদের পরম সৌভাগ্য। তারা মনে করেন এই রেলপথ শুরু হলে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল এবং ভুটানের বাণিজ্য বাড়বে। তাদের মতে সব থেকে সুখবর ভ্রমণপিপাসু বাঙালীর জন্য। কারণ অনেক সহজেই পৌঁছা যাবে শিলিগুড়ি। ঢাকা-নীলফামারী-চিলাহাটি হয়ে যদি যাত্রীবাহী ট্রেন চলে তাহলে ে দখা যাবে ট্রেনের টিকেট পেতে ভ্রমণ পিপাসুদের ভিড় বাড়বে। বর্তমানে ঢাকা-কলকাতা,খুলনা-কলকাতা রুটে যে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে তার চেয়েও এই রুটে যাত্রী বেশি থাকবে বলে তারা মন্তব্য করেন। ভারতের অংশের কাজের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় রেলের এক কর্মকর্তা বলছেন, হলদিবাড়ি থেকে বর্ডারের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ শেষ করে আমরা পরীক্ষামূলকভাবে সীমান্ত পর্যন্ত রেল চালিয়েছি। তিনি জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে প্রায় ৪২ কোটি ইন্ডিয়ান রুপী খরচ করে হলদিবাড়ি স্টেশনে দুটি নতুন প্লাটফর্ম, টিকেট কাউন্টার, প্রতিক্ষালয় এবং রেল কর্মচারীদের জন্য অফিস তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হলদিবাড়িকে একটি আন্তর্জাতিকমানের স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। তার মতে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কাজ অনেক এগিয়ে গেছে। এই রুটে রেল চলাচলের স্বপ্ন পূরণ হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এই রেলপথের বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তির ভিত্তিতে ভারতীয় অংশে কাজ শুরু হলেও, একটু দেরিতে শুরু হয় বাংলাদেশ অংশের কাজ। চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর এই কাজের উদ্বোধন করেছিলেন রেলপথমন্ত্রী এ্যাডভোকেট নুরুল হক সুজন। উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাস বলেছিলেন, এক সময় দার্জিলিং মেইল শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে আসা রেল রানাঘাট, ভেড়ামারা, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, সান্তাহার, হিলি, পার্বতীপুর, নীলফামারী, চিলাহাটি, ভারতের হলদিবাড়ি, জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়িতে চলাচল করত। সেটার আদলেই এই পথে আবারও দুই দেশের মধ্যে রেল চালু হবে। এর ফলে কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা একটি রেল বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রবেশ করে খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে আবার ভারতে প্রবেশ করে গন্তব্যে পৌঁছবে। এভাবে যাতায়াতের ফলে ভারতের রেলে যাত্রাপথ অন্তত ২০০ কিলোমিটার কমে যাবে। বর্তমানে শিয়ালদহ থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব ৫৩৭ কিলোমিটার। ২০২০ সালের জুলাই মাস নাগাদ এই পথে রেল যোগাযোগ চালু করতে চায় দুই দেশের সরকার। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এই রেলপথ চালু হলে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের রেলওয়ে সূত্র মতে, রেলপথটি বাংলাদেশ ও ভারত, উভয় দেশের রেলই ব্যবহার করবে। ভারতের রেল যেমন এই পথ ব্যবহার করে শিলিগুড়ি যাবে, তেমনি বাংলাদেশের রেলও পথটি ব্যবহার করে শিলিগুড়ি থেকে পণ্য আনা-নেয়া করতে পারবে। যেভাবে এখন খুলনা-কলকাতা বা কলকাতা-ঢাকা রেল যোগাযোগ রয়েছে, এটিও তেমন একটি রেল যোগাযোগ হবে। পাশাপাশি নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশের মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলরুটে মালামাল পরিবহন করতে চায়। এখন সেটা সড়কপথে করতে হচ্ছে, যার খরচও বেশি। কিন্তু এই রেলপথটি চালু হলে শিলিগুড়ির সঙ্গে যুক্ত হবে, আমাদের রেলপথটি ব্যবহার করে শিলিগুড়ি যেতে পারবে। ফলে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও এই পথে আমদানি-রফতানি করা যাবে। শিলিগুড়ির সেখানকার আশপাশের এলাকায় সংযোগ তৈরি হবে, যেখান থেকে পাথরসহ অনেক দ্রব্য বাংলাদেশে আমদানি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। রেলপথের কারণে আমাদেরও অনেক সুযোগ তৈরি হবে। ফলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল চলাচলে তারা যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি ভারতের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ির সঙ্গে রেল যোগাযোগ তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন সুযোগ তৈরি হবে। তবে রেলের একটি সূত্র বলছে কোন্ প্রক্রিয়ায়, কী রেল চলাচল করবে, সেটা চূড়ান্ত হবে আরও আলোচনার পরে। আপাতত পণ্যবাহী রেল যোগাযোগের বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক শহিদুল ইসলাম বলছেন, ভারতীয় রেল ও বাংলাদেশের রেলের মধ্যে কি ধরনের ট্রাফিক হবে, সেটা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে এই নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। অর্থাৎ জুলাই মাস থেকে রেল চলাচল শুরু করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
×