ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

সম্প্রীতির বাংলাদেশে জায়গা নেই চরমপন্থীদের

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯

সম্প্রীতির বাংলাদেশে জায়গা নেই চরমপন্থীদের

সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যরে অবিস্মরণীয় মর্যাদায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বসভায়। তার গ্রহণযোগ্যতাকে আবারও নতুনভাবে তুলে ধরল। মানবিক মূল্যবোধ আর মানুষের প্রতি যে অকৃত্রিম মমত্ববোধ দেশের ভাবমূর্তিকে সমুজ্জ্বল করে, সেখানে আঁচড় বসালেও তার দায়ও নিতে হয় সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্ত অপশক্তিকে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে যে দেশাত্মবোধের আদর্শিক চেতনা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে অনমনীয় অন্তর্নিহিত শক্তি, তাকে সহজেই বিধ্বস্ত করে দেয়া কতটা অসম্ভব তেমন মনোবল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক অনির্বাণ দীপ্তির আসনে। রাষ্ট্রযন্ত্রের আইন-কানুন বিচারিক প্রক্রিয়া তেমন আলোকিত ভুবনের অপার সম্ভাবনা। সমাজে সক্রিয় অপশক্তি প্রতিনিয়তই অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত ও সুযোগ সন্ধানী। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর অভিজাত রেস্তরাঁ হলি আর্টিজানে কতিপয় দুর্ধর্ষ জঙ্গী উন্মত্ত হিংস্রতায় যে পাশবিক ঘটনার অবতারণা করে, তা আজও এক মানবিক বিপর্যয়ের চরম নৃশংসতা। এমন সশস্ত্র আর অমানবিক ঘটনায় নিহত হয় ২৯ জন। ১৭ বিদেশীসহ ৩ বাংলাদেশী, ২ পুলিশ কর্মকর্তা এবং ২ রেস্তরাঁ কর্মী জঘন্যভাবে খুন হয়। পরবর্তীতে পুলিশের সশস্ত্র অভিযানে ৫ জঙ্গীও ঘটনাস্থলে মারা যায়। পবিত্র রমজান মাসের এবাদত বন্দেগীর ধর্মীয় শুদ্ধ চেতনার মধ্যেই এমন অধর্ম আর জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে সচকিত হয়ে ওঠে। কারণ হামলাকারীরা ধর্মীয় মৌলবাদের উগ্র চেতনায় যে বিভীষিকার তা-ব চালায়, যা মানুষের জন্য যে ধর্ম, তাতে তার কোন যথার্থতা খুঁজে পাওয়া আসলেই দুরূহ। ধর্ম ব্যক্তিক আর আত্মিক, যা শুদ্ধ বোধে যে কোন মানুষের জীবনকে সুন্দর আর সাবলীল করে তোলে। যেখানে ধ্বংস, সশস্ত্র হামলা কিংবা অসহায় মানুষের প্রাণসংহার একেবারে চিন্তারও অতীত। ইসলাম রমজান মাসের ইহ ও পারলৌকিক তাৎপর্যকে সমধিক বিবেচনায় রেখে যে মাত্রায় তার অনুসারীদের উদ্দীপ্ত করে, সেখানে কোনভাবেই এহেন সহিংস, সাংঘর্ষিক উন্মাদনার বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। প্রত্যেক মানুষ তার কৃতকর্মের জবাব দেবে। প্রত্যেক ধর্মেই বিধি অনুযায়ী নিজস্ব বিধান দেয়া থাকে, যা কোন মানুষকে পাপ-পুণ্য সম্পর্কে সাবধানও করে দেয়। সেখানে অন্য কারোর অযাচিত হস্তক্ষেপ কিংবা লোমহর্ষক নৃশংস কর্মযজ্ঞ কোনভাবেই অনুমোদন করা হয় না। তারপরেও সারা বিশ্বে যে মাত্রায় ধর্মীয় উন্মাদনায় শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠছে, তা বিভিন্ন আইনানুগ প্রক্রিয়ায় থামানো অত্যন্ত জরুরী এবং আবশ্যক। বাংলাদেশ তেমন অবস্থানে আজ বিশ্বসভার সুনজরে। কারণ ১ জুলাই হলি আর্টিজানের নৃশংস প্রাণ সংহারে যে তান্ডব শুরু হয়েছিল, তাতে দুনিয়ার কতিপয় দেশ বাংলাদেশকে অনিরাপদ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করতেও কসুর করেনি। যে কারণে অনেক বিদেশী দূতাবাসের মূল কার্যালয় ঢাকার বদলে দিল্লীতে, সিঙ্গাপুরে অথবা অন্য কোন জায়গায়। সেদিন দেশের সমুন্নত সম্প্রীতি আর মর্যাদায় যে আঘাত এসেছিল, তাকে অত্যন্ত সাবলীলতায় শেখ হাসিনার সরকার মোকাবেলা করেছে। অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ মুহূর্তের সহিংস উন্মত্ততায় যে বীভৎসতা তৈরি করে, তা যেমন শান্তি-শৃঙ্খলার বিপর্যয়, পাশাপাশি দেশের সম্মান ও ঐতিহ্যেরও পরিপন্থী। আর