ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছেন বগুড়ার মেয়ে শ্রাবণী সুলতানা

আবৃত্তিতে সুর তাল লয়ে এক নতুন ধারার সৃষ্টি... সর্বত্র প্রশংসা

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ২ ডিসেম্বর ২০১৯

 আবৃত্তিতে সুর তাল লয়ে এক নতুন ধারার  সৃষ্টি... সর্বত্র প্রশংসা

সমুদ্র হক ॥ কণ্ঠে তার বিমূর্ত শৈলীর উপাখ্যান। আবৃত্তিতে গড়েছেন নতুন ধারার চিত্রকল্প। দেশের গন্ডি পেরিয়ে দেশকে সম্মানের আসনে পরিচিতি এনে দিয়েছেন। কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে বিজয় দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছেন। বিদেশের এক মঞ্চে তিনি যখন বলেন, ‘আপনাদের সবার প্রতি উদার আমন্ত্রণ ঘুরে আসুন ছবির মতো আমাদের দেশে।’ মিলনায়তনপূর্ণ দর্শক শ্রোতার মুহুর্মুহু করতালির সঙ্গে কৌতূহলী প্রশ্ন, কে এই মেয়ে, কোন দেশের? কৃতজ্ঞচিত্তে উত্তর দেন ‘আমি বাচিক শিল্পী শ্রাবণী সুলতানা। ১৩৮৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণের এই মেঘ এই বৃষ্টির খেলার মধ্যে জন্মেছি বাংলাদেশের গ্রামে। যে গ্রাম আজ বিশে^র বিম্ময়।’ এরপর নিজের সৃষ্ট নতুন ধারায় আবৃত্তি করেন দেশ-বিদেশের কবিদের কবিতা। বাংলাদেশের কবিতা দিয়ে শুরু ও শেষের মধ্যে এঁটে দেন ইংরেজী, হিন্দী, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার আঞ্চলিক ভাষার কবিতা। যে দেশে যান বাংলা কবিতার সঙ্গে সেই দেশের ভাষা শিখে আবৃত্তি করেন। ধ্রুপদী আবহ সঙ্গীতের মৃদু সুর লয়ের সঙ্গে কবিতার গতি সুর ও ছন্দে গড়ে নতুন এক ভিন্ন মাত্রা, যা গেঁথে যায় দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে। অনুরণিত হয় কবিতার ভাষা। কণ্ঠ শৈলীর অনুপম ধারা যে জনসচেতনতার একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম, তার প্রমাণ শ্রাবণী সুলতানা। বগুড়ার মেয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করার পর মাস্টার্স অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (এমবিএ) ডিগ্রী নিয়ে লেখাপড়ার পালা চালাচ্ছেন। বর্তমানে ‘ওমেন এমপাওয়ারমেন্টে’ এমফিল করছেন সিলেট শাহজালাল বিশ^বিদ্যালয়ে। ব্যবসায়ী স্বামী এক মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে পারিবারিক জীবনও সামলাচ্ছেন। এগিয়ে যাচ্ছেন বাচিক শিল্পী সত্তার পথ ধরে। শিকড়ের ওপর গড়ে তুলছেন রূপাতীত ধারার নতুন সৃষ্টি, যার সমাদৃত হচ্ছে দেশে দেশে। শ্রাবণীর এই নতুন ধারার আবৃত্তি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ভারতের দিল্লী, কলকাতা, যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ^বিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন, ত্রিপুরার আগরতলা নেপালের পোখারা, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, আর্লিংটন, কানাডা, লন্ডন, জাপানের কুরাশিকি, মালয়েশিয়ার মাশা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠনের আমন্ত্রণে এ পর্যন্ত শতাধিক আবৃত্তি অনুষ্ঠান করেছেন। এর মধ্যে আছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও বিদেশে স্ট্রিট শো ও একক আবৃত্তি সন্ধ্যা। তার কণ্ঠের ঢেউ-তরঙ্গের মোহনীয় সুরের সঙ্গে মৃদু সঙ্গীতের ধ্রুপদী তাল সুর শব্দ, কণ্ঠের ধ্বনিতে খেলা করে, যা প্রশংসিত হয়েছে সর্বত্র। শিল্পী গর্ব করে লিখেছেন ‘হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ গেঁথে নিয়েছি। আমার সকল পথ চলা মুক্তিযুদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে, দেশকে ভালবেসে।’ যুদ্ধ কথা কবিতায় লিখেছেন ‘সঙ্কটে সঙ্কটে ঘষে আমরা প্রমিত উচ্চারণে আবৃত্তিকে আলোকিত করে চলেছি মফস্বলের গলিপথ ধরে বিশ্বের মহাসড়কে’...। দেশের বাইরে প্রথম অংশগ্রহণ করেন দিল্লীতে। আবু হেনা মোস্তফা কামালের একটি কবিতা আবৃতির পর লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠের একটি গান ও তার মধ্যে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠের মিশ্রণে নিজস্ব ধারায় যখন শুরু করেন -ম্যায় পহেলি বার গান কে সাথ পোয়েট্রি রিসাইট করতি হুঁ। লতাজী আওর অমিতাজ জী বহুত বড়্য কালাকার, উনকো হাম ইজ্জত ভি করিতি হুঁ-। ভারতীয় দর্শক শ্রোতার আবেগ লক্ষ্য করে তিনি শুরু করেন ‘ই কাঁহা আগ্যয়ে হাম ইউহি সাথ সাথ চলতে...ম্যয় আওর মেরি তানহায়ী...মজবুরই ইয়ে হাল ইধার ভি হ্যায় উধার ভি, তানহায়ি ইয়ে রাত ইধারভি হ্যয় উধার ভি...। মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক শ্রোতা করতালিতে যখন মুখর তখন শ্রাবণী শুরু করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আর জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কিছু কবিতা। এর সঙ্গে সুর তাল লয়ের এক সংমিশ্রণে কণ্ঠের ভেরিয়েশনে উপস্থাপন করেন তার নিজস্ব ধারার আবৃত্তি। কবিতার শক্ত গাঁথুনি তার কণ্ঠে শুনে ভারতীয় কবিশিল্পীরা বলেন, দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও কাছে টানল শ্রাবণী। যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ের আবৃত্তি উৎসবে পুরুলিয়া ভাষায় আবৃত্তি করে তিনি প্রমাণ রাখেন তার প্রতিভার স্বাক্ষর। কবি দেবব্রত সিংহের পুরুলিয়া কবিতাটি ছিল এ রকম- ‘ছুটু বেলাতে পাহাড়কুলে চইড়্য লদী পেরাইতে যাইয়্য আষাঢ় মাসের হোরকা বানহে আমিহ আর আমাহার ভাই ভাইস্যে গেছিল্যাম বানহের তোড়ে। ভাইটো গেল ডুইব্য আমিহ উঠলাম ভাইস্য। পাড়হার লুকে বইললেক- বিটিছিলার জীবহন, ব্যটাছিলা হইতক তাহলি কি বাইচতক। আমহার মুরল লাই...’। যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবাশীষ দত্ত, অরুন কুমার চক্রবর্ত্তী, অধ্যাপক উমা বালা বসু, কবি কৃষ্ণা বসু অধ্যাপক শুভাদীপ বসু মুগ্ধ হয়ে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, এ মেয়ে আমাদের দুই বাংলার গর্ব। বরেণ্য লেখিকা উর্মিবালা বললেন, শ্রাবণীর আবৃত্তিই বাংলাদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ। শান্তিনিকেতনের এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় কবি সাহিত্যিক শিক্ষাবিদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের সেলিনা হোসেন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের বিশ^সভা নামে এটি ছিল আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান। সেখানে বাংলাদেশ, ভারত, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কবি সাহিত্যিকরা সমবেত হয়ছিলেন। শ্রাবণীর কণ্ঠশৈলীর বাংলা ইংরেজী আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হয়ে মার্কিন কবি মার্টিন ওয়াশিংটন ও আর্লিংটনে আমন্ত্রণ জানান। যুক্তরাষ্ট্রের আর্লিংটন স্ট্রিট ফেস্টিভ্যাল ও অডিটরিয়ামে তার অংশগ্রহণের পর প্রবাসী বাঙালীরা তাকে আমন্ত্রণ জানায়। শ্রাবণী একটি অনুষ্ঠানে বাচিক আবেদনে এ্যাঙ্করিং করেন। নেপালের পোখারায় স্ট্রিট ফেস্টিভ্যালে শ্রাবণী বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরেন আবৃত্তির নতুন ধারায়। কলকাতার এক অনুষ্ঠানে মণিপুরী নৃত্যের তালে কণ্ঠশৈলীতে আবৃত্তির নতুন ধারা এনে দেন। নৃত্যশিল্পী নীলমণি সিংহা এই ধারা নৃত্যনাট্যে সংযোজন করেন। ব্রুকলিন ব্রিজ, হোয়াইট চ্যাপল ও লন্ডনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের মিশ্রণে সঙ্গীতের ধারায় তার বাচিক শিল্পের নতুন তাল প্রশংসিত হয়। জাপানের টোকিও ও কুরাশিকি নগরীতে ধীর লয়ে জীবন নিয়ে গানের সুরে কবিতা আবৃত্তির ফর্ম ট্রানস্লেট হয় জাপানী ভাষায়। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আমন্ত্রণে গত বছর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তার আবৃত্তির প্রশংসা করেন আগরতলার মন্ত্রী ও ভারতীয় শিল্পরা। বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার কিরিটি চাকমা, ফার্স্ট সেক্রেটারি জাকির হোসেন ভূঁইয়া তাকে সম্মাননা দেন। আবৃত্তিতে শ্রাবণী সুলতানা বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন। বললেন, চর্চায় কবিতা পূর্ণতা পায়। বাচিক শিল্পীর মধ্যে বেড়ে ওঠে দেশাত্মবোধের চর্চা, দেশপ্রেম। মানবিকতা শেখার স্থান আবৃত্তি, যা বোধের চর্চা, মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করা। মানুষকে ভালবাসা যৌথ পরিচয়ে বেড়ে ওঠার মতো। কৈশোরে শ্রাবণী ছিলেন দারুণ ডানপিটে স্বভাবের। পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা, ঘুড়ি ওড়ানো, গাছে উঠে পেয়ারা লিচু পাড়া। তবে ওই বয়সেই গল্প কবিতা পড়া ছিল তার নেশা। বললেন, একটি ভাল কবিতার কয়েকটি সীমিত শব্দ, পিঠে পিঠে কয়েকটি পংক্তি জীবনের কথা বলে। তার এই পথে পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন দৃষ্টি বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি বাচিক শিল্পী মোস্তাক ইবনে মাহবুব শুভর কাছে। বলেন বাচিক শিল্পীরা কণ্ঠের শৈলী দিয়ে সব অসঙ্গতির প্রতিবাদ করতে পারে । বর্তমানে শ্রাবণী আবৃত্তির নতুন ধারায় নিজেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জীবনমুখী কবিতা লিখে ও সেই অঞ্চলের কথা বলার সুরে আবৃত্তি করে নতুন ধারার জানালা খুলতে যাচ্ছেন। হেসে বললেন, ‘আসুন আমাদের সৃজনশীল ধারায় অংশগ্রহণ করে দেশকে বিশ্বে উচ্চাসনে তুলে ধরি।’
×