নিরীহ অসহায় সাধারণ জনগোষ্ঠী থাকে ভীত, সন্ত্রস্ত এবং উদ্বিগ্ন অবস্থায়। সারাদেশে সাড়া জাগানো এমন সভ্যতা বিবর্জিত অরাজকতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাৎক্ষণিক অভিযানে পদক্ষেপ নিতে দেরি করেনি। ফলে দুপক্ষের মধ্যেই সশস্ত্র হামলা চললে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাও ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর এদিকে ভেতরে চলে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। জঙ্গীদের এলোপাতাড়ি বীভৎসতায় ভেতরের অসহায় মানুষগুলো যন্ত্রণায়, নৃশংসতায় ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে থাকে। আর হলি আর্টিজান সাক্ষী হয়ে থাকল এক নারকীয় ঘটনার অবর্ণনীয় হত্যাযজ্ঞের। শুধু পুলিশী সশস্ত্র অভিযানেই এমন ঘটনাকে সামলানো যায়নি। পরের দিন ২ জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সফল কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গী মৃত্যুবরণ করলে এমন ভয়ঙ্কর, আতঙ্কিত, নৃশংসতার যবনিকাপাত হলেও পরের চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ এবং নিষ্ঠুরতার চরম নিদর্শন। শ্বাসরুদ্ধকর এমন জঘন্য হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সেনা কমান্ডোদের দুঃসাহসিক অভিযান সেদিনের বিভীষিকাময় অধ্যায়কে শেষ করতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। ভেতরের ঘটনা ছিল তখন অবধি এক অজানা শঙ্কিত মোড়কের আড়ালে। আরও ভয়াবহ রক্তাক্ত পরিস্থিতির বীভৎস তান্ডবের দ্বার উন্মোচন। শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পশুবৃত্তির এমন নির্মমতা। হত্যা নিশ্চিত করতে আরও যা করা হয় তা ছিল নিষ্পাপ দেহগুলোর ওপর পুনরায় সাঁড়াশি আক্রমণ। পরে জানা যায় তারা নির্বিকার, নিরুদ্বেগে সেহরির খাবারও নাকি ঠান্ডা মাথায় খাওয়ার জঘন্য মানসিকতার পরিচয় দিতে মোটেও ভাবেনি। র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ উন্মত্ত জঙ্গীদের সহিংসতা পরিহার করে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার আবেদন জানালে তাও এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে সম্মুখ সমরে জঙ্গীদের পরাভূত করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। প্রায় ৩ বছর ৫ মাসের মধ্যে এমন জঘন্য পশুবৃত্তির ঘটনাকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় এনে রায় ঘোষণা আইন ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা এবং গ্রহণযোগ্যতার অনবদ্য দলিল। সাময়িকভাবে হারানো মর্যাদাকে পুনরায় শক্তভাবে ফিরে পেতে এই ঐতিহাসিক রায় বিস্ময়কর ভূমিকা রাখবে। বুধবার ২৭ নবেম্বর এক জনাকীর্ণ আদালতে রায় পড়ে শোনান ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান। অভিযুক্ত জঙ্গী সংগঠন, যারা বিশ্ব সন্ত্রাসের ইতিহাসে আইএসের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা দেশীয় নব্য জেএমবি নামে মৌলবাদী সংগঠনের ৮ আসামির মধ্যে ৭ জনকেই মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকার অর্থদ- আসামিদের জন্য নির্ধারণ করেছে বিজ্ঞ আদালত। সন্ত্রাসী জঙ্গীরা অনুকম্পার অযোগ্য বিবেচনায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে। বিচারক ন্যায়নিষ্ঠার প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে অভিমত দেন, সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব কিছুই আমলে নেয়া হয়েছে। মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত জঙ্গী তানভীর কাদরির কিশোর ছেলের সাক্ষ্য ঘটনার সত্যতা নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিচারক উল্লেখ করেন। উদ্দেশ্যহীন জঘন্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে জিহাদ কায়েমের যে বেপরোয়া উন্মত্ততা, বাংলাদেশ কখনই তা অনুমোদন কিংবা সমর্থন করে না। শুধু তাই নয় জননিরাপত্তা এবং কল্যাণকে বিপন্ন করার যে কোন রক্তাক্ত আগ্রাসী আক্রমণকে প্রতিহত করা ছাড়াও ন্যায়বিচার প্রদানে আদালতের সুষ্ঠু কর্মপ্রক্রিয়া দেশের ভাবমূর্তি অনেকখানি বাড়িয়ে দেবে। মৌল ও জঙ্গীবাদ সশস্ত্র দুর্বৃত্তায়নে যে দানবীয় সহিংস ঘটনাকে উপস্থাপন করা হয়, তা কোনভাবেই সহনীয় কিংবা অনুকম্পার মধ্যে পড়ে না। ফলে অপরাধীদের যথার্থ ও সুষ্ঠু বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাদের প্রাপ্ত দন্ড দিতে আদালত থমকে দাঁড়ায়নি। সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২) (অ) ধারায় উপযুক্ত শাস্তি প্রদান; সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। নিহতদের স্বজনরা কোন শাস্তির বিনিময়ে তাদের হারানো মানুষদের ফিরে পাবে না। তবে সর্বোচ্চ শাস্তির নিশ্চয়তায় ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের কিছুটা প্রলেপ যদি হয়। রায় ঘোষণার সময় প্রিজন ভ্যানে করে আনা ৮ আসামিই আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিল। তবে তারা অনুশোচনীয়, অনুতপ্ত তো নয়ই, বরং দন্ডিতরা উন্মত্ত আস্ফালনে পুরো পরিস্থিতিকে বিস্ময়ের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এই জঘন্য নৃশংসতার পরিকল্পনা ও হামলাকারীর নেতৃত্বে ছিল বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী। সে পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে আগেই নিহত হয়। তামিমের সমন্বয় আর নির্দেশনায় এমন সহিংস পাশবিকতা সংঘটিত হয় বলে অন্য আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানা যায়। তামিম নিজেকে আন্তর্জাতিক ইসলামী জঙ্গী সংগঠন আইএসএর মৌলবাদী চেতনার দাবিদার বলে পরিচয় দিত। সেই মোতাবেক হলি আর্টিজানে হামলা করাও এক প্রয়োজনীয় ধর্মীয় নির্দেশ বলে সহযোগীদের উৎসাহিত করত সে। বিশিষ্টজনরা মনে করছেন জঙ্গীবাদকে প্রতিহত করতে এমন যুগান্তকারী রায় ঘোষণা সারা বিশ্বের মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে এক যথার্থ পদক্ষেপ। যে নৃশংস ঘটনায় একদিন পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন ওঠে, তেমন পাশবিকতার বিরুদ্ধে যথার্থ বিচারিক রায়ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া জাগায়। জাপানের গণমাধ্যম এনএইচকে ওয়ার্ল্ড তাদের সংবাদে সাত আসামির মৃত্যুদ-কে আইনের যথার্থ প্রয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই হামলায় সাত জাপানীর নৃশংস হত্যার খবরও নতুনভাবে উঠে আসে। বিবিসি, সিএনএন এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াও দিনভর এই বিচারের রায়ের ঘটনাকে সর্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখে। সংবাদ মাধ্যম উল্লেখ করে, ১২ ঘণ্টা ধরে চলা এই ভয়াবহ, রক্তাক্ত অভিযান বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে জঘন্যতম সন্ত্রাসী হামলা। দেশ-বিদেশের অনেক গণমাধ্যমে এই সহিংস ঘটনার রায়কে ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী এবং যথার্থ বিচারিক প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু সমাধান হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। অপরাধী সাত আসামির মৃত্যুদন্ডাদেশকেও আইনী বিধির সুষ্ঠু ও যথার্থ প্রয়োগ বলেও গণমাধ্যম সংবাদ প্রদানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। মানুষের মূল্যবান জীবন কারও অধীন নয়। তার মতামত, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, নিজস্ব আদর্শিক চেতনায় জীবনকে গড়ে তোলা প্রত্যেক মানুষের নাগরিক অধিকার। মত আর আদর্শের ভিন্নতার কারণে মৌলবাদী আগ্রাসন শুধু মানবিক মূল্যবোধের চরম লঙ্ঘনই নয়, ধর্মীয় শুদ্ধ চেতনার ওপরও সর্বগ্রাসী আক্রমণ। লেখক : সাংবাদিক
×